বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়।
যেমন-
গঠনগত দিক থেকে শব্দের শ্রেণীবিভাগ
গঠনগত দিক থেকে শব্দ দুই প্রকার। যথা:
১. মৌলিক শব্দ (Simple or Root Word)
২. সাধিত শব্দ (Derived or Compound Word)
১। মৌলিক শব্দ:
যে শব্দসমূহকে বিশ্লেষণ করলে বিশ্লেষিত কোনো অংশেরই অর্থ পাওয়া যায় না, সে শব্দকে মৌলিক শব্দ বলা হয়। এ জাতীয় শব্দই ভাষার মূল শব্দ। যেমন : হাত, পা, মা, ভাই প্রভৃতি।
বিশ্লেষণ: প্রদত্ত ‘হাত, পা, মা, ভাই’ শব্দগুলিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যথাক্রমে- ‘হ্+আ+ত্, প্+আ, ম্+আ, ভ্+আ+ই’। এ শব্দগুলোর বিশ্লেষিত অংশ সমূহের কোন অর্থ নেই। সুতরাং এগুলো মৌলিক শব্দ।
২। সাধিত শব্দ:
যে শব্দসমূহকে বিশ্লেষণ করলে খণ্ডিত প্রধান অংশের বা দুই অংশেরই অর্থ পাওয়া যায়, সে সব শব্দই সাধিত শব্দ। মূল শব্দের সাথে প্রত্যয় বা উপসর্গ যোগে, সমাস বা সন্ধিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এ সব শব্দ গঠিত হয়ে থাকে। যেমন: পাথেয়, প্রহার, দিগন্ত, নীলাকাশ প্রভৃতি।
বিশ্লেষণ: প্রদত্ত শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যথাক্রমে- ‘পথ+এয়; প্র+হার; নীল+আকাশ’। লক্ষণীয় দিক যে, উদাহরণের প্রথম ও দ্বিতীয় শব্দ দুটির প্রধান অংশ (পথ ও হার)- এর নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। আবার পরের শব্দ দুটির দুই অংশেরই (দিক+অন্ত, নীল+আকাশ) অর্থ রয়েছে। এ শ্রেণীর শব্দ সাধিত শব্দ।
অর্থগত দিক থেকে শব্দের শ্রেণীবিভাগ
অর্থগত দিক থেকে শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১। যৌগিক শব্দ
২। রূঢ় বা রূঢ়ী শব্দ
৩। যোগরূঢ় শব্দ
১। যৌগিক শব্দ: যে শব্দ সমূহের প্রচলিত অর্থ মূল কেন্দ্রিক হয়ে থাকে, সে সব শব্দকে যৌগিক শব্দ বলা হয়। যেমন: পাঠক, ঘুমন্ত, চালক প্রভৃতি।
বিশ্লেষণ: এখানে উদাহরণ প্রদত্ত শব্দগুলোর মূল যথাক্রমে পাওয়া যায়- পঠ্ (পঠ্+অক); ঘুম(ঘুম+অন্ত); চল্(চল্+অক)। ‘পাঠক’ শব্দের অর্থ- যে পাঠ করে; ‘ঘুমন্ত’ শব্দের অর্থ- ঘুমে রত অবস্থা; ‘চালক’ শব্দের অর্থ- যে চালনা করে। এ শব্দগুলো তাদের মূল- ‘পঠ্, ঘুম, চল্’ কেন্দ্রিক অর্থেই প্রচলিত। এ জাতীয় শব্দকেই যৌগিক শব্দ বলা হয়।
২। রূঢ় শব্দ: যে শব্দসমূহের প্রচলিত অর্থ সে সব শব্দের মূল কেন্দ্রিক নয়, সে গুলোকে রূঢ় শব্দ বলে। যেমন: হাতি, বাঁশি, গবেষণা প্রভৃতি।
