SSC আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের (Srijonshil) সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর pdf download

আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর | নবম-দশম শ্রেণির গাইড

নবম-দশম শ্রেণি
বাংলা ১ম পত্র গাইড
গল্প/গদ্য

আম-আঁটির ভেঁপু 
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

SSC Bangla 1st Paper Golpo
Am Atir Vepu
Srijonshil
Question and Answer pdf download
আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর: নবম-দশম শ্রেণি

১নং সৃজনশীল প্রশ্নঃ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর দাওঃ
মকবুল, আবুল, সুরত সবাই বেশ পরিশ্রমী। নিজেদের জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গাচাষ করে, লাকড়ি কাটে, মাঝিগিরি করে, কখনো কখনো অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের স্ত্রীরাও বসে নেই। ভাগ্যের উন্নতির জন্য পাতা দিয়ে পাটি বোনে, বাড়ির আঙিনায় মরিচ, লাউ, কুমড়া ফলায়, বিল থেকে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে। কোনোরকমে জীবন চলে যাচ্ছে তাদের।
ক. দুর্গার বয়স কত? ১
খ. বামুন হিসেবে বাস করার প্রস্তাবে হরিহর রাজি হলোনা কেন? ২
গ. উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের ফুটে ওঠা দিকটি ব্যাখ্যা করো। ৩
ঘ. উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূলভাবকে কতটুকু ধারণ করে? যুক্তিসহ বুঝিয়ে লেখো। ৪

১নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ ক
✍ দুর্গার বয়স দশ-এগারো বছর।

১নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ খ
✍ বামুন হিসেবে বাস করার প্রস্তাবে হরিহর রাজি হতে পারল না আত্মসম্মানবোধ ও পাওনাদারদের ভয়ে এসে বলত টাকা দাও, নৈলে যেতে দেব না।

✍ মাসিক ৮ টাকা মাইনের গোমস্তার কাজ করে হরিহর। সামান্য ভিটে বাড়িটি ছাড়া আর কিছুই নেই হরিহরের। দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছে সে। ধার শোধ দিতে পারছে না। তাই বামুন হয়ে বসবাসের প্রস্তাবটি তার জন্য সোনায় সোহাগা হলেও সে তা তখনই গ্রহণ করতে পারেনি পাওনাদারদের ভয়ে। তার ভয় পাওনাদাররা খবর পেলে হট্টগোল বাধিয়ে দেবে। তাছাড়া সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলে তার মর্যাদারও হানি ঘটত বলে সে মনে করেছে।

১নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ গ
✍ উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার চিত্রটি ফুটে উঠেছে।

✍ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে মূলত গ্রামীণজীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাই-বোনের আনন্দিত জীবনের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। অপু ও দুর্গা দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও গল্পে দারিদ্র্যের সেই কষ্ট প্রধান হয়ে ওঠেনি। গ্রামের ফলমূল আহারের আনন্দ, শিশুর দুরন্তপনা, বিস্ময় ও কৌতূহল আমাদের চিরায়ত গ্রামীণ শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। দরিদ্র গৃহিণী সর্বজয়ার সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা, হাড়ভাঙা খাটুনি, দুগ্ধ দোহন, সন্তানদের সাথে চেঁচামেচি ইত্যাদি একেবারেই গ্রামীণজীবনের প্রতিচ্ছবি।

✍ উদ্দীপকেও বর্ণিত হয়েছে গ্রামের নিম্নবিত্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। মকবুল, আবুল, সুরত আলী পরিশ্রমী মানুষ। সবাই জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত। তাদের নিজের জমি নেই, অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। লাকড়ি কেটে, মাঝিগিরি করে, কখনো কামলা খেটে তারা অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে। বসে নেই তাদের স্ত্রীরাও। পাটি বোনে, বাড়ির আঙিনায় মরিচ, লাউ, কুমড়া ফলায়, বিল থেকে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে কোনোমতে দিন পার করে। উদ্দীপকে তাই ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে উল্লিখিত হরিহর ও সর্বজয়ার জীবনযাপনের চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে। উভয় স্থানেই নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনসংগ্রাম আমরা লক্ষ করি।

১নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ ঘ
✍ উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূলভাবকে আংশিকভাবে ধারণ করে।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অপরাপর সাহিত্যকর্মের মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবন-যাপনের অসাধারণ আলেখ্য নির্মাণ করেছেন। গল্পের অধিকাংশ জুড়ে আছে ছোট দুটি ভাই-বোনের দুরন্তপনা আর তাদের মধ্যকার খুনসুঁটি। আমের কুসি খাওয়াসহ নানা প্রকার দুষ্টুমি করে মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়েই। অন্যদিকে গৃহিণী সর্বজয়া সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করে। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় থাকে হরিহর।

✍ উদ্দীপকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কর্মব্যস্ত নর-নারীর জীবনচিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। মকবুল, আবুল, সুরত সকলেই পরিশ্রমী। নানা কাজ করে জীবন ধারণ করে। তাদের স্ত্রীরাও একটু উন্নতির আশায় পাটি বোনে, বাড়ির আঙিনায় সবজি ফলায়, শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে। উদ্দীপকে তাই বর্ণিত হয়েছে এদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম, যা ‘আমা-আঁটির ভেঁপু’ গল্পেও লক্ষণীয়।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূল বিষয়ই হলো প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাইবোনের কাহিনি। তাদের দুরন্তপনার বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে গ্রামীনজীবনের চিত্রও উঠে এসেছে। কিন্তু উদ্দীপকে মূলত গ্রামীণ সমাজের জীবনচিত্রটিই তুলে ধরা হয়েছে, যা  কেবল ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের একটি দিককে ধারণ করে। শৈশবের উদ্দামতার বিষয়টি উদ্দীপকে উপেক্ষিতই থেকে গেছে। তাই উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সম্পূর্ণ মূলভাবকে ধারণ করতে পারে নি।
 

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer
২নং সৃজনশীল প্রশ্নঃ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর দাওঃ
প্রকাণ্ড একটা ঢাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করিয়া উচ্চঃস্বরে স্বরচিত রাগিনী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদী তীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বীনী চিত্তকে চঞ্চল করিত।
ক. হরিহর কাজ সেরে কখন বাড়ি ফিরল? ১
খ. দিদির কথায় নুন ও তেল আনতে অপু দ্বিধা করছিল কেন? ২
গ. উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের কোন দিকের ইঙ্গিত লক্ষণীয়? ৩ 
ঘ. উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সমগ্রতা স্পর্শ করেছে কি? তোমার মতামত যাচাই করো। ৪

২নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ
ক. হরিহর কাজ সেরে দুপুরের কিছু পরে বাড়ি ফিরল।

খ. মায়ের ভয়ে অপু দিদির কথায় নুন ও তেল আনতে দ্বিধা করছিল।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে অপু ও দুর্গা পল্লির প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাই-বোনের এক অপরূপ দৃষ্টান্ত। তারা মাকে ভয় করে। কোনো দোষ-ত্রæটি করলে মা শাসন করবে- এই ভয় দুর্গার পাশাপাশি অপুর মনেও ছিল। তাছাড়া গোসল না করে নুন, তেলের ভাঁড় ছুলে অমঙ্গল হবে বলে বাসি কাপড়ে তা ছোঁয়া নিষেধ ছিল। অপু বাসি কাপড় পরে থাকায় মায়ের ভয়ে নুন তেল আনতে দ্বিধা করছিল।

গ. উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে বর্ণিত দুর্গা ও অপুর শৈশবের চঞ্চলতার ইঙ্গিত লক্ষণীয়।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাইবোনের আখ্যান রচিত হয়েছে। গল্পে দুর্গা ও অপু মানুষের শাশ্বত শৈশবের প্রতিনিধি। তাদের শিশুসুলভ কৌতূহল ও বিস্ময়, গ্রামীণজীবনের প্রকৃতি সান্নিধ্যতা পাঠকের মনে শৈশব স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।

✍ উদ্দীপকে মানুষের শৈশব চঞ্চলতার দিকটি লক্ষণীয়। শৈশবকালে গ্রামীণজীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠতা মানুষকে চঞ্চল করে তোলে। মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, নদীর তীরে ছুটে  বেড়ানো, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করা এসব চঞ্চলতার প্রকাশ ঘটে মানুষের শৈশবেই। উদ্দীপকে এমনই এক চমৎকার সময়ের উল্লেখ রয়েছে, যা ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের অপু ও দুর্গার শৈশবের আনন্দমুখরতাকেই ইঙ্গিত করে।

ঘ. উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের খণ্ডিত ভাবের ধারক।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে গ্রামীণজীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাইবোনের আনন্দঘন জীবনের আখ্যান রচিত হয়েছে। তাদের আনন্দের মাঝে পরিবারের দারিদ্র্য কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই দিকটির পাশাপাশি গল্পে সর্বজয়ার মাঝে শাশ্বত পল্লিমায়ের চরিত্র এবং গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের অভাবের দিকটি চিত্রিত হয়েছে।

✍ উদ্দীপকে গ্রামীণ প্রকৃতিঘনিষ্ঠ আনন্দঘন দিনগুলোর স্মৃতি স্মরণ করা হয়েছে। গ্রামের প্রকৃতি যেমন মানুষকে আকর্ষণ করে তেমনি তা মানুষের মনকে চঞ্চলতায় ভরিয়ে দেয়। তাই গ্রামীণজীবনের মাঠ-ঘাট, নদী-নালার সান্নিধ্যে থাকলে মানুষ বিমোহিত হয়। উদ্দীপকে গ্রামীণজীবনের এই প্রকৃতিঘনিষ্ঠতার দিকটি বোঝানো হয়েছে। গ্রামের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো সবই গ্রামীণজীবনের প্রতিচ্ছবি।

✍ উদ্দীপকে শুধু ‘আম-আঁটির ভেপু’ গল্পে বর্ণিত প্রকৃতিঘনিষ্ঠ জীবনের দিকটির ইঙ্গিত রয়েছে। গ্রামীণজীবনের মাঠ-ঘাট, বনবাদাড় সবকিছুই মানুষের মনে চঞ্চলতার সৃষ্টি করে। তাই প্রতিটি মানুষ এই প্রকৃতি থেকে পেতে চায় আনন্দ। যা গল্পে ও উদ্দীপকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু গল্পে উল্লিখিত এই প্রকৃতিঘনিষ্ঠতা ছাড়া অন্য দিকগুলোর কোনো ইঙ্গিত উদ্দীপকে নেই। গল্পের চরিত্রগুলো দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে। সন্তানের জন্য মমতাময়ী মায়ের ভালোবাসার চিত্রও পাওয়া যায় এখানে। কিন্তু উদ্দীপকে এ ধরনের কোনো দিক উপস্থাপিত হয়নি। তাই উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সমগ্রতাকেও স্পর্শ করতে পারেনি।
 
এসএসসি বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনি প্রশ্ন-উত্তরসহ:

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer
৩নং সৃজনশীল প্রশ্নঃ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর দাওঃ
মমতার অভাবের সংসার। সে চৌধুরীবাড়িতে রান্নার কাজ করে। মমতার সংসারের অভাবের কথা জেনে গৃহকর্ত্রী মমতাকে সপরিবারে তাদের বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এতে ঐ বাড়িতে মর্যাদা কমে যাবে ভেবে মমতা এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
ক. গরুর দুধ দোহন করতে এসেছিল কে? ১
খ. অপু দাঁত টকে যাওয়ার কথা বললে দুর্গা ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় কেন? ২
গ. উদ্দীপকের মমতার সাথে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহরের সাদৃশ্য রয়েছে কীভাবে? ব্যাখ্যা করো। ৩ 
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূলভাবকে ধারণ করে না।”- উক্তিটি যাচাই করো। ৪

৩নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ
ক. গরুর দুধ দোহন করতে এসেছিল স্বর্ণ গোয়ালিনী।

খ. মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়ে দাঁত টকে যাওয়ার কথা বলার সময় দুর্গা ইশারায় অপুকে থামিয়ে দেয়।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে সর্বজয়া একটি শাশ্বত পল্লিমায়ের চরিত্র। তাকে অপু ও দুর্গা ভয় করে। কেননা তিনি ছেলেমেয়েকে শাসন করেন। দুর্গা ও অপু আম কুড়িয়ে এনে খেয়েছে এ কথা জানলে সর্বজয়া তাদের বকবেন। এই ভয়ে আম খেয়ে দাঁত টকে যাওয়ার কথা বলার সময় দুর্গা অপুকে ইশারায় নিষেধ করে থামিয়ে দেয়।

গ. আত্মসম্মানবোধ ধারণের দিক থেকে উদ্দীপকের মমতার সাথে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে হরিহরের সাদৃশ্য বিদ্যমান।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে হরিহর একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ। দরিদ্র হলেও নিজের সম্মানহানি যেন না হয় সে ব্যাপারে তিনি সচেতন। তাঁর সেই পরিচয় পাওয়া যায় দশঘরার মাতবরের প্রস্তাবের ব্যাপারে স্ত্রীর সাথে আলোচনার সময়। মাতবর ছোটলোক ভাববে মনে করে সপরিবারে দশঘরায় যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েও সাথে সাথে তিনি রাজি হননি। হরিহরের এ ধরনের আচরণে আত্মমর্যাদাবোধের প্রকাশ লক্ষণীয়।

✍ উদ্দীপকের মমতার কর্মকাণ্ডেও আত্মমর্যাদাবোধের প্রকাশ ঘটেছে। সে দরিদ্র হলেও তার আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়নি। তাই গৃহকর্ত্রীর উদার প্রস্তাবে সে রাজি হতে পারে না। গৃহকর্ত্রীর অধীনে সপরিবারে বসবাস করলে তার মর্যদা যে নিচে নেমে যেতে পারে সেই ভাবনা তাকে উঁচু চিন্তা-চেতনার অধিকারী করে তুলেছে। মমতার এই আত্মসম্মানবোধের দিকটিই ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহরের সাথে তাকে সাদৃশ্যময় করে তুলেছে।

