বাংলা ভাষা লেখার সময় আমরা নানা ধরনের ব্যাকরণগত ভুল করে থাকি। শব্দ ও বাক্যের শুদ্ধ প্রয়োগবিধির জন্য একক কোনো সূত্র বা নির্দিষ্ট পদ্ধতি বেঁধে দেয়া সম্ভব নয়। সাধারণত আমরা যে কোনো বাক্য লেখার সময় ৪ ধরনের ভুল করে থাকি। এগুলো নিম্নরূপ:
✯ বানানের অশুদ্ধি
✯ বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ
✯ বাক্যে পদবিন্যাস সংক্রান্ত ভুল
✯ সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রণজনিত ভুল
এছাড়াও কয়েক ধরনের ভুল সচরাচর লক্ষ্য করা যায়। যেমন:
✯ বহুবচনের অপপ্রয়োগজনিত অশুদ্ধি
✯ বাচ্যজনিত ভুল
✯ বাক্যে লিঙ্গ-সঙ্গতিজনিত ভুল
✯ বাহুল্যজনিত ভুল
✯ অযথার্থ শব্দ প্রয়োগজনিত ভুল
✯ বাক্যে প্রবাদ-প্রবচনের বিকৃতিজনিত ত্রুটি
উদাহরণ
অশুদ্ধ: তিনি মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম সদস্য।→শুদ্ধ: তিনি মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য।
অশুদ্ধ: আমি বড় অপমান হয়েছি।→শুদ্ধ: আমি বড় অপমানিত হয়েছি।
অশুদ্ধ: হীন চরিত্রবান লোক পশ্বাধম।→শুদ্ধ: চরিত্রহীন লোক পশ্বধম।
অশুদ্ধ: সকল সুধীমন্ডলী উপস্থিত আছেন।→শুদ্ধ: সুধীমন্ডলী উপস্থিত আছেন।
অশুদ্ধ: তাহার সৌজন্যতাবোধ আমাকে অভিভূত করেছে।→তাহার সৌজন্যবোধ আমাকে অভিভূত করিয়াছে।
অশুদ্ধ: ক্লাসে অনেক ছাত্রছাত্রীরা এসেছিল। →শুদ্ধ: ক্লাসে অনেক ছাত্রছাত্রী এসেছিল।
অশুদ্ধ: বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। →শুদ্ধ: বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।
অশুদ্ধ: দশচক্রে ঈশ্বর ভূত।→শুদ্ধ: দশচক্রে ভগবান ভূত।
অশুদ্ধ: শুধুমাত্র এই কটা টাকা দিলে? →শুদ্ধ: শুধু এই কটা টাকা দিলে?
অশুদ্ধ: মন্ত্রীর অনুপস্থিতে সচিব দায়িত্ব পালন করবেন।→শুদ্ধ: মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সচিব দায়িত্ব পালন করবেন।
বাক্যের শুদ্ধিকরণ
পুনরুক্তি বা বাহুল্যজনিত দুর্বল প্রয়োগ
অশুদ্ধ: ছেলেটি দারুণ সুবুদ্ধিমান।
শুদ্ধ: ছেলেটি দারুণ বুদ্ধিমান।
অশুদ্ধ: সশঙ্কিতচিত্তে সে কথাটা বলল।
শুদ্ধ: সশঙ্কচিত্তে (বাশঙ্কিতচিত্তে) সে কথাটা বলল।
অশুদ্ধ: শুধুমাত্র গায়ের জোড়ে কাজ হয় না।
শুদ্ধ: শুধু গায়ের জোরে কাজ হয় না।
অশুদ্ধ: কেবলমাত্র দুর্নীতিই এ সঙ্কটের জন্যে দায়ী।
শুদ্ধ: আমাদের দেশ এক সময় ব্রিটিশের অধীনস্থ ছিল।
অশুদ্ধ: তৎকালীন সময়ে সরকারের ভুমিকা সমালোচিত হয়।
শুদ্ধ: তৎকালে (বা সে সময়ে) সরকারের ভূমিকা সমালোচিত হয়।
অশুদ্ধ: আকণ্ঠ পর্যন্ত ভোজনে স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
শুদ্ধ: আকণ্ঠ (বা কণ্ঠ পর্যন্ত) ভোজনে স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
অশুদ্ধ: বৃক্ষটি সমূলসহ উৎপাটিত হয়েছে।
শুদ্ধ: বৃক্ষটি সমূলে (বা মূলসহ) উৎপাটিত হয়েছে।
লিঙ্গ-সংগতিজনিত ভুল