বিশ্লেষণ: উদাহরণ প্রদত্ত শব্দগুলোর মূল যথাক্রমে পাওয়া যায়- ‘হাত+ই=হাতি; বাঁশ+ই=বাঁশি; গো+এষণা= গবেষণা’। শব্দগুলোর অর্থ মূলকেন্দ্রিক নয়। কারণ, ‘হাত’ মানুষের অঙ্গ বিশেষ; ‘বাঁশ- বৃক্ষ বিশেষ এবং ‘গো’- প্রাণী (গরু) বিশেষ। কিন্তু এই সব মূল থেকে গঠিত ‘হাতি’ শব্দের অর্থ- একটি বিশাল প্রাণী; ‘বাঁশি’- বাদ্যযন্ত্র বিশেষ; ‘গবেষণা’- গভীরতম ও ব্যাপক অধ্যয়ন। এ সব শব্দের সাথে মূলশব্দ ‘হাত, বাঁশ, গো’- এর অর্থের কোনো সামঞ্জস্য নেই। এই শ্রেণীর শব্দকে রূঢ় শব্দ বলা হয়।
৩। যোগরূঢ় শব্দ: সমাস নিষ্পন্ন যে সব শব্দের অর্থ সমস্যমান পদসমূহের অনুযায়ী না হয়ে তৃতীয় কোনো অর্থ প্রকাশ করে, সে সব শব্দই যোগরূঢ় শব্দ। যেমন: দশানন, পঙ্কজ, রাজপুত প্রভৃতি।
বিশ্লেষণ: এখানে ‘দশানন’ (দশ+আনন) শব্দটির অর্থ- ‘দশ আনন যার’। সমস্যমান পদ অনুযায়ী- যে ব্যক্তির দশ আনন(মুখ) আছে, সেই দশানন। কিন্তু শব্দটি সে অর্থে প্রচলিত নয়। কেবল লঙ্কার রাজা রাবণকে বোঝাতে শব্দটি প্রচলিত। ‘পঙ্কজ’ শব্দটির অর্থ- পঙ্কে (কাদায়) জন্মে যা। সমস্যমান পদ অনুযায়ী পঙ্কে জন্মানো সব কিছুই পঙ্কজ হবার কথা। কিন্তু শব্দটি পঙ্কে জন্মানো সব কিছুকে নির্দেশ করে না। কেবল পদ্মফুলকে বোঝায়। তেমন ‘রাজপুত’ শব্দটির অর্থ- ‘রাজার পুত্র’। কিন্তু শব্দটি কোনো রাজপুত্রকে নির্দেশ না করে একটি জাতিকে বোঝায়। এই জাতীয় শব্দকেই যোগরূঢ় শব্দ বলা হয়।
উৎসগত দিক থেকে বা উৎপত্তির বিচারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ।
উৎসগত দিক থেকে শব্দকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১। তৎসম
২। তদ্ভব
৩। অর্ধ-তৎসম
৪। দেশী
৫। বিদেশী
✯ তৎসম শব্দঃ যেসব শব্দ পরিবর্তন ছাড়াই সংস্কৃত হতে বাংলায় সরাসরি এসেছে সেগুলোকে তৎসম শব্দ বলে। যেমন-চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য
✯ অর্ধ-তৎসম শব্দঃ যেসব সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দকে অর্ধ-তৎসম শব্দ বলে। যেমন-জ্যোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নী, বোষ্টম, কুচ্ছিত
✯ তদ্ভব শব্দঃ যেসব শব্দ সংস্কৃত হতে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দকে তদ্ভব শব্দ বলে। যেমন-হাত, চামার
✯ দেশী শব্দঃ যেসব শব্দ এদেশের আদিম অধিবাসী অনার্যদের ভাষা থেকে বাংলায় স্থান পেয়েছে সেগুলোকে দেশি শব্দ বলে। যেমন-কুঁড়ি, পেট, চুলা, কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ডাগর, ডিংগা, ঢেঁকি
✯ বিদেশী শব্দঃ