ঘ. ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূলকথা গ্রামীণজীবনে চিরায়ত শৈশবের বর্ণনা হলেও উদ্দীপকে মমতার আত্মসম্মানচেতনা বর্ণনাই উদ্দেশ্য।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে গ্রামীণজীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাইবোনের আনন্দিত জীবনের আখ্যান রচিত হয়েছে। গল্পে অপু ও দুর্গা হতদরিদ্র পরিবারের শিশু হয়েও তাদের স্বভাবসুলভ আনন্দ উদ্যাপন করেছে। গ্রামীণ ফলফলাদি আহারের আনন্দ এবং বিচিত্র বিষয় নিয়ে কৌতূহল অপু ও দুর্গা চরিত্রের মাঝে মানুষের চিরায়ত শৈশবেরই প্রকাশ ঘটিয়েছে। গল্পে আনুষঙ্গিক অন্যান্য বর্ণনা থাকলেও মূলত এ দিকটিই গল্পের মূলকথা।

✍ উদ্দীপকে মমতার আত্মসম্মানবোধের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। মমতা গৃহকর্মীর কাজ করলেও তার নিজের আত্মমর্যাদা ঠিক রেখেছে। এ কারণে গৃহকর্ত্রীর লোভনীয় প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্যের মাঝে বেঁচে থাকলেও নিজের মর্যাদার হানি ঘটে এমন প্রস্তাবে সে রাজি হয় না। আর মমতার চরিত্রের এই গুণের বর্ণনা প্রদানই উদ্দীপকের মূল উদ্দেশ্য।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পটি এবং উদ্দীপকটি উদ্দেশ্যগত দিক থেকে ভিন্ন। কেননা গল্পটি যে ভাবধারা প্রকাশ করেছে, উদ্দীপকটি তা করেনি। ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে গ্রামীণ পরিবেশে চিরায়ত শৈশবকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্দীপকে একজন গৃহকর্মীর মর্যাদাবোধের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে বর্ণিত হরিহরের সাথে কিছুটা গুণগত মিল ছাড়া উদ্দীপকের সাথে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের কোনো মিল নেই। উদ্দীপকটি তাই গল্পের মূলভাবকে ধারণ করতে পারে না। কেবল খণ্ডিত একটি ভাবকে ধারণ করে।

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer
৪নং সৃজনশীল প্রশ্নঃ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর দাওঃ
দুঃখিনী রাহেলার দিন কাটে খুব কষ্টে। দুধের ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য পরের বাড়িতে কাজ করতে হয়। তার বেকার স্বামী তার জমানো টাকা চুরি করে নেশা করে। রাহেলার কষ্টে ব্যথিত হয়ে গৃহকর্ত্রী তাকে স্বামীসহ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব দেন। আগ্রহের অভাব না থাকলেও রাহেলা কারও দয়ার বশবর্তী হয়ে বাঁচতে চায় না বলে জানিয়ে দেয়। স্বামীর স্বভাব খুব ভালো ভাবেই জানা আছে তার। রাহেলা জানে এ বাড়িতে এলে চোর, নেশাখোর স্বামীর কারণে তাকে অনেক অপদস্থ হতে হবে।
ক. আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের রচয়িতা কে? ১
খ. মায়ের ডাকে  দুর্গা উত্তর দিতে পারল না কেন? ২
গ. উদ্দীপকের রাহেলার সিদ্ধান্তের সাথে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহরের গৃহিত সিদ্ধান্তের অমিল দেখাও। ৩ 
ঘ. উদ্দীপকের রাহেলা ও ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহর দুজনেই দরিদ্র হলেও আত্মসম্মান ও বিবেচনাবোধ বিসর্জন দেয়নি- উক্তিটি বিশ্লেষণ করো। ৪

৪নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ
ক. আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

খ. মায়ের ডাকে দুর্গার উত্তর দিতে না পারার কারণ হলো- তখন তার মুখভর্তি ছিল জারানো আমের চাকলা।

✍ দুর্গা পটলিদের বাগানের আম কুড়িয়ে এনে ছোট ভাই অপুকে সাথে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছিল মা দেখে ফেললে বকবেন এই ভয়ে। হঠাৎ মায়ের ডাক পড়ায় বাকি আমগুলো দুর্গা মুখে পুরে ফেলল। তখন মুখভর্তি আম থাকায় দুর্গার মায়ের ডাকের উত্তর দিতে পারল না।

গ. উদ্দীপকের রাহেলা সপরিবারে আশ্রয় লাভের সুযোগ ফিরিয়ে দিলেও ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহর তা না করায় রাহেলা ও হরিহরের মাঝে অমিল ফুটে ওঠে।

✍ ‘আম-আঁটির ভেপুঁ’ গল্পে হরিহর একজন দরিদ্র মানুষ। সে অন্নদা রায়ের বাড়িতে গোমস্তার কাজ করে। সংসারের টানাপড়েনের কারণে দশঘরায় তাকে সপরিবারে চলে যাওয়ার অনুরোধে সে যাওয়ার জন্য মনস্থ করে। এজন্য স্ত্রীর সাথে আলোচনাও করে। সে মনে করে সেখানে গেলে সংসারটা যদি একটু ভালো চলে।

✍ উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহরের এই মানসিকতার বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে রাহেলা সপরিবারে আশ্রয় লাভের প্রস্তাব পেয়েও তা গ্রহণ করে না। নেশাগ্রস্ত স্বামী আর অন্যের বশবর্তী হয়ে না থাকার বাসনা তাকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। রাহেলা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও গল্পে হরিহর দশঘরায় প্রস্তাব বিবেচনায় রাখে। সে পরে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবে বলেছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় উদ্দীপকের রাহেলা এবং ‘আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের হরিহরের মানসিকতার অমিল রয়েছে।

ঘ. উদ্দীপকের রাহেলা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে এবং গল্পের হরিহর সরাসরি সিদ্ধান্ত না জানিয়ে আত্মসম্মান ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে হরিহরকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখা যায়। কেননা হরিহর অভাব-অনটনের মধ্যে থাকলেও নিজের আত্মসম্মান ঠিক রেখে কাজ করেছে। সে দশঘরায় পাওয়া প্রস্তাবে তখনি রাজি হলে প্রস্তাবকারী তাকে ছোটলোক ভাববে মনে করেছে। আবার এলাকার পাওনাদারদের কথাও সে বিবেচনা করেছে। এতে হরিহরের মাঝে আত্মসম্মান ও বিবেচনাবোধ প্রবল বলে প্রতীয়মান হয়।

✍ উদ্দীপকের রাহেলার মাঝেও প্রবল আত্মসম্মানবোধ প্রকাশ পেয়েছে। সে অন্যের বশবর্তী হয়ে বাঁচাকে নিজের আত্মসম্মানের পরিপন্থী মনে করেছে। তাই গৃহকর্ত্রীর প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আশ্রয় নিলে স্বামীর কর্মকাণ্ডের কারণে নিজেকে অপদস্থ হতে হবে বলে সে মনে করেছে। রাহেলার এ ধরনের চিন্তা-চেতনা তার প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ এবং বিবেচনাবোধের পরিচায়ক।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের হরিহর এবং উদ্দীপকের রাহেলার চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় তারা সমাজে নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য চেষ্টা করেছে। হরিহর যেমন দশঘরায় নিজের আত্মসম্মানের কারণে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি, তেমনি উদ্দীপকের রাহেলাও আত্মসম্মানের কারণেই গৃহকর্ত্রীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। সংসারে অভাব থাকা সত্তে¡ও তারা সম্পদের লোভের কাছে নিজেদের বিলিয়ে দেয় নি, নিজের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের মানসিকতা তাদের সুবিবেচক এবং আত্মসম্মানবোধের অধিকারী হিসেবে পরিচিত করেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি যথার্থ।

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer
৫নং সৃজনশীল প্রশ্নঃ

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর দাওঃ
শহরের বুকে বিশাল এক বাড়িতে রানু ও রানাদের বসবাস। সারা দিন এঘর ওঘর আর বাড়ির সামনের বাগানে ছোটাছুটি করে তারা। রানু ও রানার মা আফরোজা বানু ওদের সব আবদার পূরণের জন্য সচেষ্ট থাকেন। মাঝে মাঝে ওদের দুষ্টুমি দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। দুষ্টুমি করতে গিয়ে ওরা না আবার হাত-পা ভেঙে বসে।
ক.   বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কত সালে জন্মগ্রহণ করেন? ১
খ. “ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই”- সর্বজয়া কেন এ কথা বলেছে? ২
গ. উদ্দীপকের আফরোজা বানু কোন দিক থেকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সর্বজয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করো। ৩ 
ঘ. উদ্দীপকের চিত্রটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সমগ্রভাব ধারণ করে কি? বিশ্লেষণী মতামত দাও। ৪

৫নং সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরঃ
ক. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

খ. দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হওয়ায় ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সর্বজয়া এ উক্তিটি করেছে।

✍ গল্পের হরিহর অন্নদা রায়ের বাড়িতে গোমস্তার কাজ করে মাসে আট টাকা মাইনে পায়। তাতে তার সংসার চলে না। ধার-দেনা হয়েছে প্রচুর। সেজ ঠাকরুণ, রাধা বোষ্টমের বৌ পাওনা আদায়ের জন্য যেন ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার কাপড়ে দু-তিন জায়গায় সেলাই। মনের দুঃখে সর্বজয়া তাই বলেছিল- আমার এমন হয়েছে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই’।

গ. উদ্দীপকের আফরোজা বানু আপত্যস্নেহের অনিবার্য আকর্ষণের দিক থেকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সর্বজয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

✍ সন্তানের প্রতি ভালোবাসা সব মায়ের মাঝেই একটি আলাদা ভাব ধারণ করে। সন্তানের সুখে হাসা, সন্তানের কষ্টে কাঁদা, সর্বদা সন্তানের চিন্তায় উদ্বিগ্ন থাকা বাংলার মায়েদের একটি শাশ্বত বৈশিষ্ট্য। ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে সর্বজয়ার মাঝে সন্তানবাৎসল্যের এই চিরাচরিত রূপটিই ফুটে উঠেছে।

✍ উদ্দীপকের আফরোজা বানুর মাঝে গল্পের সর্বজয়ার মতো শাশ্বত মায়ের রূপটিই প্রতীয়মান। আফরোজা বানু নিজের সন্তানদের নিয়ে সকল সময় চিন্তিত থাকেন। এর মাধ্যমে সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সর্বজয়ার মাঝে আফরোজা বানুর মতো সন্তানবাৎসাল্য প্রকাশ পেয়েছে। সে সন্তানদের চঞ্চলতায় উদ্বিগ্ন হয়েছে, সন্তানদের চাহিদা পূরণে ব্যাকুল হয়েছে। তাই বলা যায়, আফরোজা বানু সন্তানবাৎসল্যের দিক থেকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সর্বজয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

ঘ. উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মতো প্রকৃতিঘনিষ্ট দারিদ্র্যক্লিষ্ট শিশুর দিকটি প্রকাশ না পাওয়া তা গল্পের সমগ্র ভাব ধারণ করে না।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে হতদরিদ্র পরিবারে দুটি শিশুর আনন্দিত জীবনের আখ্যান রচিত হয়েছে। গল্পে দুর্গা ও অপুর শৈশব জীবনে দারিদ্র্যের কষ্ট প্রধান হয়ে ওঠেনি। তাদের ফলফলাদি আহারের আনন্দ এবং বিচিত্র বিষয় নিয়ে কৌতূহল গল্পটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সর্বোপরি গল্পটি মানুষের চিরাচরিত শৈশবকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

✍ উদ্দীপকে দুটি শিশুর শৈশবের চাঞ্চল্য এবং তাদের জন্য মায়ের ভালোবাসার দিকটি বর্ণিত হয়েছে। কিছুটা মিল থাকলেও এটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সামগ্রিক আবেদনকে ধারণ করে না। কেননা উদ্দীপকে শহুরে জীবনের বিলাসিতার মাঝে বেড়ে ওঠা শিশুর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু গল্পে তা নেই। ফলে এক্ষেত্রে গল্পের সাথে উদ্দীপকের বৈসাদৃশ্য ফুটে ওঠে।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পে গ্রামীণ প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুটি শিশুর কথা বর্ণিত হলেও উদ্দীপকে শহুরে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত শিশুদের কথা বলা হয়েছে। গল্পে দুর্গা ও অপু গ্রামীণ ফলফলাদি আহারের আনন্দ উপভোগ করলেও উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত। তাছাড়া উদ্দীপকে আফরোজা বানু সন্তানদের সব চাহিদা পূরণ করতে পারলেও গল্পের সর্বজয়া তা পারেনি। তাই বলা যায়, উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের সমগ্র ভাব ধারণ করে না।

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও উত্তরঃ
১. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
  উত্তর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় চব্বিশ পরগণার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
  
২. শরৎচন্দ্রের পরে কে বেশি জনপ্রিয় কথাশিল্পী?
  উত্তর: শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি জনপ্রিয় কথাশিল্পী।
  
৩. ‘পথের পাঁচালী’ কার লেখা উপন্যাস?
  উত্তর: ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস।
  
৪. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কত সালে মৃত্যুবরণ করেন?
  উত্তর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
  
৫. ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের দুর্গার বয়স কত?
  উত্তর: ‘আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের দুর্গার বয়স দশ-এগারো বছর।
  
৬. তেল আর নুন দিয়ে দুর্গা কী করবে?
  উত্তর: তেল আর নুন দিয়ে দুর্গা আমের কুসি জারাবে।
  
৭. দুর্গাদের বাড়ির চারপাশেই কী?
  উত্তর: দুর্গাদের বাড়ির চারপাশেই জঙ্গল।
  
৮. হরিহর রায়ের জ্ঞাতি- ভ্রাতা কে?
  উত্তর: হরিহর রায়ের জ্ঞাতি ভ্রাতা নীলমণি রায়।
  
৯. দুর্গার মায়ের নাম কী?
  উত্তর: দুর্গার মায়ের নাম সর্বজয়া।
  
১০. দুর্গা অপুকে মুখ মুছে ফেলতে বলল কেন?
  উত্তর: দুর্গা অপুকে মুখ মুছে ফেলতে বলল কারণ তার মুখে নুন লেগে ছিল।
  
১১. সকাল থেকে ক্ষার কেচে গা-গতর ব্যথা হয়েছিল কার?
  উত্তর: সকাল থেকে ক্ষার কেচে গা-গতর ব্যথা হয়েছিল সর্বজয়ার।
  
