বাংলাদেশের ষড়ঋতু
[চ. বো. ১৫, ব. বো. ১১, সি. বো. ১১]
সূচনা: সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা অপরূপ নিসর্গের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। ঋতুচক্রের আবর্তে এখানে চলে প্রকৃতির রং বদলের খেলা। নতুন নতুন রং-রেখায় প্রকৃতি আলপনা আঁকে মাটির বুকে, আকাশের গায়ে, মানুষের মনে। তাই ঋতু বদলের সাথে সাথে এখানে জীবনেরও রং বদল হয়।
ষড়ঋতুর পরিচয়: বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুগুলো হচ্ছে- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এই ঋতুগুলো প্রতি দুই-মাস অন্তর চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ঋতুর এই পালাবদলের সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।
গ্রীষ্মকাল: ঋতুচক্রের শুরুতেই আগুনের মশাল হাতে মাঠ-ঘাট পোড়াতে পোড়াতে গ্রীষ্মরাজের আগমন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মের রুক্ষতায় প্রকৃতির শ্যামল-স্নিগ্ধ রূপ হারিয়ে যায়। খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যায়। অসহ্য গরমে সমস্ত প্রাণিকুল একটু শীতল পানি ও ছায়ার জন্য কাতর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কখনো হঠাৎ শুরু হয় কালবোশেখির দুরন্ত তাণ্ডব। সেই তাণ্ডবে গাছপালা ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়। তবে গ্রীষ্ম শুধু পোড়ায় না, অকৃপণ হাতে দান করে আম, জাম, জামরুল, লিচু, তরমুজ ও নারকেলের মতো অমৃত ফল।
বর্ষাকাল: গ্রীষ্মের রুক্ষতাকে বৃষ্টির জলে ধুয়ে দিতে মহাসমারোহে বর্ষা আসে। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে ওঠে। শুরু হয় মুষলধারায় বৃষ্টি। মাঠ-ঘাট পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে দেখা দেয় মনোরম সজীবতা। জনজীবনে ফিরে আসে প্রশান্তি। গাছে গাছে ফোটে কদম, কেয়া, জুঁই। প্রকৃতি এক মনোরম স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। তাই তো কবি বর্ষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন-
“বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর
কালিমাখা মেঘ ওপারে আঁধার
ঘনিয়াছে দেখ চাহি রে।”
শরৎকাল: বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আসে ঋতুর রানি শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। এ সময় শুভ্র জ্যোৎস্না আর সুরভিত ফুলের সুষমা মনকে উচাটন করে তোলে। নদীর তীরে তীরে বসে সাদা কাশফুলের মেলা। বিকেলবেলা মালা গেঁথে উড়ে চলে সাদা বকের সারি। সবুজ ঢেউয়ের দোলায় দুলে ওঠে ধানের খেত। শাপলার হাসিতে বিলের জল ঝলমল ঝলমল করে। তাই শরতের শোভাময় প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে কবি বলেছেন-
আজিকে তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
হেমন্তকাল: ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবের আনন্দ নিয়ে আগমন ঘটে হেমন্তের। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ হলুদ। সর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের বুক। মাঠে মাঠে পাকা ধান। কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফসল কাটার কাজে। সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। শুরু হয় নবান্নের উৎসব। হেমন্ত আসে নীরবে; আবার শীতের কুয়াশার আড়ালে গোপনে হারিয়ে যায়।
শীতকাল: কুয়াশার মলিন চাদর গায়ে উত্তুরে হাওয়া সাথে নিয়ে আসে শীত। পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল। শীত রিক্ততার ঋতু। কনকনে শীতের দাপটে মানুষ ও প্রকৃতি অসহায় হয়ে পড়ে। তবে রকমারি শাকসবজি, ফল ও ফুলের সমারোহে বিষণ্ণ প্রকৃতি ভরে ওঠে। বাতাসে ভাসে খেজুর রসের ঘ্রাণ। ক্ষীর, পায়েস আর পিঠাপুলির উৎসবে মাতোয়ারা হয় গ্রামবাংলা। তাই তো কবি বলেছেন-
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে,
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”
বসন্তকাল: বাংলাদেশে ঋতুচক্রের সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। বসন্ত নিয়ে আসে সবুজের সমারোহ। বাতাসে মৌ মৌ ফুলের সুবাস। গাছে গাছে কোকিল-পাপিয়ার সুমধুর গান। দখিনা বাতাস বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ। মানুষের প্রাণে বেজে ওঠে মিলনের সুর। আনন্দে আত্মহারা কবি গেয়ে ওঠেন-
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।
উপসংহার: বাংলাদেশে ষড়ঋতুর এই লীলা অবিরাম চলছে। প্রতিটি ঋতু প্রকৃতিতে রূপ-রসের বিভিন্ন সম্ভার নিয়ে আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তার প্রভাব পড়ে বাংলার মানুষের মনে। বিচিত্র ষড়ঋতুর প্রভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মন উদার ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
0 Comments:
Post a Comment