ক. আরবী শব্দঃ অজুহাত, আক্কেল, আজব, আতর, আদব-কায়দা, আদালত, আমল, আমানত, আলবত, আলাদা, আসল, আসামি, ইজ্জত, ইমারত, ইশতেহার, ইশারা, ইসলাম, উকিল, উজির, এজাহার, এলাকা, ওজন, ওয়ারিশ, কবর, কেবলা, কবুল, কামাল, কায়দা, কিস্তি, কুদরত, কেতাব, কৈফিয়ৎ, খবর, খাজনা, খারাপ, গজল, গরিব, ছবি, জবাব, জমজমাট, জরিপ, জেহাদ, তওবা, তকদির, তলব, তাগিদ তামাম, কারিখ, তালিকা, দলিল, দাখিল, নগদ, নবাব, ফর্দ, ফায়দা, ফাঁকা, বহি, বাকি, বাদ, মজবুত, মজলিস, মানা, মাফ, মামলা, মাল, মালিক, মেজাজ, মেরামত, মেহনত, রদ-বদল, রায়ত, রিপু, লায়েক, লেপ, লোকসান, শরবত, শহীদ, সিন্দুক, হাজত, হামলা, হারাম, হাল, হুকুম ইত্যাদি।
খ. ফারসি শব্দঃ বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দ প্রবেশের কারণ বাংলাদেশে মুসলমান শাসন। তেরো শতক থেকে আঠারো শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মুসলমানের শাসন করে বাংলাদেশ। তাদের ধর্মীয় ভাষা আরবি, রাজভাষা ফারসি এবং ঘরোয়া ভাষা তুর্কি। তাই এ তিন জাতের শব্দ ফারসি পরিচয়ে বাংলা ভাষায় বিদ্যমান। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, প্রায় ২৫০০ ফারসি শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে তুর্কি বিজয়ের পর থেকে ফারসি শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হতে থাকে। ষোলো শতক থেকে বাড়তে থাকে বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের প্রতাপ। আঠারো শতকে তা চরমরূপ লাভ করে। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা কমলালয়’ (১২৩০) গ্রন্থে খুব দুঃখ করেছিলেন বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের আধিপত্যে। তিনি একটি তালিকা করে দেখিয়েছিলেন যে ফারসি (ও আরবি) শব্দ কীভাবে সরিয়ে দিয়েছে তৎসম ও তদ্ভব বাংলা শব্দকে। তাঁর তালিকায় দেখা যায় “কল’, ‘কলম’, ‘খরচ’, ‘খারাব’, ‘খুব”- এর মতো বহু শব্দ (এগুলোর বাংলা “যন্ত্র’, ‘লেখনী’, ‘অল্প’, ‘ব্যয়’, ‘মন্দ’, ‘উত্তম”) অধিকার করেছে বাংলা শব্দের স্থান। ‘কিনারা’, ‘গ্রেফতার’, ‘দেয়াল’, ‘আয়না’, এসেছে ফারসি থেকে। ‘কিনারা’ ফারসিতে ছিল ‘কিনারাহ’, ‘গ্রেফতার’ ফারসিতে ছিল ‘গিরিফতার’, ‘দেয়াল’ ফারসিতে ছিল ‘দিওয়াল,’ ‘আয়না’ ফারসিতে ছিল ‘আইনাহ্’। এরকম আরও অনেক শব্দ একটু রূপ বদলিয়ে বাংলা হয়ে গেছে। ফারসি শব্দের উদাহরণঃ আইন, আওয়াজ, আঙুর, আচার, আজাদ, আতশবাজি, শুমারি, আন্দাজ, আফগান, আফসোস, আমেজ, আয়না, আরাম, আশকারা, আসমান, আস্তানা, আস্তে, ইয়ারকি, ইরানি, ওস্তাদ, কম, কামান, কারখানা, কারচুপি, কারবার, কারিগর, কুস্তি, কিনারা, কোমর, খরগোশ, খরিদ, খস্খস্, খানদানি, খাম, খুন, খুশি, খোরাক, খোশ, খোশামোদ, গরম, গর্দান, গোয়েন্দা, গোরস্থান, গোলাপ, চশমা, চাকর, চাদর, চাঁদা, জঙ্গল, জমি, জর্দা, জামা, জায়গা, তরমুজ, তাজা, তির, দরকার, দরখাস্ত, দরজা, দরবার, দরুন, দর্জি, দালান, দোকান, নমুনা, নাম, নালিশ, নাশতা, পছন্দ, পর্দা, পলক, পশম, পাইকারি, পেশা, পোশাক, ফরমান, বনাম, বালিশ, বন্দ, বন্দর, বন্দি, বস্তা, বাগান, বাচ্চা, বাজার, বাদশাহি, বাসিন্দা, মজুর, ময়দা, মোরগ, রসিদ, রোজগার, শিকার, শিরোনাম, সওদা, সবুজ, সরকার, সরাসরি, সাবাস, সেরা, হাঙ্গামা, হাজার ইত্যাদি।