১২. হরিহর কখন বাড়ি ফিরল?
  উত্তর: হরিহর দুপুরের কিছু পরে বাড়ি ফিরল।
  
১৩. হরিহরের মতে আজকাল চাষাদের ঘরে কী বাঁধা?
  উত্তর: হরিহরের মতে আজকাল চাষাদের ঘরে লক্ষী বাঁধা।
  
১৪. দুর্গা পা টিপে টিপে এসে কোথায় দাঁড়াল?
  উত্তর: দুর্গা পা টিপে টিপে এসে কাঁঠালতলায় দাঁড়াল।
  
১৫. কালমেঘ কী?
  উত্তর: কালমেঘ যকৃতের রোগে উপকারী এক প্রকার তিক্ত স্বাদের গাছ।
  
১৬. কে দু’বেলা সর্বজয়াকে পাওনার জন্য তাগাদা দেয়?
  উত্তর: রাধা বোষ্টমের বৌ দু’বেলা সর্বজয়াকে পাওনার জন্য তাগাদা দেয়।
  
১৭. ‘আম-আঁটির ভেঁপু গল্পে কে নিরীহ মুখে বাড়িতে ঢুকল?
  উত্তর: ‘আম-আঁটির ভেঁপু গল্পে দুর্গা নিরীহ মুখে বাড়িতে ঢুকল।

৯ম-১০ম শ্রেণির
বাংলা ১ম পত্র গাইড
আম-আঁটির ভেঁপু
গল্প
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
SSC Bangla 1st Paper
Am Atir Vepu
Golpo
Srijonshil
Question-Answer

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তরঃ
১. সব ব্যাটা এসে বলবে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেবো না- হরিহর কেন বলেছিল?
  উত্তর: ঋণের দায়ে জর্জরিত হরিহর পাওনাদারদের বিষয়ে এ কথা বলেছিল।

✍ হরিহরের কাছে বামুন হিসেবে মন্তর নেওয়ার প্রস্তাব দেয় ভিন গাঁয়ের এক লোক। গাঁয়ে একঘর বামুন বসবাস করানোর জন্য তারা জায়গা জমি দিতেও প্রস্তুত। এই প্রস্তাব নিয়ে হরিহর ও সর্বজয়ার মধ্যে কথা হচ্ছিল। সর্বজয়া এই সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্য হরিহরকে তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু ঋণগ্রস্ত হরিহরের দায় শোধ না করে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জো ছিল না। তখন সর্বজয়াকে হরিহর প্রশ্নোক্ত কথাটি বলছিল।

২. “আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইল-” কেন?
  উত্তর: অভাব-অনটনহীন জীবনের সম্ভাবনার কথা শুনে আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো।

✍ সর্বজয়ার পরিবার হতদরিদ্র। দু-বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতেই তাদের প্রাণপণ কষ্ট করতে হয়। এর ওপর রয়েছে পাওনাদারদের তাগাদা। এমন সঙ্গীন অবস্থায় ভিন গাঁয়ে জায়গা-জমি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা সর্বজয়াকে শোনায় তার স্বামী। সর্বজয়া স্বপ্ন দেখে তার দুঃখের দিন এর মাধ্যমে শেষ হবে। তাই আনন্দে, উত্তেজনায় ভাষা হারিয়ে ফেলে সে।

৩. দুর্গা অপুর পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল কেন?
  উত্তর: আম খাওয়ার কথা ভুলক্রমে মাকে বলে দেওয়ায় দুর্গা অপুর পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল।

✍ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের বর্ণিত দুর্গা কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচা আম তার ভাই অপুকে সাথে নিয়ে খেয়েছে। কিন্তু এই আম খাওয়ার ঘটনা সে মাকে জানতে দিতে চায়নি। কেননা মা যদি জানতে পারে যে দুর্গা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে আম কুড়িয়ে এনেছে তাহলে বকাবকি করবে। কিন্তু অপু অসাবধানতাবশত আম খাওয়ার কথা মাকে বলে ফেলে। তাই পরবর্তীতে দুর্গা মৃদু শাসনের ছলে ভাইয়ের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দেয়।

৪. দশঘরার লোকটি হরিহরকে জায়গা-জমি দেওয়ার প্রস্তাব করে কেন?
  উত্তর: গ্রামে একঘর বামুন বাস করানোর আকাক্সক্ষায় দশঘরার লোকটি হরিহরকে জায়গা-জামি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।

✍ দশঘরার লোকটি জাতে সদগোপ, তাদের গাঁয়ে কোনো ব্রাহ্মণের বাস নেই। তার ইচ্ছা জায়গা-জমি দিয়ে গাঁয়ে অন্তত একঘর ব্রাহ্মণকে স্থান দেবে। এতে গাঁয়ের মান মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া হরিহর ব্রাহ্মণ পুরোহিত হওয়ায় তার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে নিজেরাও জাতে উঠতে পারবে। এ সকল কারণেই লোকটি হরিহরকে এমন লোভনীয় প্রস্তাব দেয়।
Share:

Write a letter to attend the marriage ceremony of your elder sister

Letter writing for jsc, ssc, hsc exam preparation
Suppose you are Kamal and Jamal is your friend living in Jessore. The marriage ceremony of your elder sister will be held on the 17th August, 2024.  Now write a letter to your friend inviting him to attend the marriage ceremony of your elder sister. 

My dear Jamal,
I hope you are keeping sound mind in a sound body by the grace of Almighty/Almighty Allah. You will be very glad to know that the marriage ceremony of my elder sister Ruma will be held on the 17th August, 2024 at our house.

I shall be very glad if you join us. My parents hope your company. Please join us minimum two days before the ceremony. Please bring your camera with you.

No more today. Please convey my best regards to your parents and love to the younger.

With best love to you.

Yours ever
Kamal

Envelop

Stamp

From,

Name: XXXXXX

Address: YYYYYY

Phone: ZZZZZZ

To,

Name: FFFFFFF

Address: GGGGGG

Phone: HHHHHH

Share:

A dialogue about the necessity of reading newspaper

A dialogue about the necessity of reading newspaper
The necessity of reading newspaper is the vast. How, write a dialogue between yourself and Raisa about the necessity of leading newspaper.

A dialogue between myself and my friend Raisa about the necessity of reading newspaper:

Myself : Hi, Raisa! How are you?

Raisa : I'm pretty well and you?

Myself : I'm also fine. Well. Raisa, what is your idea about the necessity of reading newspaper?

Raisa : I think it is indispensable for a modern man to read newspaper daily. It can help us in various ways, can't it?

Myself : Yes, we get various types of news in newspaper; for instance, current affairs, trade and commerce, literature, games and sports, etc.

Raisa : You're right. To adjust with-modern civilization we have ho other substitute than reading newspaper.

Myself : But you should bear in mind that sometimes false news leads to many mishaps.

Raisa : Of course. But there is nothing with unmixed blessing in this world and so we must be aware of it so that we might not influenced by any false or biased news or reports. However, reading newspaper is essential Tor all and it's true.

Myself : Thank you. See you again. Goodbye.

Raisa : Goodbye.
Share:

A dialogue between a salesman and a customer

A dialogue between a salesman and a customer

You are Dipu/Dipa. You are at a shop to buy a pair of shoes. Write a dialogue between you and the salesman of the shop about it.

A dialogue between myself (Dipu) and the salesman while buying a pair of shoes:
Salesman : Hello, sir, how I can help you?

Myself : I want a pair of good shoes.

Salesman : Lower price or high price?

Myself : Medium, please.

Salesman : Please have a look at this corner. You can see all kinds of shoes.

Myself : Thank you. Would you please show me the 3rd one?

Salesman : Of course. Here it is.

Myself : How nice! What's the price?

Salesman : Two thousand and fifty taka.

Myself : That's too much.

Salesman : Not at all. It's made of genuine leather.

Myself : But I want a cheaper one. Don't you have one? 

Salesman : Why not? Look at this side. These are Japanese. 

Myself : How much is the fourth one?

Salesman : All these in this row have the same price and it's 2 thousand taka each.

Myself : How about the quality?

Salesman : Don. t worry. These are originally from Japan.

Myself : Ah right. Pack this one.

Salesman : Okay. Thank you. Visit again, please.

Share:

A dialogue between a doctor and a patient

Suppose, you are Rina and you have been suffering from fever for a week. Now, you are at the chamber of a doctor. Write a dialogue between you and the doctor.
A dialogue between a doctor and a patient
A dialogue between myself (Rina) and a doctor:
Rina : Good morning, doctor! Can you spare me a few minutes?

Doctor : Certainly! Come and sit down. Now, what is the problem with you?

Rina : I have been suffering from fever for a week.

Doctor : Do you have headache?

Rina : Oh, yes.

Doctor : Let me feel your pulse and measure your temperature.

Rina : Oh, sure.

Doctor : Don’t worry about your fever. It's nothing serious. This seems to be viral fever. However, I am prescribing some medicine and hopefully you will come round soon.

Rina : Thank you.

Doctor : Let me know how you get on. Thanks.

Rina : Oh, sure.

Share:

বাংলা গল্প 'মানুষ' -মুনীর চৌধুরী

[লেখক-পরিচিতিঃ বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম রূপকার মুনীর চৌধুরী ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর পিতার কর্মস্থল মানিকগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, অসাধারণ বক্তা, সৃজনশীল নাট্যকার, তীক্ষধী সমালোচক ও সফল অনুবাদক। সাহিত্য ও ধ্বনিতত্ত্বের গবেষণা ও তুলনামূলক সমালোচনায় তিনি রেখে গেছেন। অনন্য পাণ্ডিত্য ও উৎকর্ষের ছাপ। মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশের আধুনিক নাটক ও নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। তাঁর নাটক মনন ও নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা অসাধারণ নাটক ‘কবর’ তিনি রচনা করেছিলেন জেলখানায় বসে। তার অন্যান্য মৌলিক নাটক হচ্ছে: রক্তাক্ত প্রান্তর', “চিঠি’, ‘দণ্ডারণ্য', 'পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য। তার অনুবাদ নাটকের মধ্যে রয়েছে: 'কেউ কিছু বলতে পারে না’, ‘রূপার কৌটা', ‘মুখরা রমণী বশীকরণ। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ও সমালোচনামূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘মীর-মানস’, ‘তুলনামূলক সমালোচনা', 'বাংলা গদ্যরীতি ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মাত্র ৪৬ বছর বয়সে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালদের হাতে তিনি অপহৃত ও পরে নিহত হন।]

নাটকঃ
মানুষ

চরিত্রঃ
বাবা
আম্মা
ফরিদ
শিশু
জুলেখা
লোকটা এবং একজন।

বড় শোবার ঘর। ডানদিকে একটা খাট একটু কোনাকুনি করে রাখা। মশারি ওঠানো। বামে মাঝারি রকমের টেবিল, তাতে শেড দেয়া ল্যাম্প, পাশে টেলিফোন। দু-একটা অতিরিক্ত বসবার জায়গা। একদিকে গোসলখানার দরজা, অন্য পাশে গরাদহীন কাচের বড় জানালা। পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় দূরে, বহু কণ্ঠের মিলিত ধ্বনি বন্দে মাতরম। এবং একটু কাছে প্রচণ্ড আল্লাহু আকবর রব! এই দুই চিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাঝে মাঝে দেখা দেবে, বন্ধ জানালার কাচের মধ্য দিয়ে দূরে লকলকে আগুনের শিখা, নীল আকাশকে রক্তিমাভ করে কাঁপছে।

ঘরের মধ্যে চারজন লোক ও একজন অসুস্থ শিশু। খাটের ওপর বর্ষীয়সী আম্মাজান আধশোয়া অবস্থায় শিশুকে আস্তে আস্তে বাতাস করছেন। আবছা আলোতে আম্মাজানের ক্লান্ত উদ্বিগ্ন মুখ এক অদ্ভুত বিষাদ-ভরা গাম্ভীর্যে স্তব্ধ। শিশুর অন্য পাশে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কিশোরী জুলেখা। মাথার ওড়নার এক অংশ ঝুলে মাটিতে পড়ে গেছে, ঘামে কপালের গুড়ো চুল গালে গলায় লেপ্টে আছে। অসহনীয় আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ভয়ার্ত অর্থহীন চাহনি। টেবিলের সামনে খাটের দিক পেছন ফিরে, কোমরের পেছনে দুহাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছেন আব্বাজান।

মানুষ - মুনীর চৌধুরী | Manush - Munir Chowdhuri
লেখকঃ মুনীর চৌধুরী

নিশ্চল নীরব। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেবিলের ল্যাম্পের সহস্র আলোকরশ্মির কেন্দ্রস্থলে। যেন ভেতরের কোনো অশান্তি বিক্ষুব্ধ হিংস্র অন্তর্দ্বন্দ্বকে নিষ্পেষিত করে তবে তিনি সুস্থরূপ ধারণ করবেন। টেবিল ল্যাম্পের সংকীর্ণ আলো-পরিসীমার মধ্যে ফাপানো সাদা দাড়ি আর কপালের গভীর রেখা জ্বলজ্বল করছে। দ্বিতীয় ছেলে ফরিদ নিশাচর কোনো পশুর মতো সন্তর্পণে সামনে পায়চারি করছে। থমকে দাঁড়াচ্ছে। চোখে মুখে প্রতিহিংসার ছায়াবাজি।। দূরে ধ্বনি উঠল বন্দে মাতরম, তিনবার। হাজার কণ্ঠের আকাশ কাপানো হুংকার। তারপরই, তীব্র অন্ধকার আকাশ ছিন্নভিন্ন করে পাল্টা আহ্বান, আল্লাহু আকবর! কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ।

আব্বাঃ আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর।

জুলেখাঃ আব্বাজান! আব্বাজান!

আব্বাঃ কী! ভয় পেয়েছিস, না! ভীরু কোথাকার! ইমানের ডাক শুনে আঁৎকে উঠেছিস? চুপ। কাদিস না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শোন আবার। আল্লাহু আকবর। আল্লাহু আকবর। বল, ভয় লাগে এখনো!

জুলেখাঃ না।

আব্বাঃ ভেবেছিলি আমি পাগল হয়ে গেছি, না? কেন? জীবনে অনেক লোককে মরতে দেখেছি, চোখের সামনে। শ্বাস বন্ধ হয়ে, চোখ উল্টে দিয়ে, জিব বার করে, গলগল করে রক্ত বমি করে কত সুস্থ মানুষকে মরতে দেখেছি। কই কোনোদিন তো উন্মাদ হয়ে যাইনি।

আম্মাঃ (ফরিদকে) হাসপাতালে আরেকবার ফোন করে দেখবি?