অশুদ্ধ: এই মহান মহিলার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
শুদ্ধ: এই মহীয়সী মহিলার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
অশুদ্ধ: ওর মতো বুদ্ধিমান বালিকা এ পাড়ায় নেই।
শুদ্ধ: ওর মতো বুদ্ধিমতী বালিকা এ পাড়ায় নেই।
অশুদ্ধ : বর্তমানে বদ্বিান মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
শুদ্ধ: বর্তমানে বিদুষী মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
অশুদ্ধ: বেগম বদরুন্নেসা এই বাড়ির কর্ত্রা।
শুদ্ধ: বেগম বদরুন্নেসা এই বাড়ির কর্ত্রী।
অশুদ্ধ: রাজা পাপিষ্ঠ রাণীকে শাস্তি দিলেন।
শুদ্ধ: রাজা পাপিষ্ঠা রাণীকে শাস্তি দিলেন।
প্রবাদ-প্রবচনের বিকৃতিজনিত ভুল
অশুদ্ধ: দশচক্রে ঈশ্বর ভূত।
শুদ্ধ: দশচক্রে ভগবান ভূত।
অশুদ্ধ: যেমন বুনো কচু তেমনি বাঘা তেতুঁল।
শুদ্ধ: যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেতুঁল।
অশুদ্ধ: পরীক্ষা এলেই কেউ কেউ চোখে হলুদ ফুল দেখে।
শুদ্ধ: পরীক্ষা এরেই কেউ কেউ চোখে সর্ষে ফুল দেখে।
অশুদ্ধ: আমি কারো সাতেও নেই সতেরোতেও নেই।
শুদ্ধ: আমি কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই।
অশুদ্ধ: ও তো ঢোলের বাঁয়া, সঙ্গে থাকাও যা, না থাকাও তা।
শুদ্ধ: ও তো ঢাকের বাঁয়া, সঙ্গে থাকাও যা, না থাকাও তা।
অশুদ্ধ: ওরা এক ঝাঁকের মাছ তো, তাই চালচলনও এক রকম।
শুদ্ধ: ওরা এক ঝাঁকের কই তো, তাই চালচলনও এক রকম।
বিশেষ্যের স্থানে বিশেষণের প্রয়োগজনিত ভুল
অশুদ্ধ: দুর্বলবশত তিনি আসিতে পারেন নাই।
শুদ্ধ: দুর্বলতাবশত তিনি আসিতে পারেন নাই।
অশুদ্ধ: তিনি উদ্ধতপূর্ণ আচরণ করছেন।
শুদ্ধ: তিনি ঔদ্ধত্যপূর্ণ (বা উদ্ধত) আচরণ করছেন।
অশুদ্ধ: ইহার আবশ্যক নাই।
শুদ্ধ: ইহার আবশ্যকতা নাই।
অশুদ্ধ: সদা সর্বদা তোমার উপস্থিত প্রার্থনীয়।
শুদ্ধ: সদা/সর্বদা তোমার উপস্থিতি প্রার্থনীয়।
অশুদ্ধ: অসুস্থবশত সে কলেজে আসতে পারে নি।
শুদ্ধ: অসুস্থতাবশত সে কলেজে আসতে পারে নি।
যথার্থ শব্দ প্রেয়োগ না করায় ভুল
অশুদ্ধ: বাংলাদেশ একটি উন্নতশীল দেশ।
শুদ্ধ: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।
অশুদ্ধ: কুপুরুষের মতো কথা বলো না।
শুদ্ধ: কাপুরুষের মতো কথা বলো না।
অশুদ্ধ: আসামির অনুপস্থিতে বিচার চলছে।
শুদ্ধ: আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার চলছে।
অশুদ্ধ: তিনি মকদ্দমায় সাক্ষী দেবেন।
শুদ্ধ: তিনি মকদ্দমায় সাক্ষ্য দেবেন।
অশুদ্ধ: অন্যায়ের প্রতিফলন দুর্নিবার্য
শুদ্ধ: অন্যায়ের প্রতিফলন দুর্নিবার/অনিবার্য
অশুদ্ধ: আপনি স্বপরিবারে আমন্ত্রীত
শুদ্ধ: আপনি সপরিবারে আমন্ত্রীত
অশুদ্ধ: এত পরিশ্রম আমার সাধ্যায়ত্ত নয়।
শুদ্ধ: এত পরিশ্রম আমার সাধ্য নয়।
অশুদ্ধ: তিনি স্বস্ত্রীক সিলেটে থাকেন।
শুদ্ধ: তিনি সস্ত্রীক সিলেটে থাকেন।
অশুদ্ধ: আগামী সোমবারে তাহারা যাবে।
শুদ্ধ: আগামী সোমবারে তাহারা যাইবে।