গ. ইংরেজী শব্দঃ অফিস, আর্ট, এজেন্ট, এনামেল, কফি, কমা, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কোম্পানি, ক্যামেরা, ক্লাব, ক্লাস, গেট, গেঞ্জি, চেক, চেয়ার, টিকিট, টিন, টিফিন, টেবিল, টেলিগ্রাফ, ডজন, ডাক্তার, ড্রাম, নবেল, নোট, পকেট, পাউডার, পিয়ন, পুলিশ, পেন্সিল, প্যাকেট, ফটো, ফুটবল, ফোন, ব্যাগ, ম্যানেজার, মাস্টার, লাইব্রেরি, সিনেমা, সার্জন, স্কুল, স্টেশন, শার্ট, হাইকোর্ট ইত্যাদি।
ঘ. পর্তুগিজ শব্দঃ বাংলা ভাষায় একশো থেকে একশো দশটির মতো আছে পর্তুগিজ শব্দ। ‘আনারস’, ‘পিস্তল’, ‘সায়া’, ‘কামরা’, ‘বালতি’, ‘বারান্দা’, ‘পেঁপে’ পর্তুগিজ শব্দ। ‘আনারস’ পর্তুগিজে ছিল ‘অননস’। ‘পিস্তল’ পর্তুগিজে ‘পিস্তোল’, ‘সায়া’ (মেয়েদের পোশাক) পর্তুগিজে ছিল ‘সইঅ’। ‘কামরা’ ছিল ‘কমর’। ‘বালতি’ ছিল ‘বল্দে’। ‘বারান্দা’ পর্তুগিজে ছিল ‘ভেরানডা’। ‘পেঁপে’ পর্তুগিজে ছিল ‘পপইঅ’। এরকম আরও অনেক পর্তুগিজ শব্দ -আচার, আয়া, আলমারি, আলকাতরা, ইস্পাত, কামরা, কেরানি, গির্জা, গুদাম, চাবি, তোয়ালে, নিলাম, পাঁউরুটি, পাদ্রি, ফিতা, সাবান, ইত্যাদি।
ঙ. ফরাসী শব্দঃ কার্তুজ, কুপন, ডিপো, রেস্তোরা।
চ. ওলন্দাজ শব্দঃ ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন।
ছ. পাঞ্জাবি শব্দঃ চাহিদা, শিখ
জ. তুর্কী শব্দঃ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, তুর্কি শব্দ চল্লিশটির বেশি হবে না। ‘কুলি’, ‘কোর্মা’, ‘খাতুন’, ‘তোপ’, ‘বেগম’, ‘লাশ’ তুর্কি শব্দ। ‘কুলি’ তুর্কিতে ছিল ‘কুলী’ তখন তার অর্থ ছিল ‘ক্রীতদাস’। ‘কোর্মা’ তুর্কিতে ছিল ‘কওউর্মা’। ‘খাতুন’ তুর্কিতে ছিল ‘খতুন’। ‘বেগম’ তুর্কিতে ছিল ‘বেগুম’। ‘লাশ তুর্কিতে ছিল ‘লাস’।
ঝ. চীনা শব্দঃ চা, চিনি, লিচু
ঞ. বর্মী (মায়ানমার) শব্দঃ লুঙ্গি, ফুঙ্গি
ট. জাপানি শব্দঃ রিক্সা, হারিকেন
ঠ. ইতালীয় শব্দঃ মাফিয়া, ম্যাজেন্টা
ড. গ্রীক শব্দঃ দাম, কেন্দ্র, সেমাই, সুড়ং, ইউনানি
প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকে আগত অন্যান্য ভাষার শব্দঃ অস্ট্রেলিয়া- ক্যাঙ্গারু, ইতালি- ম্যাজেন্টা, জাপানি- ক্যারাটে, জুডো, রিক্সা, হাসনাহেনা ইত্যাদি। জার্মানি- ফ্যুরার, তিব্বত- লামা, দক্ষিণ আফ্রিকা- জেব্রা, পেরু- কুইনাইন, মালয়- কাকাতুয়া, কিরিচ, রুশ- বলশেভিক, সিংহল- বেরিবেরি,