ফরিদঃ লাভ নেই। ওরা মোর্শেদ ভাইয়ের বর্ণনা টুকে রেখেছে। কোনো সংবাদ পেলে আমাদের ফোন করে জানাবে বলেছে।

জুলেখাঃ মোর্শেদ ভাই আমার জন্য বই কিনতে বেরিয়েছিল। মোর্শেদ ভাইকে আমি কেন যেতে বললাম।

আব্বাঃ চুপ, চুপ নালায়েক মেয়ে! আদরের দেমাক করিস না অত। তুই, তুই কে? মোর্শেদকে বাইরে পাঠাবার না পাঠাবার তুই কে? যিনি পাঠাবার তিনিই পাঠিয়েছেন। মালাউনের ছুরির খোঁচায় মরণ, ওর
তকদিরে লেখা ছিল এমনি মওত! আজ হবে জানলেই যেন তুই সব রাখতে পারতি!

ফরিদঃ আব্বা!

আব্বাঃ কী, তোমারও ভয় হচ্ছে, আমি উন্মাদ হয়ে গেছি! আমি ভুলে গেছি বাপ হয়ে মেয়ের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়।

ফরিদঃ হাসপাতাল থেকে ওরা এখনও কোনো খবর দেয় নি, আপনি মিছেমিছি ওসব কথা কেন ভাবছেন?

আব্বাঃ হাসপাতাল! ওরা তোমার ভাইকে ছুরি মেরে কোলে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে, না? ওগো শুনেছ, তোমার ছেলের কথা? আমি জানি মোর্শেদকে এতক্ষণে ওরা কী করেছে। আমি জানি।

ফরিদঃ আব্বাজান, আপনি আর কথা বলবেন না। চুপ করে শুয়ে পড়ুন।

আব্বাঃ চুপ করে শুয়ে থাকব? কেন? ওরা আমার ছেলেকে কেটে, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, শরীর থেকে গলা কেটে মাথাটা আলাদা করে ফেলেছে। মোর্শেদের কালো কোকড়া চুল চাক-বাঁধা রক্তের দলার
সঙ্গে লেপ্টে ওর গাঢ় মরা চোখ ঢেকে রেখেছে।

জুলেখাঃ ভাইয়া, আব্বাকে চুপ করতে বল।

আব্বাঃ কে, কে আমাকে চুপ করাবে? তোরা মরে গেছিস। তোরা চুপ করে থাক। তোরা ওর ভাই নয়, বোন নয়। তোরা ওর কেউ নস। তাই তোরা চুপ করে আছিস। আমি ওর বাপ-

আম্মাঃ জুলেখা!

জুলেখাঃ আম্মা।

আব্বাঃ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, ওরা ওর কাটা মুণ্ডুকে কাঁসার থালায় সাজিয়ে ফেরি করে
বেড়াচ্ছে, ওরা সবাই তাই দেখে বাহবা দিচ্ছে-ফুর্তির খাতিরে মুঠো মুঠো টাকা-পয়সা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমার ছেলের নরম সাদা গলাকাটা লাশের-

আম্মাঃ খো দা আ!

আব্বাঃ কে, কে খোদাকে ডাকল?

ফরিদঃ আম্মা, আম্মা, কথা বলছ না কেন? খোকার দিকে আঙুল দিয়ে কী দেখাচ্ছ?

জুলেখাঃ ভাইয়া, খোকা যেন কেমন হয়ে গেছে। নড়ছে না। মুখের শিরাগুলো কী রকম নীল হয়ে ফুটে উঠেছে।

আব্বাঃ দেখি, দেখি। আমায় দেখতে দাও। জুলি অমন ঝুঁকে পড়ে রইলি কেন! পানি, একটু পানি নিয়ে আয়।
(জুলি গ্লাস থেকে চামচে পানি ঢালে)। ফরিদ, তুমি একবার হাসপাতালে, ডাক্তার যে-কোনো ডাক্তারকে একবার খবর দাও। যত টাকা লাগে দেবো, সে যেন দেরি না করে সোজা এখানে চলে আসে।

ফরিদঃ তাতে কোনো ফল হবে না আব্বা। আরও দুবার ফোন করেছি, এই দাঙ্গার ভেতর জীবন বিপন্ন করে কোনো ডাক্তার আসতে রাজি নয়।

আব্বাঃ কেউ আসবে না? কেউ নয়? সবার জীবনের মূল্য আছে, শুধু আমার ছেলেটার নেই?

জুলেখাঃ আব্বা, খোকা পানি খাচ্ছে না। ঠোটের দুপাশ দিয়ে সব গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।

ফরিদঃ আব্বা আমি যাই।

আব্বাঃ কোথায়?

ফরিদঃ ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি।

আব্বাঃ না না। তুই যেতে পারবি না। তুই আমার চোখের সামনে থাকবি। কোথাও যাবি না। আমি বুঝেছি
ওরা আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়। আমার পাজরের হাড় একটা একটা করে খুলে নিয়ে আমাকে যন্ত্রণায় উন্মাদ করে মেরে ফেলতে চায়। আমি দেবো না। আমি তোমাদের কাউকে হারাব না। বুনো চিতার মত ওরা নিঃশব্দে ওত পেতে ছিল। আমার মোর্শেদ, অসহায়, নির্দোষ, শক্তিহীন-
(টিনের দরজায় ঘা পড়ে)
কে, কে, দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে? তাহলে মোর্শেদকে ওরা মেরে ফেলতে পারে নি! মোর্শেদ ফিরে এসেছে, আমার মোর্শেদ বেঁচে আছে, সে আমায় ডাকছে। তোমরা কেউ ওকে, মোর্শেদ, মোর্শেদ-
(দরজায় আরও জোরে আঘাত)

ফরিদঃ আপনি অত উত্তেজিত হবেন না। স্থির হয়ে বসুন। আমি দরজা খুলে দেখছি কে এসেছে। জুলেখা তুই আব্বার কাছে এসে বোস। আমি এক্ষুণি দেখে আসছি।
(প্রস্থান)

আব্বাঃ জানিস জুলি, খোদার রহমত আছে আমার ওপর। এখনি দেখবি মোর্শেদ ছুটে ওপরে আসবে। ওর হাসির শব্দে এ ঘর কলকল করে উঠবে। খোকার অসুখ ভালো হয়ে যাবে, সমস্ত পৃথিবী শান্ত সুন্দর হয়ে চারদিক আলোকিত করে রাখবে।
(ফরিদের প্রবেশ)
ওকি, তুই একলা কেন? মোর্শেদ, মোর্শেদ কোথায়?

ফরিদঃ মোর্শেদ ভাই নয়, পাড়ারই একটি লোক এসেছিল খবর দেয়ার জন্য। আমাদের এলাকায় একটা হিন্দু গুণ্ডা নাকি টুকেছে, সাবধানে থাকতে বলল। একটু আগে বশির উকিলের ছাদে কে ওকে দেখেছে।
অন্ধকারে ছাদ টপকে কোথায় পালাল কেউ ঠিক ঠাহর করতে পারল না।

আব্বাঃ বশির উকিলের বাড়ির ছাদে?

ফরিদঃ হ্যা। আমি বাইরে যাচ্ছি। দলবল নিয়ে সবাই খুঁজতে বার হবে। আমিও যাচ্ছি।

আব্বাঃ তুই যাবি?

ফরিদঃ চুপ করে বসে থাকব? আমি যাচ্ছি। (ড্রয়ারে হাত দেয়) পিস্তলটা রইল। হাতের কাছে রাখবেন। আমি এই ছোরাটা সঙ্গে নিয়ে গেলাম।

জুলেখাঃ ভাইয়া, তুমি যেও না।

আব্বাঃ ছোরা? ছোরা কেন? ছোরা দিয়ে তুই কী করবি?

ফরিদঃ আমার ভাইয়ের কাটা মাথা যারা ফেরি করে বেড়াতে পারে তাদের বিরুদ্ধে ছোরা তুলতে আপনি আমায় নিষেধ করেন আব্বাজান? দুধের কচি শিশুকে যারা হত্যা করতে হাতিয়ার তুলে ধরেছে, সে সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে ছোরা হাতে নিয়েছে বলে আপনি শিউরে উঠলেন? আপনার সম্রান্ত বনেদি রুচিকে কদমবুছি। আমি যাই, দোয়া করবেন।
(প্রস্থান)
(আব্বাজান নিশ্চল। জুলেখা আব্বাজানকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আম্মা খোকাকে বাতাস করছেন। হঠাৎ যন্ত্রণাকাতর শিশুর কণ্ঠরুদ্ধ আর্তনাদ।)

জুলেখাঃ আম্মা, আম্মা, খোকা অমন ছটফট করছে কেন? খোকার কী হয়েছে আম্মাজান?

আব্বাঃ আমি অনেক গুনাহ করেছি খোদা, আমায় শাস্তি দাও, শাস্তি দাও। যত খুশি যন্ত্রণা আমায় দাও আমি কোনো নালিশ জানাবো না। মোর্শেদ যদি তোমার কাছে কোনো দোষ করে থাকে, তাকে শাস্তি দাও, আমি মাথা পেতে নেবো, একটু প্রতিবাদ জানাবো না। কিন্তু ঐ কচি শিশু নিস্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, মায়ের কোল থেকে এখনও পৃথিবীতে নাবে নি, ও তো কোনো অপরাধ করে নি, তুমি কোন ইনসাফে ওকে শ্বাস বন্ধ করে মারতে চাও? ওকে মুক্তি দাও, শান্তি দাও, রেহাই দাও-বাঁচাও, বাঁচাও, ওকে তুমি বাচাও খোদা!
(দুহাতে মুখ গুঁজে টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। আম্মাজান নিশ্চল। জুলেখা ফুপিয়ে কাঁদে। হঠাৎ পেছনের কাচের জানালার ওপর, বাইরে থেকে কোনো ভারি জিনিসের কয়েকটা আঘাত পড়ে। একটা কাচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল।)

আব্বাঃ কে? (হাত দিয়ে পিস্তল চেপে ধরেন)
(ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে ছিটকিনি খুলে, জানালা টপকে ঘরে প্রবেশ করে এক যুবক। শেড দেয়া টেবিল ল্যাম্পের স্বল্পালোকে দেখা গেল লোকটার হাতে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ, গায়ে ঢোলা পাঞ্জাবি, পরনে ধূতি।)

আব্বাঃ (কাঁপা হাতে পিস্তল তুলে) কে, কে তুমি?

লোকটাঃ আমি-মানুষ?

আব্বাঃ মানুষ?

লোকটাঃ মানুষ, হিন্দু!

আব্বাঃ বশির উকিলের বাড়ির ছাদে ওরা, তাহলে তোমাকেই দেখেছিল?

লোকটাঃ হয়ত। হঠাৎ দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে ভাবিনি। বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, প্রয়োজনে। গিয়ে আর বেরুতে পারিনি।

আব্বাঃ এখন বেরুলে কোন সাহসে?

লোকটা। আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না। বেরিয়েছি বাধ্য হয়ে। বন্ধুর সাহসে কুলোলো না, আমায় জায়গা দেয়। বন্ধুকে ছেড়ে তাই ছাদ টপকে বেরিয়ে পড়লাম, নিরাপদ জায়গার খোজে।

আব্বাঃ বন্ধুর বাড়ির চেয়ে এটা বেশি নিরাপদ এ আশ্বাস তোমায় কে দিয়েছে।

লোকটাঃ আমি আশ্রয় দাবি করছি না, প্রার্থনা করছি। অন্য উপায় নেই।

আব্বাঃ বাইরে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ কান পেতে শুনলে, এ ভুল তুমি করতে না।

জুলেখাঃ আব্বা, আব্বা, তোমার হাত কাঁপছে। গুলি ছুটে যেতে পারে!

আব্বাঃ (একটু একটু করে এগুতে থাকে) যখন তুমি হয়ত জানালা ভেঙে প্রাণ বাঁচাতে আমার ঘরে ঢুকেছো, ঠিক তখনই হয়ত তোমার কোনো পরম আত্মীয় আমার বড় আদরের ছেলে মোর্শেদকে ছুরির মাথায় গেঁথে নাচাচ্ছে, বিলাসী বেড়াল যেমন অসহায় ইদুরকে নখের আঁচড়ে একটু একটু করে কুরে কুরে মারে। আর আমার খোকা-
(খোকা ও মায়ের আর্তনাদ। বেদনাযুক্ত, ভয়ার্ত।)

লোকটাঃ ওকি? উনি ও-রকম করে বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়লেন কেন?

জুলেখাঃ আব্বা, আব্বা, খোকা জানি কেমন করছে?

লোকটাঃ খোকার কী হয়েছে? অসুখ?

আব্বাঃ হ্যাঁ, অসুখ। মরণ-অসুখ! গত আধ ঘণ্টা থেকে ছটফট করছিল, এখন হয়ত শান্তি লাভ করল।

লোকটাঃ কী করছেন আপনি? দেখি, জায়গা ছাড়ন, পিস্তলটা সরিয়ে একটু পথ দিন। আমি দেখছি।

আব্বাঃ তুমি, তুমি? তুমি কী দেখবে? ওহ্ বুঝেছি, তোমাদের এখনও আঁশ মেটেনি। আমার খোকাকে বুঝি নিজ হাতে নিয়ে যেতে ওরা তোমাকে পাঠিয়েছে।

লোকটাঃ আপনি অপ্রকৃতিস্থ। সরে দাঁড়ান।
(সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে নীরবে এগিয়ে গিয়ে লোকটা খোকার পাশে বসে। হাতের কালো ব্যাগটা খুলে ডাক্তারি সরঞ্জাম বার করে পরীক্ষা করতে থাকে।)।

ভয়ের কোনো কারণ নেই, মা। খুব সময়মত এসে পড়েছি। কণ্ঠনালির উদ্বৃত্ত মাংসপিণ্ড হঠাৎ ফুলে গিয়ে মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ করে দিতে চাইছে। আমি একটা উত্তেজক ওষুধ দিচ্ছি। আর একটা ইনজেকশন দেব। সব এক্ষুনি ভালো হয়ে যাবে। কিছু ভাববেন না।

আব্বাঃ ইনজেকশান?
(লোকটা চামচ দিয়ে ওষুধ খাওয়াবে। স্পিরিট দিয়ে তুলো ভিজিয়ে সূচ সেঁকে নেয়। সংলাপ চলতে
থাকে, কখনও জুলেখা, কখনও আব্বা, কখনও আম্মা লোকটাকে টুকটাক সাহায্য করে)।

লোকটাঃ এই যন্ত্রগুলো দেখে অন্তত আমায় বিশ্বাস করতে পারেন। আমি এখনও পুরোদস্তুর পেশাদার ডাক্তার হইনি। সবেমাত্র পাস করেছি। বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম, রোগী দেখতে। আশা করিনি এক রাতের মধ্যেই দু’জন রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। (ইনজেকশন ঠিক করে নেয়) এখন আর কোনো ভয় নেই মা। দেখবেন ভাইটি আমার এখনই খলখল করে হেসে উঠবে।

আব্বাঃ বাঁচবে, না? কোনো ভয় নেই, না? খোদা, অপরিসীম তোমার করুণা, তুমি এ গুনাহ্গারের ডাক
শুনেছ! অবুঝ শিশুর ওপর কি আর তুমি ইনসাফ না করে পার? তোমার শোকর গুজারি করি!