অশুদ্ধ: আমার সাবকাশ নেই।
শুদ্ধ: আমার অবকাশ নেই।
অশুদ্ধ: ছেলেটি ভয়ানক মেধাবী।
শুদ্ধ: ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী।
অশুদ্ধ: এটা হচ্ছে ষষ্ঠদশ বার্সিক সাধারণ সভা।
শুদ্ধ: এটা হচ্ছে ষোড়শ বার্ষিক সাধারণ সভা।
বহুবচনের অপপ্রয়োগজনিত ভুল
অশুদ্ধ: যাবতীয় প্রাণীবৃন্দ এই গ্রহের বাসিন্দা
শুদ্ধ: যাবতীয় প্রাণী এই গ্রহের বাসিন্দা।
অশুদ্ধ: সকল ব্যনার্তদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
শুদ্ধ: সকল বন্যার্তকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
অশুদ্ধ: অন্যান্য বিষয়গুলোর আলোচনা পরে হবে।
শুদ্ধ: অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা পরে হবে।
অশুদ্ধ: নতুন নতুন ছেলেগুলো বড় উৎপাত করিতেছে।
শুদ্ধ: নতুন নতুন ছেলেরা বড় উৎপাত করিতেছে।
বা নতুন নতুন ছেলেগুলো বড় উৎপাত করিতেছে।
অশুদ্ধ: সকল ছাত্রগণ পাঠে মনোযোগী নয়।
শুদ্ধ: সকল ছাত্র পাঠে মনোযোগী নয়।
অশুদ্ধ: সভায় অনেক সদস্যগণ আসিয়াছিল।
শুদ্ধ: সভায় অনেক সদস্য আসিয়াছিল।
অশুদ্ধ: সমুদয় পক্ষীরাই নীড় বাঁধে।
শুদ্ধ: সমুদয় পক্ষীই নীড় বাঁধে।
শব্দ বা পদের বিশিষ্টার্থে প্রয়োগ
বাংলা ভাষায় কতকগুলো বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়া জাতীয় পদ রয়েছে, যেগুলো বাক্যে বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। আভিধানিক অর্থের বাইরে পদের এ ধরনের বিশেষ প্রয়োগকে শব্দ বা পদের বিশিষ্টার্থে প্রয়োগ বলে অভিহিত করা হয়।
বহুভাবে এ ধরনের পার্থক্য দৃষ্ট হয়ে থাকে। যেমন:
শিষ্টরীতি বা রীতিসিদ্ধ প্রয়োগ ঘটিত: ছাত্রটির মাথা ভাল। এখানে ‘মাথা’ বলতে ‘দেহের অঙ্গবিশেষ’ বোঝায় না বোঝায় ‘মেধা’।
শব্দের অর্থান্তর প্রাপ্তিতে: মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তত্ত্ব পাঠানো হয়েছে। এখানে ‘তত্ত্ব’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘সংবাদ’ না বুঝিয়ে ‘উপঢৌকন’ অর্থ বোঝাচ্ছে।
শব্দের উৎকর্ষ প্রাপ্তিতে: শ্রীরাম পরমহংস। এখানে ‘পরমহংস’ শব্দের সঙ্গে হাঁসের কোন সম্পর্ক নেই, এর অর্থ ‘সন্ন্যাসী’।
শব্দের অপকর্ষ বা অধোগতি বোঝাতে: জ্যাঠামি করো না। এখানে ‘জ্যাঠামি’ শব্দের সঙ্গে জ্যাঠার কোনো সম্পর্ক নেই। শব্দটি ‘ধৃষ্টতা’ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কতকগুলো পদের বিশিষ্টার্থে প্রয়োগ
অর্থ
অর্থ বাক্য
উদ্দেশ্য তোমার কথার অর্থ বুঝলাম না।
মানে এ কথার অর্থ কি?
শাস্ত্র অর্থনীতি বেশ মজার বিষয়।
উত্তর
অর্থ বাক্য
জবাব আমার কথার উত্তর দাও।
দিক বিশেষ উত্তর দিক থেকে ঝড় উঠেছে।
ভবিষ্যৎ উত্তরকালে তিনি একজন বড় লেখক হবেন।
কাঁচা
অর্থ বাক্য
অপূর্ণ কাঁচা ঘুমে জাগিয়ো না।
অদক্ষ এটা কাঁচা হাতের কাজ।
দুর্বল ছেলেটি অঙ্কে বড়ই কাঁচা।
0 Comments:
Post a Comment