অন্যান্য ভারতীয় ভাষা থেকে আগত শব্দঃ গুজরাটি- খদ্দর, তকলি, হরতাল; তামিল- চেট্টি; পাঞ্জাবি- চাহিদা, শিখ, তরকা; মারাঠি- বরগি (বর্গি); সাঁওতালি- বোঙ্গা, হাঁড়িয়া’ হিন্দি- ইস্তক, ওয়ালা, কাহিনি, খাট্টা, খানা, চামেলি, চালু, চাহিদা, টহল, পানি, ফালতু, তাগড়া ইত্যাদি।
আরবি-ফারসির মিশ্রণঃ ওয়াকিবহাল, ওরফে, কেতা-দুরস্ত, খয়রাতি, খয়ের খাঁ, খাতা, জমাদার, তাজমহল, তাঁবেদার, তৈরি, ফেরারি, ফৌজদারি, লেফাফা-দুরস্ত, শরবতি, হারামজাদা ইত্যাদি।
ফারসি-আরবির মিশ্রণঃ আবহাওয়া, আজগুবি, কুচকাওয়াজ, খুন-খারাপ, খুবসুরত, খোদাতালা, গরম মশলা, জবরদখল, না-দাবি, দস্তখত, দহরম-মহরম, নিমক-হারাম, নেক-নজর, পছন্দসই, বজ্জাত ইত্যাদি।
তুর্কি-ফারসির মিশ্রণঃ চুগলিখোর, তুরকি, মোগলাই ইত্যাদি।
আরবি-তুর্কির মিশ্রণঃ খাজাঞ্চি।
আরবি-চিনার মিশ্রণঃ কাবাব-চিনি।
মিশ্র শব্দঃ রাজা-বাদশা, হাট-বাজার, হেড-মৌলভী, হেড- পন্ডিত, খ্রিস্টাব্দ, ডাক্তার-খানা, পকেট-মার, চৌ-হদ্দি
পারিভাষিক শব্দঃ অম্লজান, উদযান, নথি, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপক, বেতার, মহাব্যবস্থাপক, সচিব, স্নাতক, স্নাতোকোত্তর, সমাপ্তি, সাময়িকী, সমীকরণ
শব্দগঠন বিষয়ক আলোচনা
শব্দগঠনঃ মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে, চারপাশের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বস্তুরাজিকে চিহ্নিত করার জন্য নানাবিধ শব্দ ব্যবহার করেছে। তারা কোনটির নাম দিয়েছে গাছ, মাটি, পাখি, ফুল আবার কোনো সম্পর্কের নাম দিয়েছে ভালোবাসা, শত্র“তা, মিলন প্রভৃতি। এ ভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে সৃষ্ট মৌলিক শব্দের সাথে প্রত্যয় বা উপসর্গ যোগে, সমাস বা সন্ধিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার নতুন শব্দ গঠিত হয়ে থাকে। যেমন: দিক+অন্ত=দিগন্ত; উৎ+হার=উদ্ধার; নীল+আকাশ+নীলাকাশ; দুৎ+কর দুষ্কর প্রভৃতি।
শব্দগঠনের বিভিন্ন রীতি বা উপায় উদাহরণসহ আলোচনা
বাংলা শব্দ গঠনের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে সে সব নিয়মে যেমন নতুন শব্দ গঠন করা যায়, তেমন ভাষা ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনা যায়। নিচে শব্দগঠনের নিয়ম বা রীতিগুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হল:
১। প্রকৃতি ও প্রত্যয় যোগে শব্দগঠন:
শব্দ (নাম বা ক্রিয়া)- এর মূলকে প্রকৃতি বলা হয়। আর প্রকৃতির সাথে যে ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ ও অর্থের সৃষ্টি করে, তাকে প্রত্যয় বলা হয়। প্রকৃতির সাথে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: ঢাকা+আই=ঢাকাই; পথ+এয়=পাথেয়; পর্ব+ইক=পার্বিক; হাত+ই=হাতি প্রভৃতি।