লোকটাঃ আমায় একটু হাত ধোয়ার সাবান-জল দিতে হবে।

আব্বাঃ এস, আমার সঙ্গে এস। এই দিকে বাথরুমে চল।
(আব্বা ও লোকটার প্রস্থান। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দরজায় দ্রুত করাঘাত ও ফরিদের চিতকার: জুলেখা, জুলেখা!)

জুলেখাঃ আসছি ভাইয়া।

ফরিদঃ (নেপথ্যে), শিগ্‌গির, দরজা খোল শিগগির।

জুলেখাঃ আম্মা, ভাইয়া যদি-

আম্মাঃ কোনো ভয় নেই। তুই দরজা খুলে দে।
(জুলেখা বেরিয়ে যায় ও একটু পরেই উত্তেজিত ফরিদকে নিয়ে প্রবেশ করে)

ফরিদঃ আম্মা, আব্বাজান কোথায় গেলেন?

আম্মাঃ গোসলখানায়। কেন, কী হয়েছে?

ফরিদঃ সে হিন্দুটাকে নাকি আমাদের বাড়ির ছাদের খুব কাছেই কোথাও একবার দেখা গিয়েছিল। সবাই
সন্দেহ করছে, ও নিশ্চয়ই আমাদের বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে।

আম্মাঃ বলে দাও, নেই!

ফরিদঃ ওরা বিশ্বাস করতে চায় না। একেবারে ক্ষেপে উঠেছে। আমার হাতের ছুরি ওদের দেখিয়েছি-কসম কেটে বলেছি, আমি মোর্শেদ ভাইয়ের ছোট ভাই। তার রক্তক্ষরণের জবাব দিতে আমি কসুর করব না।

আম্মাঃ আমার ঘরের জিনিস লণ্ডভণ্ড করে বাইরের লোককে এখানে খানাতল্লাশি চালাতে আমি কখনও অনুমতি দেবো না। বলে দাও, আমরা পাহারা দিচ্ছি, এ বাড়িতে কেউ ঢোকেনি।

ফরিদঃ ওরা নিজেরা না দেখে কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না। ভদ্রলোকের কথা ওরা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। ওদের বাড়ি তল্লাশি করতে না দিলে ওরা গোলমাল বাধাবে। বিপদ ঘটবে। সব বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

আম্মাঃ বেশ। ওদের ডেকে নিয়ে এস। খুঁজে দেখে যাক কাউকে বার করতে পারে কিনা!

ফরিদঃ আপনি তাহলে একবার অন্য ঘরে-

আম্মাঃ না, পর্দা করার জন্য আমি অন্য ঘরে যেতে পারব না। এখানেই থাকব। মশারিটা ফেলে দাও। আমি ভেতরে থাকব। আমি ছোট খোকার কাছে থাকব।

ফরিদঃ (গোসলখানার পথে পা বাড়িয়ে) আমি তাহলে আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।

আম্মাঃ না, না। তুমি বাইরে যাও। একটু পরে ওদের ভেতরে নিয়ে আসবে। আমরা ততক্ষণে ঘরটা গুছিয়ে নিচ্ছি। যত খুশি এসে দেখে যাক, হিন্দু খুঁজে পায় কিনা। জুলেখা তোমার আব্বাকে ডেকে দেবে। তুমি বাইরে যাও।
(বলতে বলতে আম্মা নিরুদ্বেগ চিত্তে মশারি ফেলছেন। গোসলখানার দরজা দিয়ে, লোকটার হাত ধরে, উত্তেজিত ভয়ার্ত আব্বাজানের প্রবেশ।)

আব্বাঃ আমরা সব শুনেছি। এ তুমি কী করলে? কেটে কুচি-কুচি করে ফেলবে। একে আমি এখন কোথায় লুকিয়ে রাখি! কিন্তু, কিন্তু একে আমি রক্ষা করবই। একে আমি মরতে দেবে না। একে বাঁচাব। বাঁচাব হ্যা! এই ধরো আমার পিস্তল মুঠো করে ধরো। যে তোমাকে মারতে চাইবে তাকে মারবার অধিকার তোমারও আছে। না লড়ে মরবে কেন?

আম্মাঃ (ভালো করে চারপাশে মশারি গুঁজে দেয়।) অত উত্তেজিত হয়ো না তুমি। আমি যা করেছি, ঠিকই করেছি।
(হাত দিয়ে নেড়ে টেবিল ল্যাম্পটির শেডটা ঠিক করে নেয়। ডাক্তার, তুমি আমার সঙ্গে এস। এই মশারির মধ্যে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। শেড় দেয়া টেবিল ল্যাম্প এই আলোর জন্য বার থেকে মশারির ভেতরের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাবে না। শরিফ খান্দানের পর্দানশীল মহিলা আমি, মশারির ভেতর থেকে একবার কথা বললেই যথেষ্ট, কেউ মশারি তুলে উঁকি দিয়ে দেখার প্রস্তাব করতে সাহস করবে না।

লোকটাঃ মা?

আম্মাঃ দেরি করো না। ওদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উঠে এস শিগগরি!
(প্রথমে আম্মাজান, পরে লোকটা, মশারির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবে। আব্বা ও জুলেখা বাক্যহীন। ঘরে প্রবেশ করল ফরিদ। অনুসরণ করে আরও কয়েকজন লোক। ঘরে ঢুকেই তারা বিনা ভূমিকায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। এ দরজা দিয়ে যায়, ও দরজা দিয়ে আসে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। কিন্তু সেই শব্দ এই অদ্ভুত পরিস্থিতির মানুষগুলোকে যেন একটু সচকিত করে তুলছে না)।

আম্মাঃ (মশারির ভেতর থেকে তোমরা কেউ ফোনটা ধরছ না কেন? দেখ কে ডাকছে? কী বলছে?
তোমরা ফোনটা ধর, হয়ত কেউ মোর্শেদের কোনো খবর জানাতে চাইছে।

আব্বাঃ ধরছি, আমি ধরছি! হ্যালো, ইয়েস হ্যাঁ বলুন। হ্যাঁ, আমি মোর্শেদের বাবা।
(কী যেন শুনলেন। চোখমুখ হঠাৎ শিটিয়ে পাথরের মূর্তির মত নিথর হয়ে গেল। ফোনটা নামিয়ে রেখে। তেমনি দাড়িয়ে রইলেন। ততক্ষণে পাড়ার লোকেরা গৃহতল্লাশ শেষ করে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে।
যাবার সময়-)

একজনঃ সব ঠিক আছে। কেউ নেই। সালাম সাহেব।
(সকলের প্রস্থান)

জুলেখাঃ -আব্বা! তুমি অমন করে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? আব্বা, কিছু বল। অমন করে চেয়ে থেকো না, আমার ভয় করছে। আব্বাজান, ফোনে কে ডেকিছিল? কী বলল?

আব্বাঃ হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল।

ফরিদঃ জুলি, আমার কাছে আয়। ভয় পাস নে, আব্বাজানকে অমনি থাকতে দে!
(আম্মাজান বেরিয়ে আসেন। মশারি তুলতে থাকেন।)

ফরিদঃ আম্মা! এ কে?

লোকটাঃ আমায় বলছ ভাই? আমি মানুষ। (আম্মাকে) ছোট খোকার আর কোনো ভয় নেই মা। দেখুন খেলতে শুরু করেছে। খোকাকে আমি দেখছি। আপনি (আব্বার দিকে ইঙ্গিত করে) ওঁকে দেখুন। (জুলেখা তখন ফরিদের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কাঁদছে। আব্বাজান তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, চোখে উন্মাদের দৃষ্টি! আম্মাজানের শান্ত কালো চোখ আব্বার মুখের ওপর ন্যস্ত। একটু একটু করে তা পানিতে ভরে উঠেছে। লোকটা ছোট খোকার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে হাত রাখে। মঞ্চ আস্তে আস্তে অন্ধকার হতে থাকে ও ধীরে ধীরে পর্দা নেমে আসে।)
(য ব নি কা)
শব্দার্থ ও টীকাঃ
বন্দে মাতরম - মাকে (দেশমাতাকে) বন্দনা করি। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত দেশাত্মবোধক সংগীতধ্বনি।
আল্লাহু আকবর - আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
বর্ষীয়সী - অতিশয় বৃদ্ধা। পুরুষবাচকরূপ বর্ষীয়ান।
ইমান - শাব্দিক অর্থ বিশ্বাস। আল্লাহর একত্ব ও মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ- এই বিশ্বাসই মূলত একজন মুসলমানের ইমান।
নালায়েক - লায়েক নয় এমন। অপ্রাপ্তবয়স্ক। অনুপযুক্ত। বাচ্চা।
দেমাক - অহংকার। গর্ব।
তকদির - ভাগ্য।
রায়ট - দাঙ্গা। মারামারি। riot
ঠাহর - অনুমান। আন্দাজ।     
বনেদি - প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত।
ইনসাফ - সুবিচার। ন্যায়। ন্যায়বিচার।
অপ্রকৃতিস্থ - মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন।
গুনাহগার - পাপী।
লণ্ডভণ্ড - তছনছ। এলোমেলো। বিপর্যস্ত।

পাঠ-পরিচিতিঃ বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যসাহিত্যের পুরোধা-ব্যক্তিত্ব শহিদ মুনীর চৌধুরীর একাঙ্কিকা “মানুষ” অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল শিল্পরূপ। মানুষের মৌলিক মানবিক চেতনা দয়া-মায়া-মমতা-প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ইত্যাদি যে জাতি-ধর্ম-বর্ণের অনেক ওপরে স্থিত- এই মৌল সত্যটিকে নাট্যকার একটি দাঙ্গা কবলিত শহরে একটি পরিবারের চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে অভিব্যক্তি দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কবলিত শহরে পরিস্থিতির চাপে ও প্রতিক্রিয়ায় ধর্মপ্রবণ মানুষের মনেও কীভাবে ধর্মীয় উন্মত্ততার সৃষ্টি হয় এবং সাময়িকভাবে হলেও মন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার উদাহরণ নাটকের চরিত্র- আব্বা, ফরিদ ও এলাকার লোকজন। অন্যদিকে ধর্মীয় উন্মত্ততার মধ্যেও যে কোনো কোনো মানুষের মন মানবতাবোধ ও শুভবুদ্ধি হারায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নাটকে বর্ণিত আম্মা ও তরুণ ডাক্তারের চরিত্র। নাটকটির পাঠ শেষ হলে পাঠকের মন পূর্ণ হয় অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ধর্মীয় অন্ধ আক্রোশ ছাপিয়ে মানুষের মহিমাই বড় হয়ে উঠেছে একাঙ্কিকাটিতে।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১. আপনি অত উত্তেজিত হবেন না’ —উক্তিটি কার?
ক. আব্বার
খ. আম্মার
গ. ফরিদের
ঘ. জুলেখার 

২. ‘তোরা মরে গেছিস, তোরা চুপ করে থাক। তোরা ওর ভাই নয়, বোন নয়’ -আব্বার এই বিলাপে প্রকাশ পেয়েছে-
i. অসাম্প্রদায়িকতা
ii. পুত্রস্নেহের উন্মত্ততা
iii. সন্তান বাৎসল্য

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

কবিতাংশটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
জানিস নাকি ধর্ম সে যে বৰ্মসম সহনশীল
তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়াছুঁয়ির ছোট্ট টিল!