২। উপসর্গ যোগে শব্দগঠন:
উপসর্গ অব্যয় শ্রেণীর ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি। উপসর্গের নিজের কোন অর্থ নেই। এ গুলো শব্দ ও ধাতুর পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ ও অর্থের সৃষ্টি করে। তাই উপসর্গ দ্বারা নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: আ+হার=আহার; বি+হার=বিহার; উপ+হার=উপহার; পরি+হার=পরিহার ইত্যাদি।
৩। সমাস প্রক্রিয়ায় শব্দগঠন:
দুই বা ততোধিক সম্পর্কিত শব্দ (পদ) এক শব্দে (পদে) পরিণত হওয়াকে সমাস বলা হয়। সমাসের মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: মৌ সংগ্রাহক মাছি= মৌমাছি; সপ্ত অহের সমাহার= সপ্তাহ; শহরের সদৃশ= উপশহর; বে(নেই) তার যার =বেতার প্রভৃতি।
৪। সন্ধির মাধ্যমে শব্দগঠন:
দুটি শব্দের দ্রুত উচ্চারণের ফলে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে দুটি ধ্বনির মিলন বা বিপর্যয় বা পতন হওয়াকে সন্ধি বলে। সন্ধির মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: বদ্যা+আলয়= বিদ্যালয়; তৎ+কার=তস্কর; পরিঃ+কার=পরিষ্কার; বহিঃ+কার=বহিষ্কার প্রভৃতি।
৫। শব্দদ্বিত্ব হয়ে শব্দগঠন:
কখনো কখনো একটি বিশেষ অর্থপূর্ণ শব্দ পাশাপাশি দুইবার ব্যবহৃত হয়ে নতুন শব্দ ও অর্থের সৃষ্টি করে। তাই শব্দের দ্বিত্ব (পাশাপাশি দুইবার ব্যবহৃত হওয়া) হয়ে তুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন: ছলছল, টনটন, মর্মর, টলটল, কনকন প্রভৃতি।
৬। পদপরিবর্তনকৃত শব্দগঠন:
এক পদ অন্য পদে পরিবর্তন করার মাধ্যমে নতুন শব্দ ও অর্থের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এক পদ আরেক পদে পরিবর্তিত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়।
যমন: সুন্দর>সৌন্দর্য, মধুর>মাধুর্য, তরুণ>তারুণ্য, বৃদ্ধ>বার্ধক্য প্রভৃতি।
Bangla 2nd Paper pdf download
সংখ্যাবাচক শব্দ
সংখ্যাবাচক শব্দঃ সংখ্যা মানে গণনা বা গণনা দ্বারা লব্ধ ধারণা। সংখ্যা গণনার মূল একক ‘এক’। কাজেই সংখ্যাবাচক শব্দে এক, একাধিক, প্রথম, প্রাথমিক ইত্যাদির ধারণা করতে পারি। যেমন: এক টাকা, দশ টাকা। এক টাকাকে এক এক করে দশ বার নিলে হয় দশ টাকা।
সংখ্যাবাচক শব্দ চার প্রকার
১. অঙ্কবাচক, ২. পরিমাণ বা গণনাবাচক, ৩. ক্রম বা পূরণবাচক ও ৪. তারিখবাচক।
১. অঙ্কবাচক সংখ্যাঃ
‘তিন টাকা’ বলতে এক টাকার তিনটি একক বা এককের সমষ্টি বোঝায়। আমাদের একক হল ‘এক’। সুতরাং এক +এক+এক = তিন।
এ ভাবে আমরা এক থেকে একশ পর্যন্ত গণনা করতে পারি। এক থেকে একশ পর্যন্ত এ ভাবে গণনার পদ্ধতিকে বলা হয় দশ গুণোত্তর পদ্ধতি।
এক থেকে দশ পর্যন্ত আমরা এ ভাবে লিখে থাকি: এক(১), দুই(২), তিন(৩), চার(৪), পাঁচ (৫), ছয় (৬), সাত (৭), আট (৮), নয়(৯), ১০(দশ)। এখানে যে সব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোকে বলে অঙ্ক। এক থেকে নয় পর্যন্ত অঙ্কে লিখিত। দশ লিখতে এক লিখে তার ডানে একটি শূন্য (১০) দিতে হয়। এই শূন্যের অর্থ বাম দিকে লিখিত পূর্ণ সংখ্যাটির দশ গুণ। এটিই দশ গুণোত্তর প্রণালীর নিয়ম। এ ধরনের প্রতিটি ‘দশ’ কে একক ধরে আমরা বিশ বা কুড়ি (২০), ত্রিশ (৩০), চল্লিশ (৪০), পঞ্চাশ (৫০), ষাট (৬০), সত্তর(৭০), আশি (৮০), নব্বই(৯০) পর্যন্ত গণনা করি। তারপরের দশকের একককে বলা হয় একশ (১০০)।
এ ভাবে আমরা দশের গুণন ও এককের সংকলন করে বিভিন্ন সংখ্যা লিখে থাকি। যেমন: এক দশ+এক= এগার(১০+১=১১), এক দশ চার = চৌদ্দ (১০+৪)= ১৪ ইত্যাদি। এ ভাবে দশকের ঘরে দুই (২) হলে বলি দুই দশ =বিশ (১০+১০=২০) এবং দুই দশ এক = একুশ (১০+১০+১=২১)। এ রূপ- তিন দশ+এক= একত্রিশ, চার দশ+এক= একচল্লিশ ইত্যাদি।
২. পরিমাণ বা গণনা বাচক সংখ্যাঃ
একাধিক বার একই একক গণনা করলে যে সমষ্টি পাওয়া যায়, তাই-পরিমাণ বা গণনাবাচক সংখ্যা। যেমন- সপ্তাহ বলতে আমরা সাত দিনের সমষ্টি বুঝিয়ে থাকি। সপ্ত(সাত) অহ (দিনক্ষণ)=সপ্তাহ। এখানে দিন একটি একক। এ রূপ- সাতটি দিন বা সাতটি একক মিলে হয়েছে সপ্তাহ।
পূর্ণসংখ্যার গুণবাচক সংখ্যা: একগুণ= এক। যেমন- একেক্কে এক (অর্থাৎ ১☓১=১), এ রকম- দুয়েক্কে দুই, সাতেক্কে সাত ইত্যাদি। দুই গুণ= দ্বিগুণ বা দু গুণ। যেমন- দুই দু গুণে চার (২☓২=৪)।
অনুরূপ ভাবে, পাঁচ দু গণে দশ (৫☓২=১০), সাত দু গুণে চৌদ্দ (৭☓২=১৪)। তিন গুণ=তিরিক্কে। যেমন- তিন তিরিক্কে নয় (৩☓৩=৯)।
চার গুণ = চার বা চৌকা। যেমন- তিন চারে বা চৌকা বার (৩☓৪=১২)
পাঁচ গুণ = পাঁচা। যেমন- পাঁচ পাঁচা পঁচিশ (৫☓৫=২৫) ।
ছয় গুণ = ছয়ে। যেমন- তিন ছয়ে আঠার (৩☓৬=১৮)।
সাত গুণ = সাতা। যেমন- তিন সাতা একুশ (৩☓৭=২১)।
আট গুণ = আটা। যেমন- তিন আটা (বা তে আটা) চব্বিশ (৩☓৮=২৪)।
নয় গুণ = নং বা নয়। যেমন- তিন নং (বা তিন নয়) সাতাশ (৩☓৯=২৭)।
দশ গুণ = দশং বা দশ। যেমন- তিন দশং (বা তিন দশ) ত্রিশ (৩☓১০=৩০)।
বিশ গুণ = বিশং বা বিশ। যেমন- তিন বিশং (বা তিন বিশ) ষাট (৩☓২০=৬০)।
ত্রিশ গুণ = ত্রিশং বা ত্রিশ। যেমন- তিন ত্রিশং (বা তিন ত্রিশ) নব্বই (৩☓৩০=৯০)।
এ রূপ-চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই বা শ’- র পূরণবাচক সংখ্যা গণনা করা হয়।