৩. কবিতাংশে ‘মানুষ’ একাঙ্কিকার যে দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে তা হলো—
i. অসাম্প্রদায়িকতা
ii. ধর্মের উদারতা
iii. উদার মানবিকতা

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

৪. উক্ত ভাবের মধ্য দিয়ে কোন শিক্ষা গ্রহণ করা যায়?
ক. বর্ণবৈষম্য না করা।
খ. মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন করা।
গ. আর্তের সেবা করা।
ঘ. অসহায়কে সাহায্য করা।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারি। আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
ক. ‘মানুষ’ একাঙ্কিকায় কার কোনো ভয় নেই?
খ. আব্বার চোখ মুখ হঠাৎ শিটিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিথর হয়ে গেল”- কেন?
গ. কবিতাংশের শেষ দুই চরণে ‘মানুষ’ একাঙ্কিকার যে ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. উক্ত চেতনাই গড়তে পারে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুখী-সমৃদ্ধ পৃথিবী’- উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।
Share:

বাংলা গল্প 'কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ' -শওকত আলী

[লেখক-পরিচিতিঃ কথাসাহিত্যিক শওকত আলী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খোরশেদ আলী সরদার এবং মায়ের নাম মোসাম্মত সালেমা খাতুন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরে। ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। অভাব অনটনের মধ্যেই চালিয়ে যান নিজের লেখাপড়া। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে এমএ পাস করেন। সাংবাদিকতা, শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন ধরনের পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন।

তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘকাল শিক্ষকতার পর সর্বশেষ তিনি সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জীবনকে নিবিড়ভাবে অবলোকন করা এবং বিচিত্র জীবনপ্রবাহকে শিল্পাবয়ব প্রদান শওকত আলীর সাহিত্যভাবনার মূল প্রবণতা। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রচনায়। তিনি ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে এবং ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হন। শওকত আলীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেঃ ‘পিঙ্গল আকাশ’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন', উত্তরের ক্ষেপ’, লেলিহান সাধ' প্রভৃতি। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ

বাতাস উঠলে এখন টাঙনের পানিতে কাঁপন লাগে না। পানি এখন অনেক নিচে। বালি কেটে কেটে ভারি ধীর স্রোতে এখন শীতের টাঙন বয়ে যায়। পানির তলায় বালি চিকমিক করে, কোথাও কোথাও সবুজ গুল্ম স্রোতের ভেতরে ভাটির দিকে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ ফেরে। চতর দু-একটা মাছ তির তির করে উজানে ছুটে গেলেও আবার ভাটিতে ফিরে আসে।

কিন্তু কাঁপে না পানির স্রোত। এমনকি সঁকোর ওপর দিয়ে চিনি কলের ভারী আখ-বওয়া ট্রাকগুলো যাবার সময়ও না। সাঁকোর থামগুলো গুম গুম শব্দ করে ওঠে, কিন্তু পানির স্রোত তেমনি ধীর, তেমনি শান্ত। আসমান, কান্দর আর দিগন্তজুড়ে যে শীতের একটা শান্ত ভাব থাকবার কথা সেই ভাবটা টাঙনের স্রোতে আজকাল সব সময় ধরা থাকে। আর ঐ শান্ত নদীর ধারে বসে থাকবার জন্যেই কিনা কে জানে কপিলদাস ভারি আরামে রোদের দিকে পিঠ মেলে দিয়ে ঝিমোতে পারে। তার চারদিকে নানা শব্দ কিন্তু সে সব তার কানে ঢোকে কি না বোঝা মুশকিল।
কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ - শওকত আলী  | Kopildas Murmur Sesh Kaj - Showkot Ali
লেখকঃ শওকত আলী
ধরো, কী রকম গা গা চিৎকার করতে করতে চিনি কলের ট্রাকগুলো ছুটছে, ফার্মের ভেতরে বিনোদ মিস্তিরি খান-দুই ট্রাক্টর ট্রায়ালের জন্য চালু করে রেখেছে—তার ধক ধক ধক ধক্ শব্দ একটানা সকাল দুপুর রাত ধরে ক্রমাগত হয়ে চলেছে, নদীর ওপারে আবার কোথায় এক রাখাল সারাদিন ধরে একটা বুনো সুর বাঁশিতে বাজিয়ে যাচ্ছে-এ সবই তার কানে ঢুকবার কথা। কিন্তু কপিলদাস চুপচাপ। মাথাটা ডাইনে-বায়ে অল্প-স্বল্প দুলছে, আর সে বসে রয়েছে তো বসেই রয়েছে।

ওদিকে ছাগল ঢুকে যদি সবজি ক্ষেত তছনছ করে, কি বিন্দা মাঝির বউ সোনামুখী নগেন হোরোর বোন সিলভীর সঙ্গে ঝগড়া বাধায় কিংবা নদীর ওপারে খোলা কান্দরে খরগোশ তাড়িয়ে নিয়ে আসে কোনো ভিন গাঁয়ের কুকুর এবং সেজন্যে যদি এপারের বাচ্চারা লে লে হই হই করেও ওঠে—কপিলদাস নড়বে না, হেলবে না, কান পাতবে না—কাউকে একটা কথা জিজ্ঞেসও করবে না।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

আসলে কপিলদাস বুড়োর কাছে সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো বলে মনে হয়। মনে হয়, এরকমই হয়ে ও আসছে দুনিয়ায়। ঝগড়া বলো, আঁটি বলো, জন্ম বলো, মরণ বললা—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো। কত দেখল সে জীবনে। সব কিছুই শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় গিয়ে মিলে যায়। রাগ বল, ক্ষোভ বল, আবার হাসিখুশি মনের ভাব বল, কিংবা সামনে প্রকাণ্ড কান্দর, কি কান্দরের ওপরকার আসমান, আবার তার নিচে টাঙনের স্রোত—সব কিছু, যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা শোনা যাচ্ছে—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা শেষ পর্যন্ত মেলানো।

আসলে, তার মনে হয়, সংসারের অনেক ভেতরে শান্ত ধীর এবং নিরবচ্ছিন্ন একটা স্রোত আছে। সব কিছুর ওপর দিয়ে ঐ স্রোত বয়ে যায়। সেখানে কাপন নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। সব কিছু সেখানে ক্রমাগত একটার সঙ্গে আরেকটা মিলে যাচ্ছে। ঠিক এই ধরনের একটা গা-ছাড়া পরিতৃপ্ত ভাব আজকাল তাকে প্রায়ই পেয়ে বসে। আর সেজন্যেই শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ভারি আরামে সে ঝিমোতে পারে। বয়স বেড়ে গেলে সম্ভবত মানুষের এরকম একটা অবস্থা এসে যায়। তবে সব সময় ঐ ভাবটা থাকে না। আর তখনই পুরনো ঘটনা ছবির পর ছবি সাজিয়ে নিয়ে আসে চোখের সামনে। পুশনা পরবে কি তুমুল নাচ জুড়েছে দেখো কপিলদাস।

তার গলায় বাঁধা মান্দল কী রকম শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, মেয়েদের গলায় কেমন শানানো স্বর। কপিলদাস দেখতে দেখতে নিজের যৌবনকালে চলে যায়। একের পর এক ঘটনা মনে পড়তে থাকে তার। আর ঐ রকমভাবে স্মৃতি তার সামনে পুরনো পসরা খুলে বসলে সে ভারি সুখে ঐসব পুরনো ঘটনার মধ্যে বিচরণ করে ফেরে। একবার সেই যে কি হলো, মহাজনের ধান খামার বাড়ি থেকেই কিষানদের হাতে বিলিয়ে দিলি-মনে আছে সে কথা? আর মানুয়েল পাদ্রিকে টাঙনের পানিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলি? মনে নাই? চকিতে সে দেখতে পায় বর্ষায় ভরা টাঙনের পানিতে পাদ্রি তলিয়ে গেল।

ঘোলাটে পানির মধ্যে কালো জুতোসুদ্ধ তার পা দুখানি ওপরে উৎক্ষিপ্ত হতে দেখা গেল স্পষ্ট করে। একটু পরই মানুয়েল পাদ্রি আবার ভেসে উঠেছিল। আর সে কি গাল! সাঁতরাতে সাঁতরাতে শাসাচ্ছিল, দেখিস তোর বাপকে বলব, দেখব বিচার হয় কি না। সেই ছেলেবেলার কথা। হাপন ছিল যখন সে। তোর তির কী রকম নিখুঁত নিশানায় গিয়ে বিধত, কপিলদাস মনে নাই সে কথা? হ্যা মনে আছে। কপিলদাস মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজেকে শোনায়—সব মনে আছে। কেন মনে থাকবে না।

সান্তালের বাচ্চা না সে? দেখ তো খরগোশের পেছনে কে ছুটছে অমন? শুকদেবের ব্যাটা চতুর মাঝি নাকি দিবোদাসের ব্যাটা কপিলদাস? আর ঐ দেখ, কপিলদাসের শিকারি কুকুর কী রকম ছুটে যাচ্ছে। তির-খাওয়া শিকারের পেছনে। কপিলদাস মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায় তার কালো রঙের কুকুরটাকে— যেটা তার কিশোরকালের সঙ্গী ছিল সর্বক্ষণ। কুকুরটাকে শেষ পর্যন্ত বাঘে খেল। কপিলদাস একেক দিন আবার নিজের কাছে গল্প ফাঁদে। দূর থেকে দেখা যায় বুড়ো থেকে থেকে মাথা নাড়াচ্ছে আর ঝুঁকে ঝুঁকে দুলছে।

কোন গল্পটা আরম্ভ করবে সে? বাহ্ গল্পের কি আর শেষ আছে—নিজেকেই শোনায় বুড়ো। ধরো, মেলার সেই ঘটনাটা মেলার গল্পটাই হঠাৎ মাঝখান থেকে শুরু হয়ে যায়। কেন যে বেছে বেছে মেলার গল্পটাই শুরু হয়—সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। গল্প আরম্ভ করলেই সে মেলার ঘটনায় চলে আসে। কিংবা ঐ ধান কাটার ব্যাপারটাই ধরো না কেন। আধিয়ার জোতদারের মাঝখানে পড়ে গেল সাঁওতাল বস্তিটা। গুপীনাথ হু হা করে না, ডাইনে-বাঁয়ে তাকায় না।

ওদিকে কে একজন আগুনের কুণ্ডলীর ওপরে আরেক বোঝা নাড়া চাপিয়ে দিয়ে গেল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আর ঐ আগুনের আলোয় গুপীনাথের কপাল চকচক করতে লাগল। কিন্তু সে শাদা চুল ভর্তি মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে তো বসেই আছে। সাঁওতালদের তখন কি মুশকিল ভাবো দেখি। মহাজন বসত করবার জায়গা দেয়, আবাদের জমি দেয়, গিরস্তির কাজ দেয়—সেই মহাজনের বিপক্ষে কেমন করে যায়। মহাজন যে সব দেয়। হ্যা, সব দেয় কিন্তুক পেটের ভাতটা কি সারা বছর দেয়, আঁ? কহ মড়ল, কহ দে, দেয় পেটের ভাতটা? এই রকমের সব বাদানুবাদ।

কিন্তুক যদি ভিটেমাটি থেকে তুলে দেয় তাহলে? এই রকমের সব তর্কাতর্কি। ওদিকে গুপীনাথ কিছুই বলে না। মড়ল হলে বোধ হয় ঐ অবস্থায় কিছু বলা যায় না। কিন্তুক তখন ভারি জাড় হে মড়ল। দেহ দলদল করে কাঁপছে। দূরে দূরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল-হামরা মহাজনের সঙ্গে নাই, আধিয়ার কিষানের সঙ্গে হামরা। কে বলেছিল কথাটা? মনে নেই এখন। সে নিজে হতে পারে, মোহন কিস্কু হতে পারে কিংবা চতুর মাঝিও হতে পারে। লোকটা যে কে ঠিক মনে নেই। কিন্তু কথাটা ঠিক মনে আছে। তারপর? কপিলদাস আর খেই ধরতে পারে না।

বিচার সভার শেষ দৃশ্যটা স্মরণে আসে না। বরং হঠাৎ ধান কাটার দৃশ্যটা মনের ভেতরে দেখতে পায় সে। কপিলদাস মাঠে নেমেছে, পাশের ক্ষেতে মোহন কিস্কুর বউ টরি-সারা কান্দরে আর একটা মানুষ দেখা যায় না। ধান গাছের নোয়ানো পাতায়, শিষের গায়ে, তখনও রাতের হিম ফোটায় ফোটায় জমে আছে। রোদের তাপ গায়ে লাগে কি লাগে না এমনি কুয়াশা। ঐ রকম গল্প বলতে বলতে বেলা ফুরিয়ে যায় এক সময়। রোদের তাপ কমে আসে ঝাপসা চোখ দুটি মেলে সে তখন আসমানের ধূসর রঙ দেখে।

একবার নদীর ভাটি থেকে উঠে আসা শঙ্খচিলের ডাকটাও শুনতে পায়। বাতাসে তখন শীতের কামড়। তার দুহাতের আঙুল ছেড়া কোটের বোতাম দুটি খুঁজতে থাকে। আর ঐ সময়ই তার চোখে পড়ে যায়। দেখে কজন লোক টাঙনের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাচ্ছে। লোকগুলোকে সে চিনতে চেষ্টা করে। ওখানে এই সময়ে কারা? অমন পরিষ্কার জামা-কাপড় পরাকে লোকটা? অনেকক্ষণ ধরে লোকটার নড়া-চড়ার ভঙ্গিটা লক্ষ করে। লক্ষ করতে করতেই মনে পড়ে কদিন আগেও বোধহয় ওদের এইভাবেই দেখেছে সে। ঠিক এইভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন বলাবলি করছিল। সে এক সময় চিনতে পারে।

পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা লোকটা ম্যানেজার মহাজন ছাড়া আর অন্য কেউ হতে পারে না। কিন্তু এমন সময় ওখানে দাড়িয়ে ওদের কি কাজ? একবার মনে হয় জরিপ হচ্ছে বোধ হয়। একেক সময় ঐ রকম জমিজমার মাপামাপি চলে। ওরা কি জমিজমা মাপতে এসেছে? কই এ রকম কোনো খবর তো তার কানে আসেনি। একটু পর আর দেখা যায় না কাউকে। দেখতে না পাওয়ায় কৌতূহলটাও আর থাকে না। কপিলদাস তখন গরুর পালের ঘরে ফেরা ঘুণ্টির আওয়াজ কান পেতে শোনে। ফার্মের গরুগুলোর গলায় নতুন ঘুণ্টি বাধা হয়েছে নিশ্চয়ই।

আজকাল বোধহয় জয়হরির ছোট ছেলেটা ফার্মের গরু চরায়। জয়হরির কী যেন হয়েছিল? জয়হরির কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করে সে। আর ঠিক ঐ সময় কাছে এসে দাঁড়ায় সলিমউদ্দিন। এসেই ডাকে, বুঢ়া দাদা বাড়িত যাবো নাই? হ্যাঁ যামু, সে জয়হরির কথা স্মরণ করতে না পেরে সলিমউদ্দিনের দিকে মনোযোগ দেয়। ছোড়া কোত্থেকে আসছে সেই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। সলিমউদ্দিন তখন কুশিয়ার ক্ষেতে আজ কী কাণ্ডটা ঘটেছে সেই ঘটনার বর্ণনা আরম্ভ করে এবং ঐ আরম্ভের মুখেই সে জানিয়ে দেয়-বুঢ়া দাদা তুমার বস্তিটা আর এইঠে থাকবে নাই, ইবছর এইঠে ধানের আবাদ হবে। কথাটা কেন যে বলে ছোড়া বুড়ো ঠিক ধরতে পারে না।

কিংবা এমনও হতে পারে যে তার বর্ণনাতেই বোধহয় প্রসঙ্গটা থাকে না। কপিলদাসের হঠাৎ খেয়াল হয় লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এখুনি না দেখল! মুহূর্তের মধ্যে কোথায় উবে গেল অতোগুলো মানুষ। নাকি সে দেখে নি! তার কেবলি মতিভ্রম হতে থাকে। ইদিকে সলিমউদ্দিনের সেই খামারবাড়ির ঘটনাটার বর্ণনা তখনো ফুরোয়নি। আবার কথাটা নতুন করে বলতে হলো সলিমউদ্দিনকে। বলল, তুমার বসতটা ইবার উঠায় দিবে, এইঠে ইবছর ট্রাকটর চলিবে। কপিলদাস এবারও বুঝতে পারে না। তার নিজের হিসাব মেলে না। ট্রাকটর জমিতে চলবে, তাই চলে এসেছে এতকাল।

মানুষের বসতের উপর দিয়ে ট্রাকটর চলতে যাবে কেন? ই কেমন কথা? সে অন্ধকারেই ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। বলে, ঠিক শুনিছিস তুই, কহ ঠিক শুনিছিস? সলিমউদ্দিন এবার সত্যিই বিরক্ত হয়। বলে, মোর কথা বিশ্বাস না হয় আর কাহাকো পুছে দেখ। মুই ইবার যাউ, তুই বুঢ়া মানুষ, তোর কিছু ফম থাকে না। কথাটা বলেই হঠাৎ ঘোড়া চলে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপিলদাস মাথা নাড়ায়। আর নিজেকে শোনায়-না, ক্যানে পালাব। তার পা আপনা থেকে বাড়ির পথ ধরে। কোথায় পালাবে সে। এক সময় আবার হাসি পায় বুড়োর, পালাবার কথাটা এল।

কোত্থেকে? তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল—নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তখন সে বলে, তোর কিছু ফম থাকে না। আর ঐ সময় ট্রাকটরের আওয়াজটা তার কানে এসে ধাক্কা মারে। কী কারণে যে হঠাৎ ধকধক শব্দ করে জেগে উঠল। ঘুমন্ত ট্রাকটরটা আন্দাজ করা মুশকিল। বিনোদ মিস্ত্রি একেকদিন এই রকম হঠাৎ ট্রাকটরের এঞ্জিন চালিয়ে দেয়। ট্রাকটরটা সে চোখের সামনে দেখতে পায় যেন। বিশাল বিশাল দুটো চাকা ঘুরতে ঘুরতে মাঠের বুকের ওপর দিয়ে চলেছে, পেছনের ধারালো চাকতিগুলো মাটি ফালা ফালা করে দিচ্ছে, গন্ধ বেরুচ্ছে কাটা মার্টির ভেতর থেকে।

ঐভাবে ট্রাকটরটা চলে আসে একেবারে দীনেশ কিস্কুর বাড়ির সীমানা পর্যন্ত। তারপরই বেশ। দিব্যি ঘুরে যায়। বসতই হলো ট্রাকটর চলাফেরা করার শেষ সীমানা। হ্যাঁ, কলের জিনিস ঐ পর্যন্ত আসে। সংসারের সীমানা পর্যন্তই তার আসবার ক্ষমতা, তারপর আর পারে না, এতকাল অন্তত পারেনি। আর এখন সেই কলের জিনিস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে দীনেশ কিস্কুর উঠোনে। ঘরের দেয়ালে ভোতা নাক ঢুকিয়ে উল্টো দিকের দেয়াল ফুঁড়ে বেরুবে। দৃশ্যটাকে সে মনের ভেতর দেখতে পায়। আর তাই দেখে সে ভয়ানক অস্থিরতা বোধ করে। ই কী কথা আ? ট্রাকটর চলে আসবে সংসারের বুকের ওপর? কপিলদাস বুড়োর এখন মনে পড়তে থাকে।

এই বস্তি উঠে যাবার ব্যাপারটা আকস্মিক নয়। একেবারে-তাহলেও, এই কি শেষ পর্যন্ত পরিণতি? বস্তিটস্তি উঠে যাবে আর ট্রাকটর চলতে থাকবে ও ঘরবাড়ি-ভিটেমাটির উপর দিয়ে। কোথায় একটা মেয়েমানুষের মাথা গরম করে মাতালের দিকে দা উচিয়ে তেড়ে যাবার ঘটনা আর কোথায় বাড়িঘর সংসারসুদ্ধ লোপাট করে দেওয়া। কিসের সঙ্গে কিসের জড়ানো। কিন্তু ভাবো তো বসতটা কত পুরনো? মনে আছে তোর, হ্যাঁ বাহে মড়লের ব্যাটা, তোর কি ফম আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ ফম আছে। বিচার বসেছিল ফার্মের অফিস ঘরে। কে একজন সাহেব মানুষ শুধোচ্ছিল। আর সে উত্তর দিচ্ছিল। কবে কোন প্রাচীনকালে এসেছিল একদল মানুষ।

সেই দলের মড়ল ছিল শিবনাথ। শিবোনাথ আবার গুণিন ছিল। কিন্তুক গুণিন হলেই কি সব হয়, আঁ? হয় কখনও? হয় না। ঐ পর্যন্ত বলার পর আর বলতে পারেনি মহিন্দর ধমকে উঠেছিল। পরে জানিয়েছিল, তুই আর হামার সঙ্গে আসিস না বাপ-তোর কথার কুনো ঠিক নাই। কুন কথাত তুই কুন কথা কহিস বুঝিস না। হা মড়ল তুই বুঢ়া মানুষ—তুই কিছু করিবা পারিস না। ঐ দিনই কে যেন বলেছিল কথাটা। কপিলদাস কথাটা নিজেকে শোনালো আরেকবার—তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল, তোর কিছু করার নাই। একবার নয়, ঘুরে ঘুরে কথাটা সে বলেই চলল।

আর থেকে থেকে ভারি গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল কয়টা। আর ঐ দীর্ঘশ্বাস তাকে বার্ধক্যের অক্ষমতা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে ঠাণ্ডায় পা দুখানি অসাড় হয়ে উঠেছে। উঠোনের আগুনের কাছে বসে বসে সে হাত-পা সেঁকে কিছুক্ষণ। মহিন্দরের বউ বিন্নী থালায় করে ভাত দিয়ে যায়। আগুনের তাতে ততক্ষণে আরাম লাগছে কপিলদাসের। ভাতের পাশে এক টুকরো পোড়া মাংস দেখতে পেয়ে সে খুশি হয়।

নাতিদের শুধোয় কী শিকার পেয়েছিল তারা। মুহিন্দরের ছেলে শিকারের গল্পটা আরম্ভ করে বোধহয়—কিন্তু তার গল্পের দিকে বুড়ো আর মনোযোগ দিতে পারে না। দাদা, বড় জঙ্গত নাকি বাঘ থাকে? নাতির প্রশ্ন শুনে একটু সজাগ হতে হয় বুড়োকে। ঠিক মনে করতে পারে না। প্রাণনগরের জঙ্গলে কি বাঘ আছে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে। তারপর মাথা নাড়ায়, নাই রে—শুকদাস, ঐঠে বাঘটাগ নাই। কিন্তুক ছিল এক সময়। নাতিরা ঘন হয়ে বসে। কপিলদাস ভাত খাওয়ার কথা ভুলে যায় তখন।

সে গল্প আরম্ভ করে। গল্প মানে তো নিজের কথা। সাঁওতাল কিশোর ছেলের যে ব্যাপারে সবচাইতে আকর্ষণ সেটাই সে ধীর স্বরে বর্ণনা করতে থাকে। তার কালো রঙের কুকুরটার কথা আসে। তার ঘরে খুঁজলে তিরের চোঙা দুটো এখনো পাওয়া যাবে—সেই চোঙায় বাছা বাছা তির জমানো থাকত। একবার তির দিয়ে একটা বাঘ গেঁথে ফেলেছিল। ভাগ্যিস সে তখনো বাঘ কী জিনিস জানত না। বনবিড়াল ভেবে নিশানা করে তির ছেড়ে দিয়েছে আর অমনি কী ডাক! ভয় পেয়ে পড়িমরি করে কী রকম দৌড়েছিল সেই ঘটনাটা সে বলে এবং বলবার সময় দৌড়ের বর্ণনাটাই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। বুড়ো মানুষের গুনগুন গুনগুন ধীর স্বরের একঘেয়েমিতে বিরক্তি লাগে বাচ্চাদের।

শুকদাস অস্থির হয়ে ডাকে, দাদা বাঘটার কী হইল? ও, হ্যা, বাঘটা। কপিলদাসকে একটু ভেবে নিতে হয়। তির খেয়ে বিকট চিৎকার করে উঠবার পর বাঘটার যে কী হয়েছিল কোনোভাবেই মনে পড়তে চায় না। তখন গল্পটা সে বানাতে আরম্ভ করে। তার বর্ণনায় তখন কৌতুক আসে। বাঘের ল্যাজ ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসবার ব্যাপারটা সে রঙ চড়িয়ে বলতে চায়। কিন্তু বাঘটা টেনে নিয়ে আসবার সময় কি রকম কষ্ট হচ্ছিল সে কথাটাই ঘুরেফিরে বলতে থাকে সে। শীতের রাত, ততক্ষণে সবারই ঘরে গিয়ে শোবার কথা। কিন্তু কেউ শুতে যাচ্ছে না সেটা সে লক্ষ্য করে।

দেখে, ইতিমধ্যে মহিন্দর, দীনদাস এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যাচ্ছে কোনো শলাপরামর্শ হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা যে কী, কিছুই অনুমান করা যায় না। ও হ্যা, বাঘটার যেন কী হয়েছিল? কপিলদাস কিশোর দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাজ ধরে টানবার প্রসঙ্গে ফিরে আসে। ঐ রকম যখন টেনে আনছিল তখনো কিন্তু বাঘটা বেঁচে ছিল—হ্যা। ঘা খাওয়া বাঘ কিন্তু ভয়ংকর জিনিস। এই পর্যন্ত বলে থামতে হয়। ঘা খাওয়া বাঘের ভয়ংকরতা কীভাবে বোঝাবে সেজন্যে তাকে ভাবতে হয়। আর। ঐ সময় মহিন্দরদের কাছে একটি লোককে আসতে দেখে সে গল্পের কথা ভুলে যায়। উঠে গিয়ে দাঁড়ায় মহিন্দর।

আর দীনদাসের কাছে। নিজের ছেলে মহিন্দর বিরক্ত হয়—বলে, তুই এখুন যা তো বাবা, বুঢ়া মানুষ তুই ইসবের কী বুঝিস! কপিলদাস বুড়ো এবার সত্যিই দমে যায়। নিজের জন্ম দেয়া ছেলে যদি এই রকম করে বলে, তো সে কী করবে। তাকে পিছিয়ে আসতে হয়। হ! মড়ল তুই তো বুঢ়া মানুষ, তুই কিছু করিবা পারিস না। কথাটা ঘুরেফিরে কেউ যেন তার কানের কাছে বারবার করে বলতে থাকে। সে কিছুই করতে পারে না, তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সে মানুষের জটলাটা দেখে। ততক্ষণে জায়গাটা বেশ একটুখানি সমাবেশ মতো হয়ে উঠেছে।

দেখে, দীনদাস হাত নেড়ে নেড়ে কী বলে চলেছে। তারপর আবার মহিন্দর আরম্ভ করল। তার কথা শেষ হতে না হতেই ওদিক থেকে আবার ভায়া মাঝি আরম্ভ করল। ভারি ধীর নোয়ানো স্বর। শান্তভাবে পরামর্শ হচ্ছে যেন। রাগ নেই। জ্বালা নেই। কারো দুচোখ ধকধক করে জ্বলে উঠছে না, কেউ চিল্কার করে গালাগাল দিচ্ছে না। কপিলদাসের ভারি অবাক লাগে গোটা ব্যাপারটা দেখে। অবাক লাগে, কিন্তু কিছু বলে না সে। বরং নিজেকে সরিয়ে আনে। কয়েক পা পিছিয়ে আসে সে। কিন্তু ঐ কয়েক পা সরে আসতে অনেকটা সময় লেগে যায় তার। কানের কাছে তখনও সে শুনছে—তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল, তোর কিছুই করার নাই। যেখান থেকে উঠে এসেছিল সেইখানে সে ফিরে যায়।

শুধুই যথাস্থানে ফিরে যাওয়া, শুধুই মেনে নেওয়া—তার কেবলই মনে হতে থাকে। বাচ্চারা লোকসমাগম দেখেই সম্ভবত উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে। মেয়ে-বউরা এখানে সেখানে ইতস্তত দাঁড়িয়ে। হলে যা হয়—ততক্ষণে খুনসুটি, দাপাদাপি এবং হাসাহাসি এইসব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। পাথরের ওপর ঘষে তীরে শান দেওয়া তখনো হচ্ছে। মহিন্দরের ছেলে ডাকল, দাদা তারপর বাঘটার কী হইল? ও, সেই গল্প। কপিলদাসের মনে পড়ে একটু আগে শিকারের গল্প বলতে বলতে সে উঠে গিয়েছিল। তখন আগুনের আলো কিশোর মুখের ওপর চমকাচ্ছে, কে একজন কঞ্চি দিয়ে আগুনটা আরেকটুখানি উসূকে দিল। আর ঐ ঘটনার কারণেই কি না কে জানে, কপিলদাস গল্পটা আবার আরম্ভ করে দিল। হ্যাঁ, বাঘটার ল্যাজ ধরে টানতে টানতে আসছিল সে। ভারী ওজন হয় বাঘের।

আর বাঘটা ওদিকে তখনও কিন্তু মরেনি। নাহ্, বাঘটা বোধহয় মরেই গিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ে। কপিলদাস সৎ হয়ে উঠতে চায় বাচ্চাদের কাছে। গল্প বানানো বাদ দেয়। তার স্পষ্ট মনে পড়ে তখন। বাঘটার গায়ে বিকট গন্ধ ছিল, তিরটা ঠিক বুকের মাঝখানে গিয়ে গেঁথেছিল, একেবারে এদিক থেকে ওদিক বেরিয়ে গিয়েছিল। রক্ত তখনও বেরুচ্ছিল গলগল করে। আর ঐ সময়, বিকেল বেলায়, প্রাণনগরের জঙ্গলের ধারে একটা লোক ছিল না চারদিকে কোথাও।

সে চিল্কার করে বাবাকে ডাকছিল, বন্ধুদের ডাকছিল। আর ঠিক তখন হঠাৎ তার পাশের ঝোপ থেকে কি একটা জানোয়ার লাফ দিয়ে বেরিয়েই বাঁয়ে ছুটতে শুরু করে দিল। ঐ জানোয়ারটা দেখেই সেএ পর্যন্ত বলেই সে থামে। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাবে বলে ইতস্তত করে। আহা কেমন করে বলবে যে শেয়াল দেখে সে ভয়ানক ভয় পেয়ে পালিয়েছিল। তারপর, তারপর কী হইল? বাচ্চারা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলে সে হঠাৎ হেসে ওঠে।