পূর্ণসংখ্যার ন্যূনতা বা আধিক্য বাচক ‘সংখ্যা শব্দ’
(ক) ন্যূনঃ
এক এককের চার ভাগের এক ভাগ (১/৪ ) = চৌথা, সিকি বা পোয়া।
এক এককের তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩ ) = তেহাই।
এক এককের দুই ভাগের এক ভাগ (১/২ ) = অর্ধ বা আধা।
এক এককের আট ভাগের এক ভাগ (১/৮ ) = আট ভাগের এক বা এক অষ্টমাংশ।
তেমনি- এক পঞ্চমাংশ (১/৫ ), এক দশমাংশ (১/১০ ) ইত্যাদি। এ সবের আরও ভাঙতি হলে, যেমন- চার ভাগের তিন (৩/৪ ) = তিন চতুর্থাংশ। আট ভাগের তিন (৩/৮ )= তিন অষ্টমাংশ ইত্যাদি। এক এককের (৩/৪ ) কে পরবর্তী সংখ্যার পৌনে বলা হয়।
যেমন- পৌনে তিন = (২☓৩/৪ ), পৌনে ছয় = (৫☓৩/৪ )ইত্যাদি।
পৌনে অর্থ পোয়া অংশ বা এক চতুর্থাংশ (১৪ ) কম। অর্থাৎ পৌনে= ১-১৪ =৩৪ ।
সওয়া = ১☓১/৪ (সওয়া বা সোয়া এক)
দেড় = ১☓১/২ =১২ কম ২।
আড়াই = ২☓১/২ =১২ কম ৩।
এ গুলো ছাড়া অর্ধযুক্ত থাকলে সর্বত্র ‘সাড়ে’ বলা হয়। যেমন- ৩☓১/২ = সাড়ে তিন, ৪☓১/২ = সাড়ে চার ইত্যাদি।
৩. ক্রমবাচক বা পূরণবাচক সংখ্যাঃ
একই সারি, দল বা শ্রেণীতে অবস্থিত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যার ক্রম বা পর্যায় বোঝাতে ক্রম বা পূরণবাচক সংখ্যা ব্যবহৃত হয়। যেমন- দ্বিতীয় লোকটিকে ডাক। এখানে গণনায় এক জনের পরের লোকটিকে বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় লোকটিকে আগের লোকটিকে বলা হয় ‘প্রথম’ এবং প্রথম লোকটির পরের লোকটিকে বলা হয় দ্বিতীয়। এ রূপ- তৃতীয়, চতুর্থ ইত্যাদি।
৪. তারিখবাচক শব্দঃ
বাংলা মাসের তারিখ বোঝাতে যে সংখ্যাবাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়, তাকে তারিখবাচক শব্দ বলে।
যেমন- পয়লা বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ ইত্যাদি। তারিখবাচক শব্দের প্রথম চারটি অর্থাৎ ১ থেকে ৪ পর্যন্ত হিন্দি নিয়মে সাধিত হয়। বাকি শব্দ বাংলায় নিজস্ব ভঙ্গিতে গঠিত।
নিচে বাংলা অঙ্কবাচক, গণনাবাচক, পূরণবাচক ও তারিখবাচক সংখ্যাগুলো দেওয়া হল-
অঙ্ক বা সংখ্যা → গণনাবাচক → পূরণবাচক → তারিখবাচক
১ → এক → প্রথম → পহেলা
২ → দুই → দ্বিতীয় → দোসরা
৩ → তিন → তৃতীয় → তেসরা
৪ → চার → চতুর্থ → চৌঠা
৫ → পাঁচ → পঞ্চম → পাঁচই
৬ → ছয় → ষষ্ঠ → ছউই
৭ → সাত → সপ্তম → সাতই
৮ → আট → অষ্টম → আটই
৯ → নয় → নবম → নউই
১০ → দশ → দশম → দশই
১১ → এগার → একাদশ → এগারই
১২ → বার → দ্বাদশ → বারই
১৩ → তের → ত্রয়োদশ → তেরই
১৪ → চৌদ্দ → চতুর্দশ → চোদ্দই
১৫ → পনের → পঞ্চদশ → পনেরই
১৯ → ঊনিশ → ঊনবিংশ → ঊনিশে
২০ → বিশ/কুড়ি → বিংশ → বিশে
২১ → একুশ → একাদশ → একুশে
0 Comments:
Post a Comment