কপিলদাস তখন নিজের আলাদা অস্তিত্ব আর অনুভব করতে পারে না। তীরে শান দেবার সময় কী রকম করে পাথরের ওপর ঘষতে হয়—তাই দেখায়। একজনের হাত থেকে বাঁশিটা টেনে নিয়ে ফু দিয়ে একটা বহু পুরনো সুর বাজায়। কী বাজালো আঁ, কী বাজালো দাদা? প্রশ্ন হলে সে ভাঙা ভাঙা গলায় গানটা গায়—
ফকির বুলে ঢুলুক বাজে
ভালুক নাচে ঝাম,
হাইয়ারে হালমাল কই গেলু রে-এ-এ।
গানটি শুনে বাচ্চারাও গাইতে শুরু করে দেয়।

বুড়োর ভীমরতি হয়েছে ভেবে মেয়েরা কেউ কেউ মনোযোগ দেয় বাচ্চাদের জটলার দিকে। বড়রা যেখানে সভা বসিয়েছে সেখান থেকেও কে একজন চিৎকার করে গোলমাল বন্ধ করতে বলে। কিন্তু বাচ্চাদের থামাবে কে? মহিন্দরের ছেলে ধনুকের জন্যে বাঁশের ছিলা তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। কপিলদাস তার হাত থেকে কেড়ে নিলো ধনুকটা। বলল, দেখ, কেমন করে ছিলা পরাতে হয় ধনুকে। বাচ্চারা তখন ঘিরে দাঁড়ায় বুড়োর চারদিকে। কপিলদাস হাঁটু ভেঙে ধনুকের এক মাথা ধরে ঝুলে পড়ে ধনুকটা নোয়ায়। তারপর বাঁ হাতে ছিলার ফাসটা ধনুকের মাথায় ঢোকাতে চায়।

কিন্তু প্রথমবারেই পারে না। ডান হাতটা তার ভীষণভাবে কাঁপতে থাকে। বাচ্চারা বুড়োর কাণ্ড দেখে সমস্বরে বলে, পারব নাই দাদা-তুই পারব নাই। কিন্তু পারে সে। ঐ কাঁপা কাঁপা হাতেই সে ছিলা পরিয়ে দেয় ধুনকের। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছিলা টেনে ধনুকের একটা টঙ্কার তোলে। ভারি সুন্দর টানটান আওয়াজ হয় তাতে। এরপরও বুড়ো থামে না। একটা শানানো তির নেয় হাতে এবং তিরটা ধনুকের ছিলায় বসিয়ে তাক করে। সামনের দিকে একবার, একবার ডাইনে, একবার বায়ে। বুড়ো ভয় দেখিয়ে মস্করা করে যেন। বাচ্চারা তাতে হই হই করে ওঠে। আর ঐ রকম হই হই শুনেই সম্ভবত কপিলদাস তিরটা দু আঙুলের ফাঁকে চেপে ছিলা ধরে টানে।

টেনে ধনুকের নিশানা করে অন্ধকারের দিকে। মহিন্দরের ছেলে বলে ওঠে, দাদা তিরটা ছুটে যাবে, দাদা মোর তিরটা ছুটে যাবে। কিন্তু কপিলদাস নাতির মিনতি শুনতে পায় কি না বোঝা যায় না। সে সত্যি সত্যি তিরটা ছেড়ে দেয়। আর বাতাস কাটা শব্দ করে তিরটা অন্ধকারের দিকে ছুটে যায়। চারদিকে মানুষের বসত। মেয়েরা বুড়োরা কাণ্ড লক্ষ করে হা হা করে ওঠে। সভার মানুষদের মধ্য থেকেও কয়েকজন এগিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে বুড়ো কপিলদাস আর একটা তির হাতে তুলে নিয়েছে। সবাই যখন নিষেধ করছে তখন সে দ্বিতীয় তিরটাও সামনের অন্ধকারের দিকে নিশানা করে ছুড়ে দিয়েছে। এবং ঐ কাণ্ড ঘটে যাওয়ায় ব্যাপারটা আর ছেলেমানুষি তামাসার পর্যায়ে থাকে না। দূর থেকে মহিন্দর চিল্কার করে ওঠে, বিন্নি গালাগাল করতে আরম্ভ করে।

কিন্তু বুড়ো তখন হাসছে কেমন দেখো, যেন সে কিশোরকালে ফিরে গিয়েছে। জীবনে প্রথম নিশানা ভেদ করার যে খুশি—সেই খুশি পেয়ে বসেছে তাকে। সে শান দেয়া আরও একখানা তির হাতে তুলে নিয়েছে তখন। ওদিকে পেছন থেকে দীনদাস চিৎকার করে বলছে—ধর বঢ়াটাকে ধরে কাছে লে ধেনুকখানসেই চিৎকার বুড়োর কানে পৌঁছায় না। কেউ পেছনে তাকে ধরতে আসছে কিনা সেদিকে জক্ষেপ না করে কপিলদাস বুড়ো দুহাতে তির-ধনুক নিয়ে সামনের অন্ধকারের দিকে চলতে থাকে।

বিমূঢ় মানুষজনের চোখের সামনে দিয়েই সে অনায়াসে অন্ধকার, গাছপালা, কৈশোর এবং আদিম উল্লাসের মধ্যে চলে যায়। আর সেখান থেকে সে তার তৃতীয় তিরটা সঠিক নিশানায় ছুড়বার জন্যে তৈরি হতে থাকে।
[সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]

শব্দার্থ ও টীকাঃ
মুর্মু - সাঁওতাল গোত্রবিশেষ। মুর্মু শব্দের অর্থ নীল গাভি; যা এই গোত্রের গোত্র-চিহ্ন তথা টোটেম। কথিত আছে একবার এক অরণ্যভূমিতে কিছু লোক কাজ করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। একসময় তাদের সর্দার ঘুমিয়ে পড়ল। সেই বনে ছিল একটি হিংস্র নীল গাভি। গাভিটি এসে পায়ের চাপা দিয়ে সর্দারকে মেরে ফেলল। ঘুম থেকে উঠে লোকেরা তখন গাভিটিকে হত্যা করল। সেই থেকে মৃত ব্যক্তির গোত্রের নাম বা পদবি হলো মুর্মু। এই গোত্রের একাধিক উপগোত্রও রয়েছে।

টাঙন - পাহাড়ি জলাধারবিশেষ। এ গল্পে ঠাকুরগাঁও শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টাঙন নদী বোঝানো হয়েছে।

কান্দর - খাত বা নিচু স্থান। সাধারণত খালের অংশবিশেষ।

পুশনা পরব - বিশেষ পুজোর আয়োজন। পৌষ-সংক্রান্তিতে এই পুজো উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হয়।

হাপন - বালক।

ভাঁর্ট - এক ধরনের বুনো ফুলবিশেষ।

জাড় - শীত, ঠান্ডা।

মান্দল - মাদল; এক ধরনের তালবাদ্য।

পসরা - পণ্যসম্ভার; বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত দ্রব্য।

নাগরদোলা - ওপর থেকে নিচের দিকে ঘুরতে পারে এমন পালকির মতো। এতে ছোট ছোট খোপ থাকে। তাতে মানুষ বসে আর এই খোপগুলোকে যন্ত্রের সাহায্যে কিংবা হাত দিয়ে টেনে ওপর থেকে নিচে ঘুরিয়ে আনে।

আধিয়ার - বর্গাদার। যারা একটি নির্দিষ্ট শর্তে অন্যের মালিকানাধীন জমিতে হাল চাষ করে এবং উৎপাদিত ফসলের অংশ শর্ত মোতাবেক মালিককে প্রদান করে।

জোতদার - ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার সূত্র ধরে কৃষকদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে এক মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তনি বা ইজারা নিত। এরাই জমির চাষ তদারকি এবং খাজনা আদায়ের কাজ করত। ফলে উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষক বহন করলেও ফসলের অর্ধেক চলে যেত জোতদারের হাতে।

গিরস্তি - গৃহস্থ কাজ।

মড়ল - মোড়ল। গোষ্ঠী প্রধান। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।

ঘুন্টি -  ঘণ্টাবিশেষ। গবাদিপশুর গলায় পরানো হয় এমন ছোট ঘণ্টা।

কুশিয়ার ক্ষেত - আখ ক্ষেত।

পুছে দেখ - জিজ্ঞেস করে দেখ।

ফম থাকা - স্মরণ থাকা। মনে থাকা।

পাঠ-পরিচিতিঃ আলোচ্য গল্পটি শওকত আলীর 'লেলিহান সাধ' (১৯৭৭) গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে। কপিলদাস মুর্মু এক বৃদ্ধ সাঁওতাল। ভূমির অধিকার নিয়ে সাঁওতালদের রয়েছে রক্তে রঞ্জিত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। ভূমি তাদের অস্তিত্বেরই অপর নাম। তাই নিজেদের বসতবার্টি থেকে উন্মলিত হবার আশঙ্কা যখন তীব্রতর রূপ ধারণ করে তখন বয়সের ভারে ঝিমিয়ে পড়া, অন্য সবার কাছে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মানুষ কপিলদাস অমিত সাহসে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ কাজ হিসেবে শেষ লড়াইটা লড়বার জন্য নিজেকে সে সময়ের হাতে তুলে দেয়। তরুণদের ভয় দ্বিধাকে অমূলক প্রমাণিত করে একাই সে আত্মত্যাগী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মাটির কাছাকাছি থাকা এক প্রবীণের এই অনিঃশেষ সংগ্রামশীলতার নান্দনিক রূপায়ণ ঘটেছে এই গল্পে। সমগ্র গল্পজুড়েই লেখক স্থবির দশায় আক্রান্ত কপিলদাসের অতীতের স্মৃতিকথা, বীরত্বগাথা- যার কতকটা সত্য কতকটা কল্পনা- এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। আর সেইসঙ্গে কপিলদাসের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন; যার মূল সুর হলোঃ ‘হা মড়ল তুই বুঢ়া মানুষ- তুই কিছু করিবা পারিস না।' এরূপ চিন্তার বিপ্রতীপে অবস্থিত কেবল শিশুরা। তাদের কাছে কপিলদাস এবং তার গল্প- দুয়েরই বিশেষ আকর্ষণ ও গুরুত্ব রয়েছে। এই উৎসাহ কপিলদাসকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সে তার বয়সকে অতিক্রম করে যায়; অনেকটা খেলার ছলেই জড়বৎ কপিলদাস আকস্মিকভাবে গতিপ্রাপ্ত হয়।

তার হাতে উঠে আসে তির-ধনুক। একের পর এক তির তার হাত থেকে ছুটে যেতে থাকে শত্রুকে লক্ষ করে। কপিলদাস নিজে কেবল একটি চরিত্র থাকে না; হয়ে ওঠে জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের এক আপসহীন যোদ্ধা। কপিলদাসের আশ্রয়ে লেখক আমাদের জানিয়ে যান লড়াইয়ের কোনো বয়স নেই। উন্মলিতপ্রায় মানুষগুলো কোনো কিছুর পরোয়া না করেই তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এই আশাবাদের দ্যোতনা জাগিয়ে গল্পকার রচনাটি সমাপ্ত করেন। সাঁওতালি কথনভঙ্গি, শব্দ যোজনা এবং যথোপযুক্ত প্রেক্ষাপট সৃজন এই রচনার শিল্পসাফল্যকে বহুগুণ বর্ধিত করেছে।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১. “ধর বুঢ়াটাকে, ধরে কাঢ়ে লে ধেনুকখান”-কার উক্তি?
ক. দীনদাসের
খ. মহিন্দরের
গ. সলিমউদ্দিনের
ঘ. বিনোদ মিস্ত্রির

২. “ওদিকে গোপীনাথ কিছুই বলে না”–এর কারণ হলো গোপীনাথের-
i. স্বার্থপরতা
ii. কাপুরুষতা
iii. স্বাজাত্যবোধহীনতা

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
মাহমুদা নামের এক অসহায় বিধবা বহু বছর ধরে সরকারি খাস জমিতে বসবাস করে আসছেন। ভূমিহীনতা সূত্রে মাহমুদা ও অন্যান্যরা সরকারের কাছ থেকে খাস জমি বন্দোবস্ত নিতে চান। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী। মৎস্য ঘের মালিকেরা ওই জমি তাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়ে নতুন মৎস্য ঘের বানাতে চান। “হয় জমি নয়। জীবন’- এই প্রত্যয় বুকে নিয়ে মাহমুদারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

৩. উদ্দীপকের মাহমুদা কপিলদাস মুর্মুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কারণ, তার-
i. সাহসিকতা
ii. সংগ্রামশীলতা
iii. অধিকার সচেতনতা

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

৪. সাদৃশ্যপূর্ণ দিকটির চূড়ান্ত রূপ “কপিলদাস মুমুর শেষ কাজ” গল্পে কোন বাক্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে?
ক. সবই একটার সঙ্গে আরেকটা শেষ পর্যন্ত মেলানো।
খ. ম্যানুয়েল পাদ্রিকে টাঙনের জলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল।
গ. মহাজনের ধান খামার বাড়ি থেকেই কিনদের বিলিয়ে দিলি।
ঘ. বুড়ো দু-হাতে তির-ধনুক নিয়ে সামনের অন্ধকারের দিকে চলতে থাকে।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশবাসীর ওপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা দিক থেকে শোষণ-বঞ্চনা চালিয়ে আসছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করলেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তাদের বিভিন্ন টালবাহানা এদেশবাসীকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। তখন ‘জয় বাংলা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর', “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা স্লোগানে শহর-বন্দর-গ্রাম আন্দোলিত হয়।
ক. মুর্মু কী?
খ. কপিলদাস বুড়োর কাছে সবই একটার সাথে আরেকটা মেলানো বলে মনে হয়-কেন?
গ. উদ্দীপকের দেশবাসীর সাথে কপিলদাস মুমুর চেতনাগত সাদৃশ্য ব্যাখ্যা কর।
ঘ. কপিলদাস মুর্মুর অতীত ও বর্তমান তাঁকে উদ্দীপকের দেশবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। -মন্তব্যটির যথার্থ যাচাই কর।
Share: