নাটক: সিরাজউদ্দৌলা - সিকান্দার আবু জাফর pdf download - Exam Cares

Breaking

Home Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

নাটক: সিরাজউদ্দৌলা - সিকান্দার আবু জাফর pdf download

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি 
বাংলা সহপাঠ গাইড 

নাটক 
সিরাজউদ্দৌলা 
সিকান্দার আবু জাফর

Drama: Sirajuddaula by Sikandar Abu Zafar pdf download

নাটক: সিরাজউদ্দৌলা - সিকান্দার আবু জাফর | বাংলা সহপাঠ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

নাটক সম্পর্কে আলোচনা

নাটকের সংজ্ঞা
নাটক হচ্ছে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা। ‘নাটক’ শব্দটির এসেছে ‘নট’ শব্দ থেকে। এ নটের অর্থ হলো নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা। পক্ষান্তরে ইংরেজি ‘Drama’ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘Draen’ শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো ‘to do’ বা ‘করা’। শব্দটির অর্থ হলো অ্যাকশন অর্থাৎ কোনো কিছু করে দেখানো। নাটক মানবজীবনের কথা বলে। নাটক মানুষ ও সমাজের বিচিত্র ঘটনার কথা বলে। নাটকের মাঝে মানুষ ও মানবসমাজ মূর্ত হয়। তাই নাটক মানুষের দর্পণ, সমাজের দর্পণ, মানব ভাগ্যের দর্পণ।

সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাটককে দৃশ্যকাব্য আখ্যা দিয়েছেন। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাট্য-সাহিত্যকে কাব্য-সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁহাদের মতে কাব্য দুই প্রকার: দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্য। নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য এবং ইহা সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্যেষু নাটক রস্যম। নাটক দৃশ্য করা ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গ মঞ্চের সমন্বয়ে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সন্মুখে মূর্ত করে তোলে। রঙ্গ মঞ্চের সাহায্য ব্যতীত নাটকীয় বিষয় পরিস্ফুট হয় না। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Elizabeth Drew বলেন- “Dremisthe Creation and representation of life in terms of the theatre.”

বস্তুত: নাটক একটি প্রয়োগিক শিল্প যা রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয়। তাই স্থান, কাল, ঘটনা ও চরিত্রের সংহতি নাটকের একটি গুরুত্ব বিষয়। নাটকের আঙ্গিক ও গঠন কৌশলে ঐক্য থাকা প্রয়োজন। ঐক্যগুলো হলো-
১. স্থানের ঐক্য (Unity of place)
২. সময়ের ঐক্য (Unity of time)
৩. ঘটনার ঐক্য (Unity of action)

এ তিনটি ঐক্যের মিল সাধনে নাটক রচিত হয়। এখানে সময়ের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে যেকোনো একটি সময়ের পরিসরে ঘটে, স্থানের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে জীবনের একটি ঘটনা স্থানের মাঝে ঘটে। কোনো ঘটনা একটি স্থল ও সময়ের মাঝে ঘটে। আর এসব ঘটে একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে।

আসলে নাটক কোনো একক শিল্প নয়। নাটক যৌথ শিল্প। অর্থাৎ নাট্যকার, নির্দেশক অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চ, সংগীত, আলোক প্রক্ষেপণ, দর্শক-শ্রোতা-ইত্যাদি মিলে নাটক। তবে নাটকের, নির্দেশনা, সংলাপ ও অভিনয় দক্ষতার আলোকে একটি নাটকের সার্থকতা নিরূপণ করা হয়।

একটি নাটকে কয়েকটি আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে নাট্যকার সফল ও সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে চায়। নাটকের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- 
১. প্রারম্ভ,
২. প্রবাহ
৩. উৎকর্ষ,
৪. গ্রন্থিমোচন
৫. পরিণতি

এ ছাড়া প্রতিটি নাটকে বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাজন থাকে। প্রাচীন যুগে নাটক পাঁচ অঙ্ক বিশিষ্ট হতো। আর প্রতিটি অঙ্কে কয়েকটি দৃশ্য থাকত। আধুনিক যুগে এ সনাতন পদ্ধতি ভেঙে নানা বৈচিত্র্য এসেছে। এখন নাটকে পাঁচ অঙ্ক হয় না। দুই বা তিন অঙ্কের নাটক এ যুগে প্রাধান্য পেয়েছে। এ যুগে একাঙ্কিতা নামে এক ধরনের এক অঙ্কের নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। নাটক এখন মঞ্চের সীমানা পেরিয়ে বেতার ও টিভিতে স্থান করে নিয়েছে। নাটকের দৃশ্য ও চরিত্র কমে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে নাটকের প্রথাগত বিভাজন লোপ পেয়েছে। আজকাল নাটকে নানা প্রযুক্তিগত কৌশল ও অনেক অভিনব নাট্য বৃদ্ধির প্রয়োগ দেখা যায়।

নাটকের শ্রেণিবিভাগঃ
নাটকের বিষয়বস্তু ও জীবনবোধের আলোকে নাটককে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- ঐতিহাসিক নাটক, সামাজিক নাটক, রাজনৈতিক নাটক, রূপক নাটক, কাব্য নাটক, গীতি নাট্য ইত্যাদি।

ক. ঐতিহাসিক নাটক: ইতিহাস থেকে কোনো কাহিনি ঘটনা চরিত্র নিয়ে যদি কোনো নাটক রচনা করা হয়, তা হলে তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃতি না ঘটিয়ে নব রূপ দান করেন। যেমন- মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ডি. এল রায়ের ‘শাহাজাহান’, মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘রক্তপদ্ম’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মহাকবি আলাউল’ ইত্যাদি।

খ. সামাজিক নাটক: যে নাটক সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত হয় সে নাটককে সামাজিক নাটক বলা হয়। সামাজিক নাটক রচিত হয় সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, বিশ্বাস, সংস্কার, আচার-আচরণকে ভিত্তি করে। বাংলা নাট্য-সাহিত্যে সামাজিক নাটকের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আর সামাজিক নাটকের জনপ্রিয়তা ও অনেক বেশি। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’, গিরিশ চন্দ্র ঘোষের ‘হারানিধি’, ‘বলিদান’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিম’, সাইদ আহমদের ‘কালো বেলা’ ইত্যাদি।

গ. কাব্য নাটক: কাব্য ও নাটকের উভয়ের শর্ত পূরণ করে যে নাটক রচিত হয়, তাকে কাব্য নাটক বলা হয়। অর্থাৎ কাব্য গুণ ও নাট্যগুণের সমন্বয়ে রচিত হয় কাব্য নাটক। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ‘বিসর্জন’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য নাটক। বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী তরঙ্গিনী’ ও ‘কাল সন্ধ্যা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুল’ দীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কাব্য নাটক।

ঘ. গীতি নাট্য: নাচ, গান ও নাটক-এ তিন সুকুমার শিল্পের সমন্বিত রচনাকে গীতি নাট্য বলে। এখানে নাচের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর গানের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের খেলা’, ‘অচলায়তন’ ইত্যাদি এ পর্যায়ের নাটক।

ঙ. রূপক সাংকেতিক নাটক: যখন কোনো বাস্তব ঘটনা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করা যায় না, তখন রূপকের প্রয়োজন হয়। বিশেষ কোনো তত্ত¡ প্রকাশ বা অত্যন্ত গভীরতর কোনো তত্ত¡কে সত্য প্রকাশ করার জন্য নাট্যকার যখন রূপকের আশ্রয়ে নাটক রচনা করেন। তখন তাকে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’ ইত্যাদি রূপক সাংকেতিক নাটক।

নাটকের রসগত দিক থেকে নাটককে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এ জাতীয় নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে তীব্র বেদনায় ও বিরহে, এ নাটক বিয়োগান্ত । যেমন-
ক. ট্রাজেডি: ট্রাজেডি নাটকের মূলে থাকে ব্যক্তি ও আত্মার দ্বন্দ্ব, বিক্ষুব্ধ, তীব্র যন্ত্রণা ও হাহাকার। যেমন, ‘অদি পাউস’, ‘ম্যাকবেথ’, হ্যামলেট প্রভৃতি। 
খ. কমেডি: এ নাটকের পরি সমাপ্তি আনন্দ বা মিলনে।
গ. মেলোভূমা: এক ধরনের অতি নাটক। এটিও বিয়োগান্ত নাটক। 
ঘ. ট্রাজিকমেডি: এ নাটক ট্রাজেডি ধর্ম হাস্য রসের নাটক। 
ঙ. প্রহসন: ব্যক্তি ও সমাজের অসঙ্গতি দেখানোর জন্য ব্যঙ্গ বিদ্রূপের নাটক।

বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
পালাগান ও যাত্রা বাংলা নাটকের প্রাচীন উৎস। তবে আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে ইংরেজি নাটকের প্রভাবে। আর এর সূত্রপাত ঘটে আঠার শতকে। একজন রুশ নাগরিকের হাতে বাংলা নাটকের সূচনা। তাঁর নাম হেরাসিম লেবেদেফ। তিনি মুনশী গোলকনাথ দাসের সহযোগিতায় ‘The disguis’ এবং ‘Love is the best doctor’ নামে দুটো ইংরেজি প্রহসন বাংলায় অনুবাদ করেন। আর এগুলো কলিকাতায় মঞ্চায়ন হয় উনিশ শতকের মধ্য ভাগে। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে শেকসপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ, তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ এবং রাম নারায়ণের ‘কুলীন কুল সর্বস্ব’ বাংলা নাটকের প্রথম পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য নাটক।

আধুনিক বাংলা নাটকের জনক হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি তাঁর সার্থক নাটক। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ তাঁর দুটো সার্থক প্রহসন। সামাজিক নাটক প্রবর্তন করেন দীনবন্ধু মিত্র তাঁর রচিত ‘নীলদর্পণ’, ‘নবীন তপস্বিণী’ ‘সধবার একাদশী’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, ‘বসন্ত কুমারী’ এবং প্রহসন ‘এর উপায় কি’ ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক নাটক।

ঊনিশ শতকের শেষ দিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরুবিক্রম’, ‘সরেজনি’ ইত্যাদি নাটক এবং ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘হঠাৎ নবাব’, দায়ে পড়ে দারগ্রহ’ ইত্যাদি প্রহসন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 
এরপর বাংলা নাটকের হাল ধরেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অমৃতলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল প্রমুখ প্রতিভাধর নাট্যকারগণ। তাঁদের প্রতিভায় বাংলা নাটক সাফল্যের প্রাপ্ত সীমায় পৌঁছে। আজ বাংলা নাটকের গতিধারাবহতা নদীর মতো গতিশীল।

বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যে যারা সবচেয়ে তৎপর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন, আকবর উদ্দিন, ইব্রাহিম খাঁ, নূরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, সাইদ আহমদের নাম উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত নাট্যকারগণ সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটক রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শাহাদাৎ হোসেনের ‘সরফরাজ খাঁ, ‘নবাব আলীবর্দ্দী’, ‘আনারকলি’; আকবর উদ্দিনের ‘নাদির শাহ’, ‘সিন্ধু বিজয়’; ইব্রাহিম খাঁর ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’ এ যুগের ঐতিহাসিক নাটক।

নূরুল মোমেনের ‘নমেসিস’, ‘নয়াখান্দান’, ‘রূপান্তর’; আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘রক্তপদ্ম’; ‘এপার ওপার’; মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’, ‘নষ্ট ছেলে’; ‘মানুষ’; ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’; ‘দণ্ডকারণ্য’; শওকত ওসমানের ‘আমলার মামলা’, ‘কাঁকর মণি’; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তরঙ্গতঙ্গ’; আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ইহুদীর মেয়ে’, ‘মায়াবী প্রহর’, ‘মরক্কোর যাদুকর’; আনিস চৌধুরীর ‘মানচিত্র’, ‘এ্যালবাম’ এবং সিকান্দার আবু জাফরের ‘মহাকবি আলাওল’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ইত্যাদি নাটক বাংলাদেশের নাট্য সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের বিষয়-প্রকরণ ও আঙ্গিক পরিচর্যা পরিবর্তিত হয়। এ পর্বের নাট্যকারগণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিষয় করে প্রধানত নাটক রচনা করেছেন। সারা দেশে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়মিত নাটক প্রদর্শন, নাটক ও মঞ্চ সম্পর্কিত পত্রপত্রিকা প্রকাশের ফলে একটি নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ সময়ে বেশ কিছু প্রতিভাবান নাট্যকার আবির্ভূত হন। তাঁরা রচনা করেন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এবং দর্শক-নন্দিত নাটক।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে-মমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘বর্ণচোর’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘প্রেম বিবাহ সুটকেস’, ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’; আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখনই সময়’, ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘কোকিলারা’; মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, ‘এখানে নোঙর’, ‘ইবলিশ’, ‘ওরা আছে বলেই’, সেলিম আল দীনের ‘সর্প বিষয়ক গল্প’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘শকুন্তলা’; সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি। এসব নাটক বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফরের জন্ম ১৯১৮ সালে তেঁতুলিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা। খুলনা তালা বি.ডি. উচ্চ ইংরেজি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করার পর তিনি কলকাতার রিপন (সুরেন্দ্রানাথ) কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কলকাতার ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতে খড়ি।

পরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৩ পর্যন্ত রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্মরণীয় অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। তাঁর রচিত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সিকান্দার আবু জাফর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

সিকান্দার আবু জাফর রচিত সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে কাব্য: ‘প্রসন্ন প্রহর’ (১৯৬৫), ‘বৈরী বৃষ্টিতে’ (১৯৬৫), ‘তিমিরান্তিক’ (১৯৬৫), ‘বৃশ্চিক লগ্ন’ (১৯৭১), ‘বাংলা ছাড়’ (১৯৭২), ‘পূরবী’ (১৯৪৪), ‘নূতন সকাল’ (১৯৪৬)। নাটক: ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৫), ‘মাকড়সা’ (১৯৬০), ‘শকুন্ত উপাখ্যান’ (১৯৬২), ‘মহাকবি আলাওল’ (১৯৬৬)। পাঠ্যপুস্তক: ‘নবী কাহিনী’ (১৯৫১), ‘আওয়ার ওয়েলথ’ (১৯৫১)। নাট্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৬ সালে তাঁকে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। 
১৯৭৫ সালে ৫ আগস্ট সিকান্দার আবু জাফর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পটভূমি, চরিত্র-চিত্রণ ও সার্থকতাঃ
বাংলা বিহার উড়িষ্যার তরুণ নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যশাসনের কাল এক বছর ষোল দিন (১৯ জুন ১৭৬৫ থেকে ২ জুলাই ১৭৫৭)। এই সময় পরিসরে নানা প্রতিকূল ঘটনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি রচিত হয়।

এ নাটকে চার অঙ্কে মোট বারোটি দৃশ্যে কাহিনিকে সাজিয়েছেন নাট্যকার। সংঘটিত ঘটনাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করে কাহিনির মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য গতি দান করার চেষ্টা করেছেন লেখক, যা নাটকটিকে ঐতিহাসিক সত্যের খুব নিকটবর্তী করেছে।

‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রধান-অপ্রাধান মিলে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি চরিত্র আছে। চরিত্রের সংলাপ ও গতিবিধি বাস্তবানুগ করে চিত্রিত করা হলেও একথা সত্যি যে, নাটকের চরিত্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চরিত্রের হুবহু মিল থাকার কথা নয়। বাস্তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলায় কথা বলতেন না এবং রবার্ট ক্লাইভও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতেন কিনা সন্দেহ। উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, রাজবল্লভ এ নাটকে যেভাবে পদচারণা করেছে, বাস্তবে তাদের আচরণ হয়ত ঐ রকম ছিল না।

সিকান্দার  বলতে গিয়ে নাট্যকার যথেষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ তিনি নাটকের বশ, ইতিহাসের দাস নন। সিকান্দার আবু জাফর ইতিহাসের সত্যকে অবিকৃত রেখে ঐতিহাসিক চরিত্রের অনাবিষ্কৃত ও অনুদঘাটিত সত্য ও সৌন্দর্যকে সংস্থাপিত করেছেন। কারণ, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্র নিয়ে বিচিত্র জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। এসব জনশ্রুতির প্রভাব এড়িয়ে প্রকৃত সত্যেকে নতুনতর শিল্পমাত্রায় রূপ দান করা সত্যি দুরুহ। এই দুরুহ কাজটিকে সিকান্দার  আবু জাফর আপন প্রতিভার ঔদার্যে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। নাট্যকার নিজেই ভূমিকাতে বলেছেন-

১. সিরাজউদ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। 
২. প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদ্দৌলার জীবন নাট্য পুনঃনির্মাণ করেছি।
৩. ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদ্গুণ- এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।

সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজ’ তাই একাধারে দেশপ্রেমিক, জাতীয় বীর, সাহসী যোদ্ধা, প্রেমময় স্বামী, স্নেহশীল পিতা, একনিষ্ঠ ধার্মিক প্রভৃতি মহৎ গুণের অধিকারী।

‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মূল বিষয় যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে স্বয়ং সিরাজই নায়ক। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে তিনি ইংরেজদের তাড়িয়েছেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে সেখানে থেকে পালিয়েছেন। সিরাজের আপন খালা ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল প্রাসাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখার জন্য নিজ প্রাসাদে উঠিয়ে এনেছেন। কিন্তু সম্মানিতা আত্মীয়ের প্রতি তিনি অশ্রদ্ধা দেখান নি। খালাতো ভাই এবং রাজনৈতিক শত্রু শওকত জংকে তিনি পরাজিত ও নিহত করেছেন। তাঁর এক বছর ষোল দিন শাসন কালে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

তিনি কখনো যুদ্ধ ভয়ে ভীত হন নি। পলাশীর যুদ্ধ প্রান্তরেও সিরাজ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। নিজেই সেনাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন প্রভূত দেরি হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারীরা সিরাজ চরিত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেসব কলঙ্ক লেপন করেছেন তার বিপরীতে সিরাজ চরিত্রের নানা সদ্গুণাবলির আলোকে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয় বীর সিরাজকে নবনির্মাণ করেছেন সিকান্দার আবু জাফর। কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র-চিত্রণ ও দৃশ্য পরিকল্পনার দিক থেকে বিচার করলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটককে সার্থক ঐতিহাসিক নাটক না বলা গেলেও একটি শিল্পসার্থক নাটক বলা যায়।

চরিত্রলিপিঃ
সিরাজউদ্দৌলা: ওয়াট্স
মিরজাফর: ক্লেটন
রাজবল্লভ: কিলপ্যাট্রিক
উমিচাঁদ: জর্জ
জগৎশেঠ: মার্টিন
রায়দুর্লভ: হ্যারী
মোহনলাল: লুৎফুন্নিসা
মিরমর্দান: ঘসেটি বেগম
মিরন: আমিনা বেগম
মানিকচাঁদ: ইংরেজ মহিলা
রাইসুল জুহালা-
মোহাম্মদি বেগ: লবণ বিক্রেতা
সাঁফ্রে: কমর বেগ
ক্লাইভ-
ড্রেক: ওয়ালী খান
হলওয়েল-

নর্তকী, পরিচারিকা, নবাব সৈন্য, ইংরেজ সৈন্য, প্রহরী, নকীব, বার্তাবাহক ও নাগরিকবৃন্দ। 


 
সংক্ষেপে নাটকের কাহিনিঃ

প্রথম অঙ্ক: প্রথম দৃশ্য

১৭৫৬ সাল। ১৯ জুন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব কলকাতার ইংরেজ কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেছেন। নবাব সৈন্যের দুর্বার আক্রমণে দুর্গের অভ্যন্তরে ইংরেজদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তবু তাদের যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গের একাংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ সৈনিক নিয়ে কামান দাগাচ্ছেন।

ইংরেজ সৈনিকেরা নিস্তেজ, আতঙ্কগ্রস্ত। অধিনায়ক পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টর সমস্ত ছাউনি তছনছ করে ভাবি ভাবি কামান নিয়ে দুর্গের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে নবাব-সৈন্য। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে বন্যাস্রোতের মতো প্রবেশ করছে নগরে, গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে অগ্রসর হচ্ছে অমিত বিক্রমে; বাধা দেবার কেউ নেই। ক্যাপ্টেন মিন্ চিন দমদমের রাস্তায় নবাব-সৈন্যের গতিরোধ করতে সাহস পান নি।

তিনি কাউন্সিলার ফ্রাঙ্কল্যান্ড আর ম্যানিংহ্যামকে নিয়ে নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। হলওয়েল প্রবেশ করে ক্লেটনকে বলেন, কামান চালিয়ে কোনো ফল হবে না। তিনি তাঁকে পরামর্শ দেন গভর্নর ড্রেকের সাথে পরামর্শ করে নবাব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে। হলওয়েলের প্রস্তাব শুনে ক্লেটন বলেন, আত্মসমর্পণ করলেও নবাবের জুলুম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তিনি হলওয়েলকে দাঁড় করিয়ে ছুটে যান গভর্নর ড্রেকের কাছে।

হলওয়েলের হুকুমে বন্দি উমিচাঁদকে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়। নবাব-সৈন্যদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। কিন্তু উমিচাঁদ কঠোর স্বরে বলে, সে গভর্নর ড্রেকের ধ্বংস দেখতে চায়। এমন সময় জর্জ এসে জানায় যে, গভর্নর ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুনে উমিচাঁদ দুঃখিত হয়; কারণ ড্রেক তার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। সে বিদ্রূপাত্মক ভাষায় হলওয়েলকে বলে, ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিয়েছে, এ বড় লজ্জার কথা।

হলওয়েল হতাশায় ভেঙে পড়েন। তিনি উমিচাঁদের পরামর্শ চান। আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে আসে। উমিচাঁদ মানিকচাঁদের কাছে চিঠি লিখতে চলে যায়; বলে যায় হলওয়েল যেন দুর্গ-প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দেন। জর্জ এসে খবর দেয় একদল সৈন্য গঙ্গার দিকে ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে আর সে-পথ দিয়ে নবাবের পদাতিক বাহিনী হুড়হুড় করে প্রবেশ করেছ দুর্গের ভেতরে। হলওয়েলের আদেশে জর্জ সাদা নিশান উড়িয়ে দেয়।

এমনি সময় প্রবেশ করেন নবাব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ আর মিরমর্দান। মানিকচাঁদের আদেশে হলওয়েল তাঁর দলবল নিয়ে হাত তুলে দাঁড়ান। এমন সময় প্রবেশ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। হলওয়েল রাতারাতি কোম্পানির সেনাধ্যক্ষ বলে গেছেন দেখে নবাব অবাক হন। হলওয়েল বলেন, নবাব যেন তাঁদের ওপর অন্যায় জুলুম না করেন।

সিরাজ বলেন, ঘৃণ্য আচরণের জবাবে তাদের ওপর সত্যিকার জুলুম করতে পারলে তিনি সুখী হতেন, আর তাঁর আক্রমণের কথা শুনেই ড্রেক প্রাণভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তবু তার আচরণের জন্য যেকোনো একজনকে অবশ্যই কৈফিয়ৎ দিতে হবে। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথায়, তিনি তা জানতে চান। হলওয়েল বলেন, ইংরেজরা যুদ্ধ করতে চান নি, শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।

নবাব শ্লেষাত্মক স্বরে তাকে বলেন, আত্মরক্ষার জন্য কাশিমবাজারে কুঠিতে তারা অস্ত্র আমদানি করছিল। খবর পেয়ে তাঁর হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে ওয়ট্স্ আর কলেটকে। তিনি বন্দিদের তাঁর সামনে হাজির করতে হুকুম দেন রায়দুর্লভকে। বন্দিদের আনা হলে নবাব ওয়াট্সকে বলেন, তিনি জানতে চান, তাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে। কাশিমবাজারে তারা গোলাগুলি আমদানি করছে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তারা দখল করে নিচ্ছে, দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে, তাঁর নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দিয়েছে, বাংলার মসনদে বসার পর তারা তাঁকে নজরানা পর্যন্ত দেয় নি। এসব উল্লেখ করে তিনি জানান যে, ইংরেজদের এসব অনাচার সহ্য করবেন না।

ওয়াট্স জানান, তাঁর নবাবের অভিযোগ তাঁদের কাউন্সিলে পেশ করবেন। উত্তরে নবাব বলেন, ইংরেজদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ওয়াট্স তাঁকে বলেন, বাণিজ্যের অধিকার নবাব দেন নি, দিয়েছেন দিল্লীর বাদশাহ। নবাব বলেন, বাদশাহকে তারা ঘুষের টাকায় বশীভূত করে রেখেছে, তিনি তাদের অনাচার দেখতে আসেন না। হলওয়েল সবিনয়ে বলেন, নবাব আলিবর্দী তাদের বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছেন।

ওয়াট্স বলেন, তারা বাংলায় এসেছেন বাণিজ্য করতে, রাজনীতি করতে নয়; টাকা রোজগারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। নবাব উষ্ণ হয়ে বলেন, তারা বাণিজ্য করেন না, করেন লুন্ঠন; বাধা দিতে গেলই শাসন-ব্যবস্থায় আনতে চান ওলট-পালট; কর্ণাটকে, দক্ষিণাত্যে তাঁরা শাসন-ক্ষমতা করায়ত্ত করে লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করেছেন। বাংলাতেও তা-ই করতে চান তারা। তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও তারা কলকাতার দুর্গ সংস্কার বন্ধ রাখেননি। ওয়াট্স অজুহাত দেখান যে, তাঁরা ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চান। নবাব বলেন, ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজ খুব সজ্জন নয়।

ওয়াট্স বলেন, ইংরেজরা অশান্তি চায় না। নবাব কঠোর কণ্ঠে রায়দুর্লভকে হুকুম করেন,গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা যেন কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয়া হয় এবং গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে যেন ঘোষণা করা হয় যে, ইংরেজরা যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যান। আশপাশের গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হোক কেউ যেন ইংরেজের কাছে তাদের সওদা না বেচে, আর এ নিষেধ অমান্যকারীকে ভোগ করতে হবে ভয়ঙ্কর শাস্তি।

নবাব কলকাতার নাম আলীনগর রেখে রাজা মানিকচাঁদকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করতে হবে কোম্পানির প্রতিনিধিদের আর কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট কলকাতার প্রত্যেকটি ইংরেজকে।

ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে একটা মসজিদ তৈরি করতে নবাব হুকুম দিলেন মিরমর্দনকে। উমিচাঁদের কাঁধে হাত রেখে নবাব তাঁকে মুক্তি দিলেন। মিরমর্দানকে বললেন, রাজা রাজবল্লভের সাথে তাঁর একটা মিটমাট হয়ে গেছে, তাই কৃষ্ণবল্লভকে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা যেন করা হয়।

তিনি হলওয়েলকে বলেন, তাঁর সৈন্যদের তিনি মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু হলওয়েল তাঁর বন্দি। রায়দুর্লভকে হুকুম দিলেন কয়েদি হলওয়েল, ওয়াট্স আর কলেটকে নবাবের সাথে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। মুর্শিদাবাদে ফিরে তাঁদের বিচার করবেন।

প্রথম অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য

১৭৫৬ সাল, ৩ জুলাই। ভাগীরথী নদীতে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ। পলাতক ড্রেক, হ্যারী, মার্টিন প্রমুখ ইংরেজ পুঙ্গবেরা দলবলসহ আশ্রয় নিয়েছে সে জাহাজে। চরম দুরবস্থা তাদের। আহার্য দ্রব্য তারা পায় না। যৎসামান্য পায় চোরাচালানের মাধ্যমে। পরনে বস্ত্র নেই বললেই  চলে। সবারই এক কাপড় সম্বল। জাহাজের ডেকে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক ও দুজন ইংরেজ তরুণ পরামর্শ করছেন। ড্রেক বলেন, মাদ্রাজ থেকে কিলপ্যাট্টিক খবর এনেছেন, প্রয়োজনীয় সাহায্য আসছে, কিন্তু হ্যারী বলে, তার আগেই তাদের দফা শেষ হয়ে যাবে।

মার্টিন বলে যে, কিলপ্যাট্রিক এসেছেন মাত্র আড়াইশ সৈন্য নিয়ে; এ নিয়ে একটা দাঙ্গা করাও সম্ভব নয়, যুদ্ধ করে কলকাতা পুনরাধিকার করা যাবে না। হ্যারী বলে, লোকবল বিশেষ বাড়ে নি, কিন্তু দুর্লভ আহার্যের অংশীদার বেড়েছে। ড্রেক তাদের আশ্বাস দেন যে, আহার্যের জোগাড় কোনো রকমে করা যাবেই। মার্টিন কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে বলে, কাছে হাটবাজার নেই। নবাবের হুকুমে কেউ কোনো জিনিস ইংরেজদের কাছে বেচে না, চার গুণ দাম দিয়ে সওদাপাতি করতে হয় গোপনে। সে আরও বলে যে, তাদের এ দুর্দশার জন্য দায়ী গভর্নর ড্রেক।

ড্রেক নবাবকে উদ্ধত ভাষায় চিঠি লিখেছে, নবাবের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দিয়েছেন। উত্তরে ড্রেক বলেন যে, সব ব্যাপারে সবার নাক গলানো সাজে না। হ্যারী শ্লেষাত্মক ভাষার বলে, কৃষ্ণবল্লভের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ খাবেন ড্রেক, তাতে তাদের মাথা ঘামানো অবশ্যই উচিত নয়। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, ঘুষের অঙ্ক খুব মোটা হওয়াতেই নবাবের ধমকানি সত্ত্বেও ড্রেক কৃষ্ণবল্লভকে পরিত্যাগ করতে পারেন নি। মার্টিন অভিযোগ করে, ড্রেক তাঁদের ভাগ্যবিপর্যয় সম্পর্কে কাউন্সিলের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। টেবিলে ঘুষি মেরে ড্রেক তাঁকে ধমক দেন।

ড্রেক আরও বলেন, ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব তখনো তাঁর হাত ছাড়া হয় নি, ও জাহাজটাই তখন তাঁদের দুর্গ। একযোগে কাজ করার পরামর্শের জন্য তাঁদের ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তারা তেমন মর্যাদার পাত্র নন। মার্টিন  স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, তাঁরা ড্রেকের কর্তৃত্ব মানবে না। ড্রেক ক্ষেপে ধঢ়ড়ষড়মু দাবি করেন মার্টিনের কাছে, নতুবা তাকে কয়েদ করা হবে। ড্রেকের কথায় ইংরেজ মহিলা ছুটে এসে ড্রেককে বলেন, তিনি মেয়েদের নৌকায় কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাঁর এমন দম্ভ শোভা পায় না।

ড্রেক তাকে বোঝাতে চান যে, তারা তখন কাউন্সিলে বসেছেন। রমণী উত্তেজিত হয়ে বলেন, প্রাণ বাঁচাবার কোনো ব্যবস্থা নেই, অথচ কাউন্সিলে বসছেন, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন, প্রত্যহ শোনান কিছু একটা করা হচ্ছে, অথচ হচ্ছে শুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। ড্রেক তাকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করেন। রমণী প্রবোধ মানেন না। তিনি বলেন, এক প্রস্থ জামা-কাপড়ই সম্বল। ছেলে-বুড়ো সবাইকে তা খুলে রেখে রাতে ঘুমাতে হয়, কোনো আব্রু নেই।

এমন সময় হলওয়েল আর ওয়াট্স এসে উপস্থিত। হলওয়েল বলেন, মুর্শিদাবাদ পৌঁছে নবাব তাঁদের মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তি পেতে তাঁদের নানা ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে কানে খৎ দিতে হয়েছে। ওয়াট্স বলেন, কলকাতায় এখন ফেরা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে একটা ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে, অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে একটা উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। হলওয়েল বলেন, একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট যে, নবাব ইংরেজদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করতে চান না, তা চাইলে তখন কলকাতায়ও তাঁরা নিশ্চিত থাকতে পারবেন না।

তাঁরা নবাবের সাথে যোগাযোগের কিছুটা ব্যবস্থাও করে এসেছেন। তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। শুনে ড্রেক উল্লাস-ধ্বনি করেন। ওয়াট্স বলেন, মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও নবাবের কানে কথাটা তুলবেন। ড্রেক তখন হ্যারী আর মার্টিনকে বলেন, তিনি আশা করেন, তাদের মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। তিনি তাদের বুঝিয়ে বলেন, তাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে। হ্যারী আর মার্টিন বলে যে, তারা ঝগড়া করতে চায় না, তারা তাদের ভবিষ্যৎ জানতে চায়, একটা নিশ্চিত ফলাফল দেখতে চায়।

যে জায়গায় পলাতক ইংরেজরা আস্তানা গেড়েছেন তা নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর। মশার উপদ্রব অত্যন্ত বেশি। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ইতোমধ্যে কেউ কেউ মরেও গেছে। তবে সামরিক দিক দিয়ে জায়গাটার গুরুত্ব আছে। সমুদ্র কাছেই, কলকাতাও চল্লিশ মাইলের মধ্যে। প্রয়োজনমতো যেকোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে। কিলপ্যাট্রিকের মতে, কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে ফলতা জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ; নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল, সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই।

বিপদ যদি আসেই তবে আসবে কলকাতার দিক থেকে এবং সতর্ক হবার মতো সুযোগ পাওয়া যাবে। হলওয়েল জানায়, কলকাতার দিক থেকে তখনকার মতো বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তাঁর অনুমতি পেলে ইংরেজরা জঙ্গল কেটে ফলতায় হাট-বাজার বসিয়ে দেবে। ড্রেক দুঃখ করেন, নেটিভরা তাদের সাথে ব্যবসা করতে চায়, কিন্তু ফৌজদারের ভয়ে তা করতে পারছে না।

এমন সময় একটা লোক এসে ড্রেকের হাতে উমিচাঁদের পত্র দেয়। উমিচাঁদ লিখেছে, সে চিরকালই ইংরেজদের বন্ধু এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব সে অক্ষুণ্ণ রাখবে। মানিকচাঁদকে সে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। এজন্যে তাঁকে নজর দিতে হয়েছে বারো হাজার টাকা। টাকাটা উমিচাঁদ নিজের তহবিল থেকে দিয়ে দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করে পত্রবাহক মারফত পাঠিয়েছে। সে বারো হাজার টাকা ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যা ন্যায্য বিবেচিত হয় তা পত্রবাহকের মারফত পাঠিয়ে দিলে উমিচাঁদ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। সে পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার আশা রাখে।

হলওয়েল আর ওয়াটসের মতে, অনেক টাকার বিনিময়ে হলেও উমিচাঁদের সাহায্য হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। ড্রেক বলেন, উমিচাঁদের লাভের অন্ত নেই, মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্য সে সতেরো হাজার টাকা দাবি করেছে। তিনি হলফ করে বলতে পারেন যে, সে টাকার মধ্যে দু’হাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না, বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে। তিনি টাকাটা দিয়ে উমিচাঁদের লোকটাকে বিদায় করতে চলে যান।

ওয়াট্স বলেন যে, টাকার ব্যাপারে একা উমিচাঁদই দোষী নয়; মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মানিকচাঁদ সবাই হাত পেতে রয়েছে। কিলপ্যাট্রিকের মতে, দশ দিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।

ড্রেক আবার প্রবেশ করে জানান, আরেকটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। সে লিখেছে, শওকতজঙ্গের সাথে সিরাজের সংঘর্ষ আসন্ন। সে সুযোগ নেবেন মিরজাফর, জগৎশেঠ আর রাজবল্লভের দল। তাঁরা সমর্থন করবেন শওকতজঙ্গকে। ওয়াটসের মতে, তাঁদের শওকতজঙ্গকে সমর্থন করাটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ শওকতজঙ্গ নবাব হলে সবার উদ্দেশ্য হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নর্তকীদের নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকবেন শওকতজঙ্গ; উজির-ফৌজদাররা তখন যাঁর যা খুশি করতে পারবেন। ড্রেকের মতে, আগেভাগেই শওকতজঙ্গের কাছে ইংরেজদের ভেট পাঠানো উচিত।

হলওয়েল আর ওয়াট্স সদ্য কয়েদমুক্ত হয়ে এসেছেন। তারা বাতি চান, পেগ ভর্তি মদ চান। এ সময় নেপথ্য থেকে কে বলে ওঠে সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিনখানা, চারখানা, পাঁচখানা জাহাজ আসছে কোম্পানির। নিশ্চয়ই মাদ্রাজ থেকে সবাই নিজ নিজ গ্লাসে মদ ঢেলে নেয়।

প্রথম অঙ্ক: তৃতীয় দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ১০ অক্টোবর। ঘসেটি বেগমের বাসভবন। প্রৌঢ়া ঘসেটি বেগম জমকালো জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, বাদক আর নর্তকী। খানসামা তাম্বুল আর তামাক পরিবেশন করছে। এমন সময় আসরে প্রবেশ করে উমিচাঁদ, সঙ্গে একজন বিচিত্র বেশধারী মেহমান। ঠিক এ সময়, এক পর্যায়ের নাচ শেষে উপস্থিত সবাই করতালি দিতে থাকেন। ঘসেটি বেগম উমিচাঁদকে সমাদর করে বসতে দেন।

বিচিত্রবেশী লোকটার দিকে তাকাতেই উমিচাঁদ বলেন, তিনি একজন জবরদস্ত শিল্পী, তার সাথে পরিচয় অল্পদিনের। এর মধ্যে তার কেরামতিতে উমিচাঁদ মুগ্ধ, সেদিনকার জলসা সরগরম করতে সে লোকটাকে সাথে নিয়ে এসেছে। রাজবল্লভ অপরিচিত লোকের আবির্ভাব সন্দেহের চোখে দেখেন। উমিচাঁদ বলে, ভাবনার কোনো কারণ নেই, লোকটা দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে-জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ায়। জগৎশেঠ লোকটাকে তার কেরামতি দেখাতে আহবান করেন। তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় ঘসেটি বেগমের।

লোকটা গিয়ে দাঁড়ায় আসরের মাঝখানে। রাজবল্লাভ নাম জানতে চাইলে বলে নাম তার রাইসুল জুহালা। সবাই হেসে ওঠেন। রায়দুর্লভ ঠাট্টা করে বলেন, জাহেরদের রইস বলেই কি সে উমিচাঁদকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে? সবাই আবার হাসিতে ফেটে পড়তেই উমিচাঁদ বলেন যে, সে তো বেশ জাহেল, এ কারণে তাঁরা সব সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফটা শুকনো রাখেন, আর সে দুধের হাঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাঁড়ির কালি মেখে বনে যায় গুলবাঘা।

ঘসেটি বেগম তাদের কথা কাটাকাটিতে বাধা দেন। তাঁর হুকুমে রাইসুল জুহালা বলে, সে নানা রকম জন্তুজানোয়ারের কথা জানে, তবে সে তখন তাঁদের দেশের একটা নাচ- একটা বিশেষ শ্রেণির ধার্মিক পাখির নাচ দেখাবে সে। সমকালীন অবস্থা বিবেচনা করে সে বিশেষ নাচটি জনপ্রিয় করতে চায়। নৃত্য চলতে থাকে। এ সময় ঘসেটি বেগম আর রাজবল্লভ নিচুস্বরে পরামর্শ করেন। পরে উমিচাঁদ ও রাজবল্লভের সাথে আলোচনা চলে। নাচ শেষ হয়।

সবাই হর্ষধ্বনি করেন। রাজবল্লভ রাইসুল জুহালাকে আরো কিছু আনন্দ পরিবেশনের দায়িত্ব দেবার প্রস্তাব করায় উমিচাঁদ তার সাথে এক পাশে গিয়ে কিছু  কথাবার্তা বলেন। তারপর নিজের আসনে ফিরে এসে জানায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নৃত্যের কলা-কৌশল দেখবার ফাঁকে ফাঁকে দুচারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদানেও তার আপত্তি নেই। রাজবল্লভ তাকে দরকার মতো কাজে লাগাবেন বলে তখনকার মতো বিদায় করে দেন। তাঁর ইচ্ছায় নর্তকীরাও দলবল নিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন তাঁদের পরামর্শ শুরু হয়।

ঘসেটি বেগমের ইঙ্গিতে জগৎশেঠ বলেন, শওকতজঙ্গকে তাঁরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছেন, কিন্তু তিনি নবাব হলে জগৎশেঠ কী পাবেন? বেগম বলেন, শওকতজঙ্গ তো তাঁদেরই ছেলে, তিনি যদি নবাব হন তবে তারাই হবেন দেশের মালিক। রায়দুর্লভ কিছু বলতে গেলে জগৎশেঠ তাঁকে থামিয়ে দিতে গেলে রায়দুর্লভ বলেন, জগৎশেঠ তাঁর কথা শেষ হলে আর কোনো কথা ওঠাতে পারবেন না। রাজবল্লভ বলেন, তর্ক না করে খুব সংক্ষেপে তাঁদের কথা শেষ করতে হবে। তখনকার পরিস্থিতিতে কথা দীর্ঘায়িত হলে বিপদ ঘটতে পারে।

জগৎশেঠ বলতে থাকেন, নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি খোলাখুলি বেগমকে বলেন, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাং-এর গ্লাস আর নাচওয়ালী ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। কাজেই সে নবাব হবে নামে মাত্র, আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগমের হাতে, আর তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজা রাজবল্লভ। ঘসেটি বেগম আর রাজবল্লভ সম্পর্কে এমন একটা উক্তি করায় রায়দুর্লভ জগৎশেঠকে সতর্ক করে দেন; বলেন, এমন একটা ব্যাপারের জন্যই হোসেনকুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

জগৎশেঠ তখন বলেন যে, শওকতজঙ্গ নবাব হলে বেগম আর রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে, তাঁদের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, কাজেই তাঁরা চান নগদ লেনদেন। বেগম প্রতিবাদ করে বলেন, ধনকুবের জগৎশেঠকে টাকা দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খরচ চলবে না। উত্তরে জগৎশেঠ বলেন, তিনি নগদ টাকা চান না, যুদ্ধের খরচও তিনি তাঁর সাধ্যমতো চালাবেন, কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে তাঁকে লিখে দিতে হবে একটা কর্জনামা। কর্জনামা সই করে দিলেই তিনি নিশ্চিত হতে পারেন। রায়দুর্লভও তখন দাবি করেন একটা একরারনামা।

এমন সময় প্রহরী এসে বেগমের হাতে দেয় মিরজাফরের পত্র। তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে। শুনে রাজবল্লভ খুশি হয়। উমিচাঁদ জানান, মিরজাফরের প্রস্তাব তাঁর পছন্দ হয়েছে। ইংরেজরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠেছে। তারা সিরাজের পতন  চায়, শওকতজঙ্গ যদি ঠিক সে সময় আঘাত হানতে পারেন তবে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা তিনি পাবেন এবং জয় হবে অবধারিত। বেগমের মতে সিরাজের পতন সবাই চায়, তবে সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের প্রবল আশঙ্কা নিয়ে টিপ্পনী কাটেন বেগম।

উমিচাঁদ বলেন দওলত তাঁর কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়, তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করে ড্রেক তাঁর চিঠির জবাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, শওকতজঙ্গের যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সিরাজের সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানো হয় এবং ইংরেজদের মিত্র সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে, তা হলেই সিরাজের পতন হবে অনিবার্য। রাজবল্লভ বলেন, তাঁদের বন্ধু মিরজাফর রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছা করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।

হঠাৎ বাইরে শুরু হয় তুমুল কোলাহল। কে যেন বলে নবাব আসছেন। রাজবল্লভ আর ঘসেটি বেগম নর্তকীদের ডেকে জলসা সরগরম করে তোলেন। পর মুহূর্তেই জলসার আসরে ঢুকে পড়েন মোহনলালকে নিয়ে স্বয়ং নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজের ব্যঙ্গোক্তির জবাবে তাঁর খালাম্মা ঘসেটি বেগম বলেন, তাঁর বাড়িতে জলসা নতুন নয়। নবাব বলেন, নতুন না হলেও দেশের সবগুলো সেরা মানুষ সে জলসায় শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।

নবাব বলেন, তাঁর খালাম্মা নাচ-গানের মাহফিলের জন্যে দেওড়িতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছেন, তারা তো নবাবকে প্রায় গুলি করেই ফেলেছিল। দেহরক্ষী ফৌজ সাথে ছিল বলেই তিনি বেঁচে গেছেন। নবাব রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সবাইকে বিদায় দিতে গিয়ে বলেন, তিনি চিরদিনের জন্যে সে জলসা ভেঙে দিলেন তাঁর চারদিকে তখন ষড়যন্ত্রের জাল, তাই তখন নবাবের খালা আম্মার বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। তিনি তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন।

ঘসেটি বেগম ক্রুদ্ধ হন। তিনি সরোষে চিৎকার করে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দি করেছেন। তাঁর এত বড়ো স্পর্ধা হলো কি করে তা তাঁর বোধের অতীত। নবাব শান্ত কন্ঠে বলেন তাঁকে বন্দি করা হয়নি; প্রাসাদে তিনি তাঁর বোন সিরাজ-জননীর সাথে একসঙ্গে বাস করবেন। ঘসেটি বেগমের অনুরোধে রাজবল্লভ নবাবকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। নবাব উত্তপ্ত কন্ঠে বলেন যে, তিনি রাজবল্লভদের চলে যেতে বলেছেন। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল।

তাঁরা চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নবাব রায়দুর্লভকে বলেন, তিনি শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করেছেন। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে; তিনিও যেন প্রস্তুত থাকেন। প্রয়োজন হলে তাঁকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।

রায়দুর্লভ হুকুম শুনে নিষ্ক্রান্ত হন। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে ওঠেন। সিরাজ বলেন, মোহনলাল তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন, তাঁর কোনো অমর্যাদা হবে না। ঘসেটি বেগম উন্মাদিনীর মতো নবাবকে অভিশাপ দিতে থাকেন।

দ্বিতীয় অঙ্ক: প্রথম দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ১০ মার্চ। মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবার। মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ ও কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্স উপবিষ্ট, অস্ত্রসজ্জিত মিরমর্দান, মোহনলাল আর সাঁফ্রে দাঁড়ানো। দৃঢ় পদক্ষেপে প্রবেশ করেন সিরাজ। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নতশিরে শ্রদ্ধা জানান। সিংহাসনে বসে নবাব বলেন, কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্যে সভাসদদের সেদিনকার দরবারে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে।  রাজবল্লভ বলেন, দরবারে আগে জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি। নবাব উত্তর দেন যে, তার কারণ তখন পর্যন্ত তাঁকে কোনো জরুরি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।

তাঁর বিশ্বাস ছিল সিপাহসালার মিরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকবেন এবং তাঁর পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে না, অন্তত যাঁরা একদিন আলিবর্দীর অনুগ্রহভাজন ছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি তেমনটিই আশা করেছিলেন। মিরজাফর নবাবের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি নালিশ করছেন নিজের বিরুদ্ধে, বিচার করবেন তারা। বাংলার প্রজা-সাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে পারেন নি বলে তিনি তাদের কাছে অপরাধী।

জগৎশেঠ নবাবের অপরাধ কি তা জানতে চাইলে নবাবের ইঙ্গিতে দরবারে এনে হাজির করা হয় এক ব্যক্তিকে। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার মর্মন্তুদ দুরবস্থার প্রতিকার করতে রায়দুর্লভ তরবারি নিষ্কাষণ করেন। তাঁকে নিরস্ত্র করে নবাব বলেন, লোকটার সে দুরবস্থার জন্যে দায়ী তাঁর দুর্বল শাসন। উৎপীড়িত লোকটা জানায়, সে লবণ বিক্রি করেনি বলে কুঠির সাহেবরা তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, ওদের আরেক জন তার নখের ভেতরে খেজুরকাঁটা ফুটিয়েছে। তার বউকে ওরা খুন করেছে।

নবাব ওয়াটসের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, নবাবের নিরীহ প্রজার এমন দুরবস্থার জন্যে দায়ী কে এবং ওয়াট্স বলে তা সে জানে না। নবাব রেগে গিয়ে বলেন যে, ইংরেজদের অপকীর্তির সব খবরই তিনি রাখেন। কুঠিয়াল সাহেবরা দৈনিক কতগুলো নিরীহ প্রজার ওপর অত্যাচার করে তার হিসাব চান তিনি ওয়াটসের কাছে। ওয়াটস অপমান বোধ করে। সে বলে, দরবারে ইংরেজের প্রতিনিধি হয়ে দেশের কোথায় কি হচ্ছে তার কৈফিয়ত সে দিতে পারে না।

সিরাজ বলেন, ওয়াটস সত্যিকার প্রতিনিধি নয়, তাঁর এবং ড্রেকের পরিচয় তাঁর অজানা নেই। দুশ্চরিত্রতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে তাদের স্বদেশ থেকে নির্বাসিত না করে পাঠানো হয়েছে ভারতে বাণিজ্য করতে। এ দেশে এসে তারা দুর্নীতি আর অনাচারের পথ ত্যাগ করতে পারেনি নবাব ওয়াটসের কাছে। নিরীহ প্রজাদের ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচারের কৈফিয়ত দাবি করেন । ওয়ার্টস বলতে চায় যে, তারা ট্যাক্স দিয়ে শান্তিতে বাণিজ্য করে, প্রজাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

উত্তরে নবাব বলেন, ট্যাক্স দিয়ে বাণিজ্য করে বলে তারা তাঁর প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার অধিকার পায় নি। তিনি মিরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ সভাসদদের বলেন, তাঁদের পরামর্শেই তিনি কোম্পানিকে লবণের ইজারাদারী দিয়েছেন। তাঁরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, রাজস্বের পরিমাণ বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হবে। তিনি সভাসদদের জিজ্ঞেস করেন, বাংলার নবাব ব্যক্তিগত অর্থলালসায় বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে কুঠিয়ালদের প্রশ্রয় দিয়েছেন কিনা; তিনি অনাচারীদের বিরুদ্ধে শাসন-শক্তি প্রয়োগের সদিচ্ছা হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ।

সিরাজ জোর গলায় বলেন, সিপাহ্সালার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন। দরবারে বসে নবাবের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তাও তার স্মরণ নেই। তিনি সেই মুহূর্তেই সিপাহ্সালারকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করতে পারেন। মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ সবাইকে কয়েদখানায় আটক করতেও পারেন, আর শত্রুর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে তাঁকে তা করতে হবে, দুর্বলতা দেখালে চলবে না।

মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করেন, নবাব তাঁকে হাতের ইঙ্গিতে নিরস্ত করে আবার সভাসদদের বলেন, তিনি তা করবেন না। তিনি ধৈর্য ধারণ করবেন। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা আর শঠতার ওপর নবাব আর তাঁর সভাসদদের সম্প্রীতির ভিত প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সন্দেহের কোনো অবকাশ তিনি রাখবেন না। মিরজাফর বলেন, তাঁদের প্রতি নবাবের সন্দিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের অকল্যাণের কথা ভেবে তাঁরা উৎকণ্ঠা বোধ করবেন।

সিরাজ বলেন, দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণই সবচেয়ে বড়ো কথা। দেশের কল্যাণের পথেই তাঁরা আবার পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পারেন। তিনি জানতে চান, দেশের কল্যাণের পথে তাঁরা তাঁর সহযাত্রী হবেন কিনা। রাজবল্লভ নবাবের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে জানতে চাইলে নবাব বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়। কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলীনগরের সন্ধি খেলাপ করে তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসিদের চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এ বিদ্রোহ দমন না করলে একদিন ওরা মুর্শিদাবাদের মর্যাদার ওপর আঘাত হানবে।

মিরজাফর নবাবের হুকুম চাইলে সিরাজ বলেন, তিনি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ইচ্ছে করলে নবাবকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক, তিনি তা একাই বইবেন। শুধু একটি অনুরোধ, যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত না করেন।

মিরজাফর বলেন, দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে তাঁরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। সিরাজ আশ্বস্ত হন। তিনি বলেন, তিনি জানতেন যে, দেশের প্রয়োজনকে তাঁরা কখনও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। মিরজাফর সিরাজের হাত থেকে পবিত্র কোরান নিয়ে নতজানু হয়ে দুহাতে কোরান ছুঁয়ে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।

জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ নিজ নিজ প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করলেন তামা, তুলসী আর গঙ্গাজল ছুঁয়ে; উমিচাঁদ কসম করেন রামজীর নামে। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন সর্বশক্তি দিয়ে চিরকাল তাঁরা আজ্ঞা পালন করবেন বাংলার নবাবের।

সিরাজ ওয়াটসকে বলেন, আলীনগরের সন্ধির শর্তানুসারে তিনি ওয়াটসকে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওয়াট্স সে সম্মানের অপব্যবহার করে গুপ্তচরের কাজ করছে। তিনি তাঁকে সাজা দিলেন না, তবে বিতাড়িত করলেন তাঁর দরবার থেকে। তাকে বলে দিলেন ক্লাইভ আর ড্রেককে জানাতে যে, তিনি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন। নবাবের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেইমান নন্দকুমারকে ঘুষ দিয়ে তারা চন্দননগর ধ্বংস করেছে। সে ঔদ্ধত্যের যথাযোগ্য শাস্তি তাদের দেয়া হবে।

দ্বিতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ১৯ মে। মিরজাফরের আবাসগৃহ। মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ মন্ত্রণারত। জগৎশেঠ বলেন যে, মিরজাফর বড়ো বেশি হতাশ হয়ে পড়েছেন। মিরজাফর প্রতিবাদ করে বলেন যে, তিনি হতাশ হয়ে পড়েন নি, নিস্তব্ধ হয়ে আছেন অগ্নিগিরির মতো প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়ার জন্যে। তাঁর বুকের ভেতর আকাক্সক্ষা আর অধিকারের লাভা টগবগ করে ফুটছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য তাপে। তিনি তাঁর আঘাত হানবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজবল্লভ বলেন, প্রকাশ্য দরবারে সেদিনকার এত বড়ো অপমানের কথা তিনি কল্পনাও করেন নি।

মিরজাফর বলেন, সিরাজ সেদিন শুধু অপমান করেন নি, প্রাণের ভয়ে তাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। পদস্থ কেউ হলে সেদিন মানীর মর্যাদা বুঝতো, কিন্তু মোহনলালের মতো একটা সামান্য সিপাই যখন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে দাঁড়ায় তখন আতঙ্কে তিনি কেয়ামতের ছবি দেখেছিলেন। রায়দুর্লভ ফোঁড়ন কাটেন যে, সিপাহসালারের অপমানটাই সেদিন তার বুকে বেশি বেজেছিল। জগৎশেঠ অবাক হয়ে বলেন, চারদিকে বিপদবেষ্টিত হয়েও সিরাজ চান তাঁদের বন্দি করতে; সিংহাসনে স্থির হয়ে বসতে পারলে তো কথাই নেই। রাজবল্লভ বলেন, সিরাজ তাদের অস্তিত্বই লোপ করে দিতে চান। তাঁদের সম্বন্ধে নবাবের বাইরের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে যতখানি তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে অপ্রকাশিত। শওকতজঙ্গের ব্যাপারে নবাব তাঁদের কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি।

শুধু মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিনাশ করেছেন; এতে তাঁদের নিশ্চিন্ত বোধ করার কিছুই নেই। জগৎশেঠ বলেন, তাঁরা যে নিরাপদ নন, তার প্রমাণ তো হাতের কাছেই রয়েছে। নবাব তাঁদের বন্দি করতে যেয়েও করেন নি, কিন্তু রাজা মানিকচাঁদ তো ছাড়া পান নি। শেষ পর্যন্ত দশ লক্ষ টাকা খেসারাত দিয়ে তাঁকে মুক্তি কিনতে হয়েছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, নন্দকুমারের অদৃষ্টেও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। মিরজাফর জানান, তাঁদের কারো অদৃষ্টই মেঘমুক্ত নয়। মিরজাফর বলেন, কাজেই নবাবের উচ্ছেদের ব্যাপারে কালক্ষয় করা উচিত হবে না। রাজবল্লভ জানান যে, তাঁরা প্রস্তুত। নেতৃত্ব ন্যস্ত হয়েছে মিরজাফরের হাতে; তিনি কর্মপন্থার নির্দেশ দিলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

মিরজাফর বলেন যে, যদিও তাঁর ওপর তাঁদের সবার আন্তরিক ভরসা রয়েছে, তবু মনের সন্দেহটা দূর করার জন্যে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে পাকাপাকি করে নেয়া উচিত। এমন সময় রাইসুল জুহালা প্রবেশ করে বলে যে, মিরজাফরের নবাব হতে আর বেশি দেরি নেই। সে বলে, উমিচাঁদের চিঠি নিয়ে গিয়েছিল সে ক্লাইভের কাছে; ক্লাইভ তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করে কতল করতে চেয়েছিল; সে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সে অবশ্যি তখন উমিচাঁদের কাছ থেকে তার পত্র নিয়ে এসেছে। পত্রটা সে মিরজাফরের হাতে তুলে দেয়।

মিরজাফর পত্র পড়ে তা এগিয়ে দেন রাজবল্লভের দিকে। সবার হাত ঘুরে চিঠিটা আবার ফিরে আসে মিরজাফরের হাতে। মিরজাফর অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে চান। চিঠির জবাব দেবার আগে তিনি সরাতে চান রাইসুল জুহালাকে। জগৎশেঠের মতে তাঁদের নিজস্ব গুপ্তচরকেও বিশ্বাস করা যায় না। তারা মূল চিঠি হয়তো আসল জায়গাতেই পৌঁছে দিচ্ছে কিন্তু তার একখানা নকল হয়তো বা নবাবের লোকের হাতে গিয়ে পড়ছে। রাইসুল জুহালা ফোঁড়ন কেটে বলে, সন্দেহ করাটা অবশ্যি বুদ্ধিমানের কাজ, কিন্তু অতিরিক্ত সন্দেহে বুদ্ধিটা গুলিয়েও যেতে পারে। সে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গুপ্তচরেরাও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে, তাদের বিপদের ঝুঁকিও কম নয়।

জগৎশেঠ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, রাইস সম্পর্কে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি। মিরজাফর তাকে বিদায় দিয়ে বলেন, সে যেন তার সাংকেতিক মোহরটা উমিচাঁদকে দেয়। তাহলে তিনি রাইসের কথা বিশ্বাস করবেন। তাঁকে জানাতে হবে যে, পরবর্তী মাসের ৮ তারিখে দু’নম্বর জায়গায় তাঁদের সবকিছু লেখাপড়া হবে। রাইস মিরজাফরের সাঙ্কেতিক মোহর নিয়ে বেরিয়ে যায়। মিরজাফর তখন জগৎশেঠকে বলেন, রাইসুল জুহালা অত্যন্ত চতুর লোক। সে উমিচাঁদের বিশ্বাসী লোক। ওর সামনে জগৎশেঠের ওসব কথা বলা ঠিক হয় নি। জগৎশেঠ কৈফিয়তের সুরে বলেন, কি হতে পারে তাই শুধু তিনি বলেছন।

মিরজাফর বলেন, অনেক কিছুই হতে পারে। তাঁরা নিজেরাই তো দিনকে রাত করে তুলেছেন। তাদের চক্রান্তে নবাবের মীর মুন্সি আসল চিঠি গায়েব করে নকল চিঠি পাঠাচ্ছে কোম্পানির কাছে, তাতেই তারা অত সহজে ক্ষেপে উঠেছে। বুদ্ধিটা অবশ্যি রাজবল্লভের, কিন্তু নবাবের বিশ্বাসী মীর মুন্সি অসামান্য দায়িত্ব ও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে এটাও একবার ভেবে দেখা উচিত। জগৎশেঠের মতে, গুপ্তচরের সাহায্য ছাড়া তাঁরা এক পাও এগোতে পারতেন না।

মিরজাফর জানিয়ে দেন প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে তাঁর মনে একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি ভাবছেন ইংরেজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে কি না। রাজবল্লভ তাঁর কথায় সায় দেন। তাঁর মতে ইংরেজরা বেনিয়ার জাত, পয়সা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ওরা জানে নবাবের কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধার আশা তাদের নেই; তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা সিপাহসালারকে মসনদে বসাবার জন্যে সব রকম সাহায্যই দেবে। জগৎশেঠ টাকার লোক। তিনি বলেন, ইংরেজ সব রকমের সাহায্য দেবে বটে, কিন্তু টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। সিরাজকে গদিচ্যুত করা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজন, তবুও সিপাহ্সালারকে তারা সাহায্য দেবে নগদ টাকার বিনিময়ে।

রাজবল্লভের মতে, ইংরেজের প্রবল অর্থলোভও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি যতদূর শুনেছেন ইংরেজের দাবি দু’কোটি টাকার ওপরে যাবে। এত টাকা নবাবের তহবিল থেকে কিছুতেই পাওয়া যাবে না।

মিরজাফর রাজবল্লভকে জানিয়ে দেন, তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে পড়েছেন, তখন আর ও-কথা ভাববার সময় নেই, উপায়ও নেই। তাঁদের সবার স্বার্থেই ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আবেগে বিভোর হয়ে বলেন যে, স্বপ্ন তাঁর সফল করতেই হবে। বাংলার মসনদ- নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধত সিরাজের আমলে, মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু এই একটি কথাই ভেবেছেন- একটি দিন, শুধুমাত্র একটি দিনও যদি তিনি সে মসনদে বসতে পারেন, তবেই তাঁর জীবনের স্বপ্ন সফল হবে।

মিরজাফরের স্বপ্ন-সাধের একমাত্র প্রতিবন্ধক সিরাজ। তরুণ নবাবকে সরিয়ে সে মসনদ দখল করতে হবে। তার জন্যে যে-কোনো মূল্য দিতে মিরজাফর প্রস্তুত।

আবেগের আতিশয্যে মিরজাফর তাঁর অন্তরের গোপন কামনাকে সুস্পষ্টভাবে ও ভাষায় ব্যক্ত করেন। বাংলার স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ, কোরান হাতে নিয়ে প্রকাশ্য দরবারে শপথ গ্রহণ, নবাবের প্রতি কর্তব্য- সবকিছু ভুলে মিরজাফর তখন বাংলার মসনদের লোভে উন্মাদ, দৃঢ়সঙ্কল্প।

দ্বিতীয় অঙ্ক: তৃতীয় দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ৯ জুন। মিরনের আবাসগৃহ। ফরাসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে অর্ধশায়িত মিরন। নর্তকীর হাতে ডান হাত সমর্পিত। অপর নর্তকী নৃত্যরতা। নৃত্যের মাঝেমাঝে সুরামত্ত মিরনের উল্লাসধ্বনি। সে বলে নর্তকীরা আছে বলেই সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে তার ভালো লাগছে। নৃত্যরতা নর্তকী এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয় মিরনের দিকে। পরিচারিকা এসে একটা চিঠি দেয় মিরনের হাতে। চিঠি পড়ে বিরক্ত হয় সে। পাশে-বসা নর্তকী তার ইঙ্গিতে উঠে যায় কামরার অন্যদিকে। ছদ্মবেশধারী এক ব্যক্তিকে পৌঁছে দিয়ে পরিচারিকা নিষ্ক্রান্ত হয়।

মিরন বলে যে, সেনাপতি রায়দুর্লভ আসবেন তা সে ভাবেনি। তার ইঙ্গিতে নর্তকীরা চলে যেতে উদ্যত হয়। রায়দুর্লভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, মিরন তাঁকে নৃত্যগীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত বলেই ধরে নিয়েছে। মিরন প্রতিবাদ করে বলে যে, রায়দুর্লভ যখন ছদ্মবেশে এসে হাজির হয়েছেন তখনি সে বুঝেছে যে, প্রয়োজনটা জরুরি; তাই সে চায় না সময় নষ্ট করতে।

রায়দুর্লভ একটি নর্তকীকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন তাকে সে কোথায় পেয়েছে। তিনি বলেন, তাকে যেন আগেও কোথায় দেখেছেন। হঠাৎ মিরনের ওখানে বৈঠকের কথা হয়েছে শুনে তিনি এসেছেন। মিরন বলে, মোহনলালের গুপ্তচর তাদের জীবন অসম্ভব করে তুলেছে, তাই তার বাসগৃহেই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। মোহনলাল জানেন, মিরন নাচগানে মশগুল থাকতেই ভালোবাসে। বৈঠকে প্রয়োজনীয় সবাই আসবেন, আর আসবেন কোম্পানির একজন প্রতিনিধি। প্রতিনিধি আসবেন কাশিমবাজার থেকে।

রায়দুর্লভ জানান, তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না। তার পক্ষে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কখন কোন কাজে নবাব তলব করে বসবেন তার ঠিক নেই। তলবের সঙ্গে সঙ্গে হাজির না হলে সন্দেহ করবেন তিনি। তাই আগে-ভাগে জানতে এসেছেন, তাঁর সম্বন্ধে তাঁরা কি ব্যবস্থা করছেন। মিরন প্রত্যুত্তরে জানাল, রায়দুর্লভ সম্বন্ধে ব্যবস্থাটা পাকা করা হয়েছে; সিরাজের পতন হলে মসনদে বসবেন তার আব্বা আর রায়দুর্লভ হবেন প্রধান সেনাপতি।

রায়দুর্লভ বলেন যে, তাঁর দাবিটাও তাই, তবে চারদিকের অবস্থা দেখে যদি তিনি বোঝেন যে, তাঁদের সাফল্যের কোনো আশা নেই তখন যেন তাঁরা তাঁর সহায়তার আশা ছেড়ে দেন। মিরন বিস্মিত হয়; বলে, রায়দুর্লভকে যেন কিছুটা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। রায়দুর্লভ বলেন, তিনি আতঙ্কিত নন, তবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। চারদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র, তার মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না।

পরিচারিকা খরব দেয় যে, মেহমানেরা সবাই এসে পড়েছেন। মিরনের অনুরোধ সত্ত্বেও রায়দুর্লভ সরে পড়েন। যাবার সময় বলে যান যে, তাঁর সম্পর্কিত ওয়াদার যেন খেলাপ না হয়। কামরায় প্রবেশ করেন রাজবল্লভ, জগৎশেঠ আর মিরজাফর। মিরন জানায়, একটু আগে রায়দুর্লভ এসেছিলেন; ব্যক্তিগত কারণে তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না বলে গেছেন, তবে তাঁর দাবিটা খোলাখুলি বলে গেছেন।

রাজবল্লভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, সবাই উচ্চাভিলাষী। রায়দুর্লভ চান প্রধান সেনাপতির পদ, অথচ তিনি রাজবল্লভের কাছ থেকে মাসে মাসে যে বেতন পাচ্ছেন তাতেই তাঁর হাতে স্বর্গ পাবার কথা। মিরজাফর রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, সবাইকে একজোটে কাজ করতে হবে, মানতে হবে সবার দাবি। রায়দুর্লভের মতো ক্ষুদ্র শক্তিধরের সাহায্যেই তাঁরা জিতবেন, এমন কথা নয়; তবে প্রয়োজনের সময় নবাবের সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্ব প্রচুর।

ঠিক সেই সময় পরিচারিকা এসে জানায়, জানানা সওয়ারি এসেছে। শুনে সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়েন। মিরজাফর পকেট থেকে কয়েক টুকরা কাগজ বের করে তাতে মন দেন। মিরন লজ্জিত হয়। হঠাৎ আত্মসংবরণ করে ধমক দিয়ে পরিচারিকাকে তাড়িয়ে দেয়। রাজবল্লভের মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। তাঁর ইঙ্গিতে মিরন বেরিয়ে যায়। তিনি নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে বলেন সেদিনকার আলোচনায় উমিচাঁদের অনুপস্থিতিতে কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়।

মিরজাফর হঠাৎ খেই ধরে বলেন, উমিচাঁদ আস্ত কাল কেউটে; তার দাবি আগে না মেটালে সে পরদিনই নবাব দরবারে সব খবর ফাঁস করে দেবে। মিরন জানানাবেশী ক্লাইভ আর ওয়াটসকে নিয়ে প্রবেশ করে। মিরজাফরকে অবাক হতে দেখে ক্লাইভ কারণ জিজ্ঞেস করেন। মিরজাফর বলেন, তাঁদের ওভাবে সেখানে আসাটা বিপজ্জনক। ক্লাইভ তাঁকে ও জগৎশেঠকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি নবাবকে ভয় করেন না; নবাব তাঁর কিছুই করতে পারবেন না।

রাজবল্লভ বলেন, গাল ফুলিয়ে বড়ো বড়ো কথা বললেই হয় না। ক্লাইভ সেখানে একাকী এসেছেন, তাঁকে ধরে বস্তাবন্দি করে হুলো-বেড়ালের মতো পানাপুকুরে নিয়ে দুচারটে চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমানের দরকার হবে না। ক্লাইভ বলেন যে, তিনি রাজার কথা বুঝতে পারছেন না; নবাব তাঁদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবেন না।

ক্লাইভের মতে, নবাবের ক্ষমতা নেই। যাঁর প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক, যাঁর খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির-ওমরাহ্ সবাই প্রতারক, তাঁর কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। তবে রাজবল্লভরা ইচ্ছে করলে ইংরেজদের ক্ষতি করতে পারেন; কারণ তারা সব পারেন। সেদিন তারা নবাবকে ডোবাচ্ছেন, পরদিন যে তারা কোম্পানিকে পথে বসাবেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। ইংরেজরা বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারে।

মিরজাফর তাঁদের সভার উদ্দেশ্যের কথা উত্থাপন করলে ক্লাইভ বলেন, একটা জরুরি কথা প্রথমে সেরে নেয়া দরকার। তাঁর মতে, উমিচাঁদ সে-যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। ইংরেজদের মনের কথা সে নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। কলকাতা আক্রমণের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছে নবাব তা পুষিয়ে দিতে চেয়েছেন। বদমাসটা তাদের কাছে এসেছে আবার একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে। মিরজাফর শুনেছেন, সে আরো ত্রিশ লক্ষ টাকা চায়। ক্লাইভের মতে তাকে অত টাকা দেবার ক্ষমতা তাদের নেই; আর ক্ষমতা থাকলেও তাকে অতগুলো টাকা দেবার কোনো যুক্তি নেই।

রাজবল্লভ বলেন, উমিচাঁদ যেমন ধড়িবাজ তাতে সে অন্যরকম ষড়যন্ত্র করতে পারে। যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁদের যাবতীয় গোপন খবরই তার জানা। ক্লাইভ রাজবল্লভকে আশ্বস্ত করে বলেন, উমিচাঁদ অনেক বুদ্ধি রাখে, কিন্তু ক্লাইভও তার চেয়ে কম বুদ্ধি রাখে না। তিনি উমিচাঁদকে ঠকাবার ব্যবস্থা করেছেন। দুটো দলিল হবে; আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো উল্লেখ থাকবে না। নকল দলিলে লেখা থাকবে, নবাব হেরে গেলে কোম্পানি তাকে ত্রিশ লাখ টাকা দেবে।

উমিচাঁদকে ঠকাবার যে ব্যবস্থা ক্লাইভ করেছেন তা মিরজাফর, রাজবল্লভ প্রমুখ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। তারা যদি তা ফাঁস করে না দেন তবে তা কখনো প্রকাশ পাবে না। উমিচাঁদ যদি একথা জানে, তবে বুঝতে হবে তাঁরাই তাকে তা জানিয়েছেন। জগৎশেঠ ক্লাইভকে নিশ্চয়তা দেন যে, তাঁরা তা কখনো উমিচাঁদকে জানাবেন না।

ক্লাইভ বলেন যে, দলিলে কমিটির সবাই সই করেছেন, শুধু মিরজাফরই তখনো সই করেন নি। একটা নির্দিষ্ট স্থানে সই করবেন মিরজাফর; রাজবল্লভ আর জগৎশেঠ হবেন সাক্ষী। দলিলে লেখা ছিল যুদ্ধে সিরাজের পতন হলে কোম্পানি পাবে এক কোটি টাকা, কলকাতার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণ পাবে সত্তর লাখ টাকা, ক্লাইভ পাবেন দশ লাখ টাকা ইত্যাদি। সন্ধির শর্ত অনুসারে সিপাহ্সালার নামকাওয়াস্তে মসনদে বসবেন, কিন্তু রাজ্য চালাবে কোম্পানি- কথাটা বলেন রাজবল্লভ। ক্লাইভ চঞ্চল হয়ে ওঠেন, মিরজাফর ইতস্তত করেন। কিন্তু তিনি ভাবেন, এমনিতেই বাজারে নানা গুজব রটেছে, সিরাজ যে-কোনো মুহূর্তে সবাইকে গারদে পুরে দিতে পারেন।

তাই তিনি কম্পিত বক্ষে দলিলে সই করতে যান; কিন্তু মনের দ্বিধা তার কাটে না। ভাবেন, রাজবল্লভ যেমন বললেন, তারা সবাই মিলে বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছেন না তো! ক্লাইভ মিরজাফরকে কাপুরুষ বলেই জানেন। তার মতে, কাপুরুষদের ওপর কোনো কাজেই ভরসা করা যায় না। তাই তিনি দলিল সই করাতে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নিজেই এসেছেন, ওয়াট্সকে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন নি। তিনি মিরজাফরকে বুঝিয়ে বলেন, নবাব হেরে গেলে বাংলা মিরজাফরদেরই থাকবে। কোম্পানি রাজা হতে চায় না; চায় টাকা। তাদের কোনো ভয় নেই। তারা দেশের জন্যেই দেশের নবাবকে সরিয়ে দিচ্ছেন। নবাব থাকলে দেশের কল্যাণ হবে না।

ক্লাইভের কথায় মিরজাফর অনুপ্রাণিত হন। তিনি দলিলে সই করেন। বলেন, ক্লাইভ ঠিকই বলেছেন, কারণ নবাব তাদের সম্মান দেন না। জগৎশেঠ আর রাজবল্লভও সই করেন দলিলে। ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত হয়। দলিল ভাঁজ করতে করতে ক্লাইভ বলেন, তারা এমন কিছু করেছেন, যা একদিন ইতিহাস হবে। ক্লাইভ, ওয়াট্স রমণীর ছদ্মবেশ পরার পর সবাই বেরিয়ে গেলে প্রবেশ করে মিরন। সে পরিচারিকাকে সোল্লাসে বলে, পরদিন যুদ্ধ। তারপরে শাহজাদা মিরন, তারপর একদিন বাংলার নবাব। একটু পরে এসে পড়েন সেনাপতি মোহনলান।

মিরন তাঁকে জলসা-ঘরে প্রবেশ করেছেন বলে দোষারোপ করে। মোহনলাল মিরনকে জিজ্ঞেস করেন, সেখানে প্রচণ্ড ষড়যন্ত্র হচ্ছিল কিনা। শুনে মিরন যেন আকাশ থেকে পড়ে; বলে- মোহনলাল তার পিতার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। নবাবের সাথে তার পিতার সব গোলমাল প্রকাশ্যভাবে মিটে গেছে; নবাব তাঁকে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। এ অপবাদের বিচারপ্রার্থী হয়ে সে তখনই পিতাকে নিয়ে নবাবের কাছে যাবে।

মোহননলাল তরবারি কোষমুক্ত করে মিরনকে বলেন, সে যেন প্রতারণার চেষ্টা না করে। তিনি মিরনকে সতর্ক করে দিয়ে জানান, তাঁর গুপ্তচর কখনো ভুল সংবাদ দেয় না। তিনি জানতে চান, সেখানে কি হচ্ছিল, কে, কে ছিল সে মন্ত্রণা-সভায়। মিরন উত্তর দেয়, মন্ত্রণাসভা হচ্ছিল কিনা, হলেও কোথায় হচ্ছিল সে তার কিছুই জানে না। ওসব বাজে কাজে সময় কাটানোর স্বভাব তার নেই। সে নর্তকীকে ডেকে আবার জলসার আয়োজন করে। সে মালা হাতে নাচের ভঙ্গিতে মোহনলালের দিকে এগিয়ে যায়। মোহনলাল তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে মালাটি শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারির দ্বিতীয় আঘাতে তা শূন্যেই দ্বিখণ্ডিত করে নিষ্ক্রান্ত হন।

তৃতীয় অঙ্ক:  প্রথম দৃশ্য

১৭৫৭ সালের ১০ জুন থেকে ২১ জুনের মধ্যে যে কোনো একটা রাত। স্থান লুৎফুন্নেসার কক্ষ। লুৎফুন্নেসা ও আমিনা বেগম উপবিষ্ট। ঘসেটি বেগম প্রবেশ করে শ্লেষবিজড়িত কণ্ঠে বলেন যে, রাজ-মাতা আমিনা বেগম বড়ো সুখে আছেন। লুৎফুন্নেসা সাদর সম্ভাষণ জানান তাঁর খালা শাশুড়িকে। ঘসেটি বলেন, সুখী ও সৌভাগ্যবতী হবার দোয়া করলে তা তার জন্যে অভিশাপ বয়ে আনবে। আমিনা বেগম বড় বোনকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানান কাছে গিয়ে বসতে। ঘসেটি বেগম শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, তিনি বসতে অসেননি, এসেছেন কত সুখে আছেন বোন আমিনা বেগম পুত্র নবাব, পুত্রবধূ নবাব-বেগম শ্লেষপূর্ণ শাহজাদীকে নিয়ে তা দেখতে।

আমিনা বাধা দিয়ে বলেন, সিরাজ তো তাঁরও পুত্র, তিনিও তো তাঁকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। ঘসেটি আক্ষেপ করেন। বলেন, অদৃষ্টের পরিহাসে তিনি ভুল করেছিলেন। তিনি তখন জানতেন না যে সিরাজ বড়ো হয়ে একদিন তাঁর সুখের অন্তরায় হবে, অহরহ তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জানলে সেদিন দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতেন না। লুৎফা বলেন, তাঁরা ঘসেটি বেগমকে মায়ের মতো ভালোবাসেন, মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করেন।

ঘসেটি প্রতিবাদের সুরে বলেন, যিনি তাঁদের সত্যিকার মা তাঁকে নিয়ে তাঁরা চাঁদের হাট বসিয়েছেন। লুৎফুন্নেসা তাঁকে পরিহাস করছেন। তিনি দরিদ্র রমণী, নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নবাব সে অধিকারটুকুও তাঁকে দেন নি। ঘসেটির কথায় আমিনা বেগম বিরক্ত হন। তিনি বলেন, পুত্রবধূর সামনে তার এমন রূঢ় ব্যবহার অশোভন। ঘসেটি জবাবে বলেন যে, কেউ তাঁর পুত্র বা পুত্রবধূ নন। সিরাজ বাংলার নবাব, আর তিনি তাঁর প্রজা। সিরাজ ক্ষমতার অহঙ্কারে উন্মত্ত, তা না হলে তিনি তাঁর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করতেন না, মতিঝিল থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন না।

লুৎফুন্নেসা বলেন, তিনি শুনেছেন নবাব ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন কলকাতা অভিযানের সময় তাঁর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল বলে এবং গোলমাল মিটে গেলে তিনি তার টাকা ফেরত দেবেন বলে। ঘসেটি কথাটা বিশ্বাস করেন না। লুৎফুন্নেসা বলেন, সে টাকা ফেরত না দেবার কোনো কারণ নেই। নবাব সে টাকা ব্যয় করেছেন দেশের প্রয়োজনে। ঘসেটি ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সিরাজকে বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, কিন্তু তার সম্বন্ধে লুৎফুন্নেসার মুখে বড়ো কথা শুনলে গায়ে তার জ্বালা ধরে যায়। আমিনা বলেন, সিরাজ তার কোনো ক্ষতি করেন নি। কিন্তু ঘসেটি বলেন, তাঁর নবাব হওয়াটাই তাঁর ক্ষতি। আমিনা দুঃখিত হন। তিনি বলেন, তাঁর বড়ো আপা অনর্থক বিষ উদ্গীরণ করে চলেছেন; তাঁর এমন ব্যবহারের অর্থ তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।

সিরাজ ঘরে ঢুকে খালাকে বলেন, তিনি একটা দিনও সুখে নবাবী করেন নি। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে খালাম্মার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তাঁর আরো কিছু টাকার দরকার। তিনি জানেন, বাংলার ভাগ্য নিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা চলছে তার সব খবরই ঘসেটি বেগম জানেন। সিরাজকে দেখে, বিশেষ করে তিনি টাকা চাইতে এসেছেন বলে ঘসেটি তাঁকে শয়তান বলে, অত্যাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে খালাম্মার আক্রোশ নয়, তাঁর খালাম্মা রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের উন্মাদিনী। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন খালাম্মার সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করতে তাঁকে যেন বাধ্য করা না হয়।

ঘসেটিও তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, তাঁর চোখে রাঙানোর স্পর্ধা আর বেশি দিন থাকবে না। উত্তরে সিরাজ বলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ ভেবে তাঁর খালাম্মার উৎকন্ঠিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। সিরাজ তাকে তার নিজের সম্বন্ধে সতর্ক করে দেন। তিনি তাঁর খালাম্মাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নবাবের মাতৃস্থানীয় হয়ে তাকে শত্রুদের সাথে যোগাযোগ রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। অন্তত সিরাজ তাকে সে দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে চান। ঘসেটি বলেন নবাবের মতলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

নবাব তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় কোনো ক্ষমতাভিলাষী স্বার্থপরায়ণ রমণীর পক্ষে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর; তিনি তাই তাঁর গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখার ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের প্রাসাদে ঘসেটির স্বাধীনতার ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, তবে লক্ষ রাখা হবে যাতে দেশের তৎকালীন অশান্তি দূর হবার আগে বাইরের কারও সাথে তিনি কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারেন।

ঘসেটি বুঝতে পারেন নবাবের উদ্দেশ্য ও মতলব। তিনি নবাব জননীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বিরক্ত হয়ে তাঁকে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দিনী করেছেন। এবার আমিনা তা বুঝতে পেরেছেন তিনি নবাবের কেমন মা আর নবাব ঘসেটির কেমন পুত্র। এই বলে তিনি সরোষে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে যান। আমিনা বেগমও তাঁর বড়ো আপাকে ডাকতে ডাকতে তাঁর পেছনে পেছনে বেরিয়ে যান।

লুৎফুন্নেসা নবাবকে বলেন, খাল্লাম্মা বড়ো বেশি অপমান বোধ করছেন। তাঁর সাথে নবাবের অমন ব্যবহার করাটা হয়তো উচিত হয় নি। নবাব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, তাঁর ব্যবহারে সবাই অপমান বোধ করেছেন, শুধু তাঁর নিজেরই কোনো অপমান নেই। তিনি বলেন, তাঁর জীবন-সঙ্গিনী লুৎফুন্নেসাও যদি অমন অন্ধ হন তবে তিনি আশ্রয় পাবেন না কোথাও। তিনি বেগমকে বলেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন না শুধু অপমানই নয় নবাবকে ধ্বংস করার জন্যে সবাই কেমন মেতে উঠেছে। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খালাম্মাই খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি।

খালাম্মা তাঁর নিজের বোনের ছেলের ধ্বংস করতে চান কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন বলেই মনে করেন লুৎফুন্নেসা। তবে তিনি নবাবকে বলেন, খালাম্মার মন যে তার ওপর যথেষ্ট বিষিয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। অত্যন্ত সংকোচের সাথে তিনি স্বামীকে বলেন, খালাম্মা বিধবা মেয়ে মানুষ, তাঁর সম্পত্তিতে নবাব বার বার অমন হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভরসা নষ্ট হবারই কথা। লুৎফুন্নেসা তাঁর কাজের সমালোচনা করছেন দেখে নবাব ক্ষুব্ধ হন। লুৎফুন্নেসা কৈফিয়তের সুরে বলেন, তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার জন্যে কোনো কথা বলেননি।

খালাম্মা রেগে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন, তাই তিনি ও কথা বলেছেন। নবাব তাঁকে বাধা দিয়ে অভিমান-ক্ষব্ধু কণ্ঠে বলেন, তাই বুঝি লুৎফার মনে হলো, নবাব তাঁর টাকা-পয়সায় হাত দিয়েছেন বলেই তিনি নবাবের ওপর অতখানি বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু লুৎফুন্নেসা জানেন না, কতোখানি উৎসাহ নিয়ে তিনি শওকতজঙ্গের সফলতার জন্যে অজস্র অর্থ ব্যয় করেছেন। শুধু শওকতজঙ্গ নয়, নবাবের শত্রুদের শক্তিবৃদ্ধির জন্যেও ঘসেটি বেগমের দান কম নয়।

লুৎফুন্নেসা নিজের ভুল বুঝতে পেরে নবাবের কাছে ক্ষমা চান। নবাব তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর চারপাশে অতো দেয়াল কেন? উজির, অমাত্য সেনাপতিদের এবং তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেশের নিশ্চিন্ত শাসন-ব্যবস্থা এবং নবাবের মাঝখানে দেয়াল, খালাম্মা আর তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেয়াল তাঁর চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে, তাঁর অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল। তিনি সে-সব দেয়ালের কোনোটি ডিঙিয়ে যাচ্ছেন, কোনোটি ভেঙে ফেলছেন, কিন্তু তবু দেয়ালের শেষ হচ্ছে না। মসনদে বসার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন দু’পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তিনি লুৎফুন্নেসার কথায় সায় দিয়ে বলেন, সত্যিই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
 
লুৎফুন্নেসা তাঁকে সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর কাছে দু’একদিন বিশ্রাম নিতে বলায় নবাব বলেন, কবে যে তিনি দু’দণ্ড বিশ্রাম পাবেন তার ঠিক নেই; আবারও তাঁকে যেতে হচ্ছে যুদ্ধে। শুনে লুৎফুন্নেসা ভীত হন। নবাব বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোম্পানির আয়োজন সম্পূর্ণ। তিনি এগিয়ে গিয়ে বাধা না দিলে তারা সরাসরি রাজধানী আক্রমণ করবে। তাদের সাথে আলীনগরে যে সন্ধি হয়েছিল সে সন্ধি এক মাস না যেতেই তারা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। আর বিদেশি বেনিয়াদের অতদূর স্পর্ধা হয়েছে তাঁর ঘরের লোক অবিশ্বাসী হয়েছে বলেই। তিনি শুধু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারছেন না, ধর্মের নামে ওয়াদা করে মিরজাফর, রাজবল্লভেরা কি করে সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। তাঁদের কাছে স্বার্থ কি ধর্মের চেয়েও বড়ো?

লুৎফুন্নেসার প্রশ্নের উত্তরে নবাব তাঁকে জানান যে, ওসব ষড়যন্ত্রের কোনো প্রতিকার করতে পারেন নি। তিনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ভরসা পাননি। রাজবল্লভ, জগৎশেঠকে কয়েদ করলে, মিরজাফরকে ফাঁসি দিলে হয়তো প্রতিকার হতো, কিন্তু সেনাবাহিনী তা বরদাস্ত করতো কিনা তা অনিশ্চিত।

লুৎফুন্নেসা নবাবের সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে ব্যাকুলভাবে প্রস্তাব করেন সেদিন নবাব যেন তাঁর কাছে বিশ্রাম নেন, শুধু তিনি আর নবাব থাকবেন, আর কেউ না। নবাব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, তেমন একটা বিশ্রামের কথা অনেক সময় তিনি নিজেও ভেবেছেন। তিনি বেগমের কাছে বহুদিন আসতে পারেননি। তাঁদের মাঝখানে একটা রাজত্বের দেয়াল। মাঝে মাঝে তিনি কামনা করেছেন বাধাটা দূর হয়ে যাক। তাহলে নিশ্চিন্ত সাধারণ গৃহস্থের ছোট্ট সাজানো সংসার তাঁরা পেতেন। মোহনলালের কাছ থেকে খবর এলে সিরাজ লুৎফুন্নেসার বাধা না মেনে বেরিয়ে যান।

তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ২২ জুন। পলাশীতে সিরাজের শিবির। গভীর রাতে চিন্তাক্লিষ্ট নবাব পায়চারী করেছেন। দূর থেকে ভেসে আসছে শৃগালের প্রহর ঘোষণার শব্দ। নবাব বলেন, রাতের দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। ঘুম নেই শুধু শেয়াল আর সিরাজের চোখে। ভেবে তিনি অবাক হয়ে যান........।

মোহনলাল এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ান। তিনি মোহনলালকে বলেন, সত্যিই তিনি ভেবে অবাক হয়ে যান। তিনি শুনেছেন ইংরেজ সভ্য জাতি। তারা শৃঙ্খলা জানে, শাসন মেনে চলে, কিন্তু পলাশীতে তারা যা করছে, সেতো স্পষ্ট রাজদ্রোহ, একটা দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরেছে, ভেবে তিনি অবাক হন।

 মোহনলাল নবাবকে জানান, ইংরেজের পক্ষে মোট সৈন্য তিন হাজারের বেশি হবে না। তারা অবশ্যি অস্ত্র চালনায় সুশিক্ষিত। নবাবের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ছোটবড়ো মিলে ইংরেজের কামান হবে গোটা দশেক, আর নবাবের কামান পঞ্চাশটার অধিক। মোহনলাল বলেন, তাঁর সব সৈন্য লড়বে কিনা, সব কামান গোল বর্ষণ করবে কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। মোহনলালের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নবাব বলেন, তিনিও তেমন একটা আশঙ্কা করছেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ নিজ নিজ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে, তাঁরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বেন।
 
মোহনলাল বলেন, মিরজাফরের আর একখানা পত্র ধরা পড়েছে। তিনি পত্রখানা নবাবের হাতে দেন। চিঠি পড়ে নবাবের মুখে উচ্চারিত হয় ‘বেঈমান’। মোহনলাল বলেন, ক্লাইভেরও তিনখানা পত্র ধরা পড়েছে। সে মিরজাফরের জবাবের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে বেলে মনে হয়। সিরাজ বলেন, সাংঘাতিক লোক ক্লাইভ। মতলব হাসিল করবার জন্যে সে যে-কোনো অবস্থার ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে সবকিছুই যেন একটা বড়ো রকমের জুয়াখেলা। মিরমর্দান প্রবেশ করে বলেন, ইংরেজ সৈন্য লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। ক্লাইভ আর তার সেনাপতিরা উঠেছে গঙ্গাতীরের ছোট বাড়িটায়। সেখান থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে।

নবাব জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের ফৌজ সাজাবার আয়োজন শেষ হয়েছে কিনা। একটা প্রকাণ্ড নকশা নবাবের সামনে মেলে ধরে মিরমর্দান বলেন, তাঁরা সব গুছিয়ে ফেলেছেন। নবাবের ছাউনির সামনে গড়বন্দি হয়েছে, ছাউনীর সামনে মোহনলাল, সাঁফ্রে আর তিনি নিজে। আর ডানদিকে গঙ্গার ধারে ঢিপিটার ওপরে একদল পদাতিক তাঁর জামাতা বদ্রী আলী খাঁর অধীনে যুদ্ধ করবে। তাদের ডান পাশে গঙ্গার দিকে একটু এগিয়ে নৌবেসিং হাজারীর বাহিনী। বাঁ-দিক দিয়ে লক্ষবাগ পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকারে সেপাই সাজিয়েছেন সিপাহ্সালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁ।

নকশার কাছ থেকে সরে এসে নবাব পায়চারী করে বলেন, তাঁর শক্তিটা কত বড়ো অথচ কতই না তুচ্ছ। তিনি ভাবছেন অঙ্কের হিসেবে শত্রুর যেন সুবিধের পাল্লাটা ভারি হয়ে উঠেছে। মিরমর্দান বলেন, ইংরেজকে ঘায়েল করতে সাঁফ্রে, মোহনলাল আর তিনিই যথেষ্ট। সিরাজ তাঁকে বলেন, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তিনি জানেন, তাঁদের বাহিনীতে পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার আর আট হাজার পদাতিক সৈন্য রয়েছে আর তারা জান দিয়ে লড়বে, কিন্তু মিরজাফরদের বাহিনী সাজিয়েছে দূর লক্ষবাগের অর্ধেকটা ঘিরে। যুদ্ধে মিরমর্দানেরা হারতে থাকলে তারা দু’কদম এগিয়ে ক্লাইভের সাথে হাত মেলাবে বিনা বাধায়, আর তাঁরা যদি না হারেন তবে মিরজাফরদের সৈন্যরা যে তাদের ওপর গুলি চালাবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তবু তিনি ওদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ তাদের চোখে চোখে না রাখলে তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দখল করতো। মিরমর্দান নবাবকে ভরসা দিয়ে বলেন, তাদের জীবন থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না। নবাব বলেন, সে কথা জানেন বলেই আরো বেশি করে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভাবছেন, তাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না- এ চিন্তাটাই বেশি পীড়াদায়ক।

মিরমর্দান নবাবকে আশ্বাস দেন, তাঁদের জয় হবে। সিরাজ বলেন, পরাজয়ের কথা তিনিও ভাবছেন না, তিনি শুধু অশুভ সম্ভাবনাগুলো শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখছেন। পরদিন যুদ্ধ করবে মিরমর্দানেরা অথচ হুকুম দেবেন মিরজাফর। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এড়াবার জন্যে যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব সিপাহ্সালারকে দিতেই হবে। তার ফল কি হবে কেউ তা জানে না। নবাব কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না এবং কেন পারছেন না তা মিরমর্দান বুঝেছেন বলেই তিনি আশা করেন।

নবাব বলেন, সেনাবাহিনীর শক্তির ওপর নয়, তাঁর একমাত্র ভরসা পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সে সম্ভাবনাটুকুর ওপর।

রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। সিরাজ সবাইকে বিশ্রামের জন্যে বিদায় দিয়ে পায়চারী করেন। সোরাহী থেকে পানি ঢেলে খান। তারপর রেহেলে রাখা কোরআন শরীফের কাছে গিয়ে জায়নামাজে বসেন। কোরআন শরীফ তুলে ওষ্ঠে ঠেকিয়ে রেহেলের ওপর রেখে পড়তে থাকেন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। শুনে কোরআন শরীফ মুড়ে রাখেন তিনি। ‘আস্সালাতো খায়রুম মিনান্নাওম’; এরপর মোনাজাত করেন। হঠাৎ সুতীব্র তুর্যনাদ নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দেয়।

তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় দৃশ্য 

১৭৫৭ সাল, ২৩ জুন। পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র। সিরাজ নিজের তাঁবুতে পায়চারী করেছেন। প্রহরী এসে জানায় যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ইংরেজ ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্যরা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মিরমর্দান আর মোহনলাল সসৈন্যে পশ্চাদ্ধাবন করে লক্ষবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় সৈনিক এসে জানায় যে, সেনাপতি নৌবেসিং হাজারী ঘায়েল হয়েছেন। তৃতীয় সৈনিক এসে বলে, একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভিজে নবাবের বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। সেনাপতি মিরমর্দান তাই কামানের অপেক্ষা না করে হাতে হাতে লড়বার জন্যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন। শত্রুদের সময় দিতে চান না বলেই তিনি শুধু তলোয়ার নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।

দ্রুত সৈনিক এসে খবর দেয় সেনাপতি বদ্রী আলী খাঁ নিহত। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ। সিরাজ বলেন, মিরমর্দান ও মোহনলাল রয়েছেন কোনো ভয় নেই।

হঠাৎ সাঁফ্রে প্রবেশ করে উৎকণ্ঠিত নবাবকে বলেন, নবাব সৈন্যের তখন পর্যন্ত পরাজয় না হলেও যুদ্ধের অবস্থা তাঁদের জন্যে খারাপ হয়ে উঠেছে। সিরাজ তাঁকে রণক্ষেত্রে যেয়ে যুদ্ধ করতে ও জয়ী হতে নির্দেশ দেন। সাঁফ্রে বলেন, তিনি তো ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। প্রয়োজন হলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবেন, কিন্তু নবাবের বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজ দৃঢ়তায় সাথে বলেন, মিরজাফর, রায়দুর্লভদের বাদ দিয়েও সাঁফ্রে, মিরমর্দান প্রমুখ যুদ্ধে জিতবেন। তিনি জানেন, জয় হবেই।

সাঁফ্রে জানান, তাদের গোলার আঘাতে কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় এলো বৃষ্টি এবং হঠাৎ জাফর আলী খাঁ হুকুম দিলেন তখন যুদ্ধ হবে না। মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে চান নি, কিন্তু সিপাহসালরের আদেশ পেয়ে পরিশ্রান্ত সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরতে থাকে। সুযোগ পেয়ে কিলপ্যাট্রিক তখনি তাদের আক্রমণ করে। মিরমর্দান তাদের বাধা দিচ্ছেন, কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। তাঁকে এগুতে হচ্ছে কামান ছাড়া। এমন সময় সৈনিক খরব দেয় সেনাপতি মিরমর্দান নিহত হয়েছেন। সাঁফ্রে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আচ্ছন্নের মতো সিরাজ বলেন, সেনাপতি মিরমর্দানের পতন হয়েছে। সাঁফ্রে বলেন, ‘The bravest soldier is dead’. তিনি চলে যান এবং কথা দিয়ে যান ফরাসিরা প্রাণপণে লড়বে। সিরাজ বলেন, সাঁফ্রে ঠিকই বলেছেন শ্রেষ্ঠ সৈনিকের পতন হয়েছে। নৌবেসিং, বদ্রী আলী, মিরমর্দান নিহত। হঠাৎ মনে পড়ে আলীবর্দীর সাথে থেকে যুদ্ধ তিনিও করেছেন, বাংলার সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক তিনি।

যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি উপস্থিত নেই বলেই পরাজয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। তিনি সৈনিককে হুকুম করেন তাঁর হাতিয়ার নিয়ে আসতে, তিনি যুদ্ধে যাবেন; এতোদিনের ভুল সংশোধন করার সে সুযোগ তাঁকে নিতে হবে। এমন সময় মোহনলাল প্রবেশ করে জানান, পলাশীতে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তখন আর আত্মভিমানের সময় নেই। নবাবকে অবিলম্বে ফিরে যেতে হবে রাজধানীতে। মিরজাফরের কৈফিয়ৎ চাইবারও সুযোগ নেই, সে ততক্ষণে হয়তো ক্লাইভের সাথে যোগ দিয়েছে। নবাব যেন এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করেন; মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে তাঁকে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে। নবাবকে একাই ফিরে যেতে হবে; কারণ মোহনলাল আর সাঁফ্রের যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। মোহনলালের শেষ যুদ্ধ পলাশীতে।

মোহনলাল চলে গেলে নবাব আত্মগতভাবে বলেন, মোহনলালের সাথে তাঁর আর দেখা হবে না। তার কথামতো নবাবকে একাকীই প্রস্তুতি নিতে হবে নতুন করে। সবকিছু প্রস্তুত ছিল; সিরাজ রাজধানী অভিমুখে বেরিয়ে পড়লেন। যাবার আগে মোহনলালের জন্যে নির্দেশ রেখে গেলেন, মীরমর্দানের লাশ যেন উপযুক্ত মর্যাদায় মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

তুমুল কোলাহলের মধ্যে সসৈন্যে প্রবেশ করেন ক্লাইভ, মিরজাফর, রাজবল্লভ আর রায়দুর্লভ। সিরাজের প্রহরীরা বন্দি হয়। ক্লাইভ তাদের সিরাজের খবর জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু তারা নিরুত্তর। রাইসুল জুহালাকে বুটের লাথি মারেন ক্লাইভ। সে হেসে উঠে বাংলার সিপাহ্সালারকে জিজ্ঞেস করে, যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় হয়েছে কিনা। ক্লাইভ তাকে আবারও লাথি মারেন।

সে বলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তখনো জীবিত, তার বেশি আর কিছু সে জানে না। রাজবল্লভ তাকে রাইসুল জুহালা বলে চিনতে পারে। ক্লাইভ টান মেরে তাঁর পরচুলা ফেলে দিলে মিরজাফর বলে ওঠে সে নারান সিং, সিরাজের প্রধান গুপ্তচর। ক্লাইভ মিরজাফরকে বলে, তখনই মুর্শিদাবাদের দিকে মার্চ করতে হবে। তার আদেশে নারান সিং বলে, বাংলাদেশে থেকে সে দেশটাকে ভালোবেসেছে, গুপ্তচরের কাজ করেছে দেশের স্বাধীনতার খাতিরে। সে কাজ বেঈমানী আর মোনাফেকির চেয়ে খারাপ নয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে, তবু ভয় নেই, নবাব তখনো বেঁচে আছেন।

সে প্রার্থনা করে, ভগবান যেন সিরাজউদ্দৌলাকে রক্ষা করেন; ক্লাইভ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে। নারান সিং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

তৃতীয় অঙ্ক: চতুর্থ দৃশ্য

১৭৫৭ সালের ২৫ জুন। মুর্শিদাবাদ, নবাবের দরবার। দরবারে গণ্যমান্য লোকের সংখ্যা কম, সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। সিরাজ বক্তৃতা করছেন। তিনি বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে কথা গোপন করে কোনো লাভ নেই। তবে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসেন নি। সেনাপতিদের পরামর্শে যুদ্ধের বিধি অনুসারেই এসেছেন, তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা করবেন বলে ফিরে এসেছেন রাজধানীতে। এক ব্যক্তি বলে, রাজধানী ছেড়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে।

সিরাজ বলেন, তারা পালাবে কোথায়? পেছন থেকে আক্রমণ করবার সুযোগ দিলে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো যায় না। সিরাজ বলেন, জনগণ যেন অধৈর্য না হয়, সবাই যেন শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেটাই তাদের শেষ সুযোগ। ক্লাইভের হাতে রাজধানীর পতন হলে দেশের স্বাধীনতা চিরদিনের জন্যে চলে যাবে। সিরাজ শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলেন, দু’একদিনের মধ্যে বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে যথেষ্ট সৈন্য আসবে, নাটোরের মহারাণীর কাছ থেকেও সৈন্য সাহায্য আসবে, অর্থেরও অভাব নেই। সেনাবাহিনীর খরচের জন্যে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

প্রতারক সৈনিকরা রাজধানী রক্ষার জন্যে সদলবলে লড়বে বলে রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে ভেগে পড়ে। সিরাজ ভেবেছিলেন যে, নগর রক্ষার জন্যে মুর্শিদাবাদে অন্তত দশ হাজার সৈন্য রয়েছে। আরও আশা করেছিলেন জমিদারদের সৈন্য আসবার আগে তাঁদের দিয়ে শত্রুর গতিরোধ করতে পারবেন। কিন্তু বার্তাবাহক এসে তাঁকে জানায়, শহরে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছে। স্বয়ং নবাবের শ্বশুর ইরিচ খাঁ সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সিরাজ শুনে বিস্মিত হন, কারণ মাত্র কিছুক্ষণ আগে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনী সংগঠনের জন্যে।

তবু তিনি আশা ছাড়েন না। এমন সময় তিনি খবর পান, সৈন্য-সংগ্রহের জন্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের অনেকেই নিজেদের লোকজন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। সিরাজ তবু আশা রাখেন। তিনি বলেন, ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়, কিন্তু তাতে বীরের মনোবল ক্ষুণ্ণ হয় না। এমনি করে পালাতে পারতেন মিরমর্দান, মোহনলাল, বদ্রী আলী, নৌবেসিং; তার বদলে তাঁরা পেতেন শত্রুর অনুগ্রহ, প্রভূত সম্পদ ও সম্মান, কিন্তু তা তাঁরা করেন নি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশবাসীর মর্যাদার জন্যে তাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁদের আদর্শ যেন লাঞ্ছিত না হয়, দেশপ্রেমিকের রক্ত যেন আবর্জনার স্তূপে চাপা না পড়ে।

নীরব জনতাকে লক্ষ্য করে তিনি তাদের ভেবে দেখতে বলেন, কে বেশি শক্তিমান। একদিকে দেশের সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দেশদ্রোহী যাদের আছে কেবল অস্ত্র, শঠতা আর ছলনা। অস্ত্র দেশবাসীরও আছে। আর তা ছাড়াও আছে মহামূল্যবান দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা রক্ষার সঙ্কল্প। এ অস্ত্র নিয়ে তারা কাপুরুষ দেশদ্রোহীদের অবশ্যই দমন করতে পারবেন।

হাজার হাজার মানুষ একযোগে রুখে দাঁড়াতে পারলে কৌশলের প্রয়োজন হবে না- বিক্রম দিয়েই তারা শত্রুকে পরাজিত করতে পারবে। তা না হলে বাংলার ঘরে ঘরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দেবে মিরজাফর ও ক্লাইভের লুণ্ঠন ও অত্যাচার, কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই তিনি জনগণকে বলেন একযোগে মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং আশ্বাস দেন, জনগণের অবশ্যই জয় হবে।

সিরাজ বলতে থাকেন, সৈন্য পরিচালনার যোগ্য সেনাপতিও তাঁদের আছে। মোহনলাল বন্দি হন নি, তিনি অবিলম্বে তাঁদের সাথে যোগ দেবেন। তাছাড়া তিনি নিজেও আছেন। আবার যুদ্ধ হবে, আর সৈন্য পরিচালনা করবেন তিনি নিজে। তাদের সাথে যোগ দেবেন বিহার থেকে রামনারায়ণ, পাটনা থেকে ফরাসি বীর মসিয়েঁ লা।

বার্তাবাহক এসে খবর দেয় সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন। শুনে হতাশাগ্রস্ত জনতা দরবার ত্যাগ করে যেতে থাকে। সিরাজ ভেঙে পড়েন। আত্মসংবরণ করে জনতাকে বলেন, তাহলেও কোনো ভয় নেই। তারা যেন হাল ছেড়ে না দেয়। তিনি অনুরোধ করেন, জনতা যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়, তাঁরা অবশ্যই শত্রুকে রুখবেন। কিন্তু তাঁর আশ্বাসে কান না দিয়ে জনতা পালিয়ে যায়। অবসন্ন সিরাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে আসনে বসে পড়েন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে লুৎফুন্নেসা প্রবেশ করে নবাবের মাথায় হাত রেখে তাঁকে ডাকেন।

তিনি নবাবকে বলেন, অন্ধকারে ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। নবাব আবেগ ভরে লুৎফুন্নেসাকে বলেন, তাঁর কেউ নেই, সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। লুৎফুন্নেসা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, তবু ভেঙে পড়লে চলবে না। মুর্শিদাবাদে থেকে যখন হলো না তখন যেখানে নবাবের বন্ধুরা রয়েছেন সেখান থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নবাব তার কথায় সায় দেন। লুৎফুন্নেসা ইতোমধ্যেই সব আয়োজন করে ফেলেছিলেন। তখনি তাঁদের প্রাসাদ ছেড়ে যেতে হবে। লুৎফুন্নেসাও স্বামীর সঙ্গিনী হবেন। সব অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে, সব কষ্ট সহ্য করে নবাবের সাথে পালিয়ে লুৎফুন্নেসাও যাবেন পাটনায়। সেখান থেকে যদি বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার আয়োজন করা যায়, সে চেষ্টা করবেন তারা।

চতুর্থ অঙ্ক: প্রথম দৃশ্য

১৮৫৭ সাল, ২৯ জুন। মিরজাফরের দরবার। রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সভাসদেরা দরবারে আসীন। দরবারটা নাচ-গানের মজলিশের মতো আনন্দমুখর। নতুন নবাব মিরজাফর তখনো দরবারে আসেননি। তা নিয়ে রাজবল্লভ, জগৎশেঠরা মুখরোচক মন্তব্য ও রঙ্গ-রসিকতা করছেন।

যথাসময়ে মিরনকে নিয়ে দরবারে প্রবেশ করেন মিরজাফর। তিনি সরাসরি সিংহাসনে না বসে সিংহাসনের হাতল ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরেই দরবারে প্রবেশ করে কর্নেল ক্লাইভ, সঙ্গে ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক। মিরজাফরের মুখমণ্ডল আনন্দে ভরে ওঠে। ক্লাইভ নতুন নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন এবং নবাব তখনো মসনদে বসেন নি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। মিরজাফর সবিনয়ে বলেন, ক্লাইভ তাঁকে হাত ধরে তুলে না দিলে তিনি মসনদে বসবেন না।

ক্লাইভ নিচু গলায় ওয়াটসকে বলেন, লোকটা আস্ত একটা ভাঁড়। তিনি প্রকাশ্যে দরবারীদের বলেন, নবাব জাফর আলী খাঁ তাঁকে লজ্জায় ফেলেছেন, তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে মিরজাফরের হাত ধরে তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে বলেন, তিনি নতুন নবাব জাফর আলী খানকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। ওয়াট্স ও কিলপ্যাট্রিক হর্ষধ্বনি করেন। মিরজাফর মসনদে বসলে দরবারে সবাই তাঁকে কুর্নিশ করেন। ক্লাইভ দরবারীদের বলেন, বাংলায় আবার শান্তি এসেছে। তিনি নবাবকে নজরানা দেন। ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন।

একে একে অন্যেরা নজরানা দিয়ে কুর্নিশ করতে থাকে। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে প্রবেশ করে উমিচাঁদ। ক্লাইভের কাছে গিয়ে বলে, তিনি যেন তাকে খুন করে ফেলেন এবং ক্লাইভের তরবারির খাপ টেনে নিয়ে নিজের  বুকে ঠুকতে থাকে। মিরজাফর ব্যাপারটা জানতে চাইলে উমিচাঁদ বলে, ওরা সব বেঈমান, তাকে খুন করা হোক। সে আত্মহত্যা করবে। সে নিজের গলা টিপে ধরে। গলা দিয়ে গড় গড় আওয়াজ বেরোতে থাকে। ক্লাইভ সবলে তার হাত ধরে ছাড়িয়ে নিতে ঝাঁকুনি দিতে দিতে উমিচাঁদকে বলেন, সে পাগল হয়ে গেছে। উমিচাঁদ বলে, তাঁরাই তাকে পাগল বানিয়েছে, এবার ক্লাইভ যেন তাকে খুন করে ফেলে।

উমিচাঁদ বলে, যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলে তাকে বিশ লাখ টাকা দেয়া হবে বলে তারা দলিলে সই করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ইংরেজরা সে দলিল জাল করেছে। দৌড়ে সিংহাসনের কাছে গিয়ে মিরজাফরকে অনুরোধ করে সুবিচার করতে। ক্লাইভ বলেন, তিনি উমিচাঁদের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। উমিচাঁদ বলে, ক্লাইভ তা জানবেন কেন? নবাবের রাজকোষ বাটোয়ারা করে ক্লাইভের ভাগে পড়েছে একুশ লাখ টাকা।

সবার ভাগেই অংশ মতো কিছু না কিছু পড়েছে। শুধু উমিচাঁদের বেলাতে শূন্য। ক্লাইভ সবলে উমিচাঁদের বাহু আকর্ষণ করে বলে, উমিচাঁদ স্বপ্ন দেখছে। তিনি সই করলে তা তাঁর মনে থাকতো। উমিচাঁদের বয়স হয়েছে, কাজেই তার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। সে কিছুদিন তীর্থ করলে, ঈশ্বরকে ডাকলে তার মন ভালো হবে। কিলপ্যাট্রিক তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যান। সে যেতে যেতে বলতে থাকে, আমার টাকা, আমার টাকা।

জগৎশেঠ বলে, একটা শুভদিনকে লোকটা থমথমে করে দিয়ে গেলো। ক্লাইভ নবাবকে বলেন যে, প্রথম দরবারে নবাবের কিছু বলা উচিত। রাজবল্লভ তাকে সমর্থন করেন। নবাব ধীরে ধীর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই শুকরিয়া জানান কর্নেল ক্লাইভকে। তিনি ঘোষণা করেন, ক্লাইভকে পুরস্কার দেয়া হলো বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের জমিদারি, ২৪ পরগণার স্থায়ী মালিকানা। তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস দেন তাদের দুর্ভোগের অবসান হয়েছে, সিরাজের অত্যাচারের হাত থেকে তারা রেহাই পেয়েছে, এখন থেকে কারো শান্তিতে আর কোনো রকম বিঘ্ন ঘটবে না।

এমন সময় সেনাপতি মির কাসেমের দূত এসে তাঁর পত্র প্রদান করে। মির কাসেম লিখেছেন, তাঁর সৈন্যরা সিরাজউদ্দৌলাকে ভগবানগোলায় বন্দি করেছে এবং তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। দরবারের সবাই খবর শুনে উল্লসিত হয়ে ওঠেন। ক্লাইভ বলেন, এখন তাঁরা সবাই সত্যিকার নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবেন। মিরজাফর বলেন, সিরাজকে রাজধানীতে নিয়ে আসার দরকার ছিল না, তাকে বাইরে কোথাও আটকে রাখলেই চলতো। ক্লাইভ প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, নতুন নবাবকে শক্ত হতে হবে।

শাসন চালাতে হলে মনে দুর্বলতা রাখা চলবে না। তিনি যে শাসন করতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, সে-কথা দেশের লোকের মনে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখতে হবে। কাজেই সিরাজকে শেকল-বাঁধা অবস্থায় পায়ে হেঁটে সবার চোখের সামনে দিয়ে আসতে হবে জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায়। কোনো লোক তার জন্যে এতটুকু দয়া দেখালে তার গর্দান যাবে। এখন মসনদের মালিক নবাব জাফর আলী খাঁ। সিরাজউদ্দৌলা এখন কয়েদি, ওয়ার ক্রিমিনাল, তার জন্যে যে সহানুভূতি দেখাবে সে traitor, আর আইনে traitor-এর শাস্তি মৃত্যু।

মিরজাফর সবাইকে জানিয়ে দেন, সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে। যথাসময়ে তাঁর বিচার হবে। তিনি আশা করেন, কেউ তার জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে বিপদ ডেকে আনবেন না।

মিরজাফর মসনদ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দরবারের কাজ শেষ হয়। নবাব দরবার থেকে বেরিয়ে যান, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান অন্য সবাই। কথা বলতে বলতে প্রবেশ করে মিরন আর ক্লাইভ। ক্লাইভ বলেন, সে রাতেই কাজ সারতে হবে, ওসব ব্যাপারে সুযোগ নেয়া চলে না। মিরন বলে, তার আব্বা তাতে রাজি হন নি, কাজেই হুকুম দেবে কে? রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ কেউই হুকুম দিতে রাজি হন নি। ক্লাইভ বলেন, তাহলে হুকুমটা মিরনকেই দিতে হবে। মিরন বলে, প্রহরীরা তার হুকুম শুনবে না। ক্লাইভ বলেন, মিরনকে নিজের স্বার্থে নিজের হাতে মারতে হবে সিরাজউদ্দৌলাকে। সিরাজ বেঁচে থাকতে মিরনের কোনো আশা নেই। নবাবের আসন তো দূরের কথা।

মিরন বলে, সে একটা লোক ঠিক করেছে, তবে ক্লাইভের হুকুম দরকার হবে। দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করে, মোহাম্মদি বেগ হত্যা করবে সিরাজকে। তাকে দিতে হবে নগদ দশ হাজার টাকা। ক্লাইভ নির্দেশ দেন কাজ শেষ হলেই তাঁকে যেন খবর দেয়া হয়। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ বেরিয়ে যায়।

চতুর্থ অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য

১৭৫৭ সাল, ২ জুলাই। জাফরাগঞ্জের কয়েদখানা। প্রায়ান্ধকার কারাকক্ষে সিরাজউদ্দৌলা। এক কোণে একটি নিরাবরণ দড়ির খাটিয়া। অন্য প্রান্তে একটি সোরাহী আর পাত্র। সিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন আর বসছেন। কারাকক্ষের বাইরে প্রহরারত শান্ত্রী। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ প্রবেশ করে। তার দুহাত বুকে বাঁধা। ডান হাতে নাতিদীর্ঘ মোটা লাঠি।

প্রহরী দরজা খুলে দিলে কামরায় একটুখানি আলো এসে পড়ে। আলো দেখে চমকে ওঠেন সিরাজ। প্রভাত হয়েছে ভেবে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসেন তিনি। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ এসে দাঁড়ায় মঞ্চের মাঝখানে। মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে সিরাজ বলেন, সে প্রভাত শুভ হোক লুৎফার জন্যে, শুভ হোক তাঁর বাংলার জন্যে, নিশ্চিত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারীর জীবন। তিনি পড়েন আলহামদুলিল্লাহ।

মিরন বলে, সিরাজ যেন আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেন। সিরাজ চমকে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, মিরন তখন সেখানে কেন? সে কি তাঁকে অনুগ্রহ দেখাতে গিয়েছে, না পীড়ন করতে। মিরন বলে, সে গেছে সিরাজের অপরাধের জন্যে নবাবের দণ্ডাজ্ঞা শোনাতে। বাংলার প্রজাসাধারণকে পীড়নের জন্যে, দরবারের পদস্থ আমির-ওমরাহদের মর্যাদাহানির জন্যে, বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসঙ্গত বাণিজ্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবার জন্যে, অশান্তি ও বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে সিরাজ অপরাধী। নবাব জাফর আলী খাঁ তাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিয়েছেন।

কথাটা সিরাজের বিশ্বাস হয় না। তিনি জাফর আলী খাঁর স্বাক্ষরযুক্ত আদেশ দেখতে চান। মিরন বলে আসামীর তেমন অধিকার থাকে না। সে পেছন ফিরে মোহাম্মদি বেগকে নবাবের হুকুম তামিল করার হুকুম দিয়ে বেরিয়ে যায়। মোহাম্মদি বেগ লাঠিটা মুঠো করে ধরে নবাবের দিকে এগোতে থাকে। সিরাজ বলেন, প্রথমে মিরন তারপর মোহাম্মদি বেগ-মিরন তবু মিরজাফরের পুত্র কিন্তু মোহাম্মদি বেগ কেন গিয়েছে তাঁকে খুন করতে।

মোহাম্মদি বেগ এগোতে থাকে। সিরাজ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলেন, তিনি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু মোহাম্মদি বেগ যেন সে কাজ না করে। মোহাম্মদি বেগ যেন তাঁকে হত্যা না করে। তিনি তাকে অতীতের কথা ভেবে দেখতে বলেন। তিনি বলেন, তাঁর আব্বা-আম্মা তাকে পালন করেছে পুত্রস্নেহে, তাঁদেরই সন্তানের রক্তে সে যেন ঋণ পরিশোধ না করে।

মোহাম্মদি বেগ লাঠি দিয়ে সিরাজের মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। মোহাম্মদি বেগ স্থিরদৃষ্টিতে দেখতে থাকে মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সিরাজ ডান হাতের কনুই আর বা হাতের তালুতে ভর দিয়ে কিছুটা মাথা তোলেন। কাতর কণ্ঠে বলেন লুৎফুন্নেসা তাঁর স্বামীর ওপর সে পীড়ন দেখতে পায় নি, সে জন্যে খোদার কাছে শুকরিয়া। মোহাম্মদি বেগ লাঠি ফেলে খাপ থেকে ছোরা খুলে সিরাজের ভূলুণ্ঠিত দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিরাজের পিঠে পরপর কয়েকবার আঘাত হানে ছোরা দিয়ে। সিরাজের দেহ তখন ধীরে ধীরে নিথর হতে থাকে। মোহাম্মদি বেগ উঠে দাঁড়ায়। ঈষৎ মাথা নাড়াবার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে সিরাজ বলেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু...........।

মোহাম্মদি বেগ লাথি মারে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সিরাজের জীবন। শুধু মৃত্যুর আক্ষেপে তাঁর হাত দুটি মাটি আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে চিরকালের মতো নিস্পন্দ হয়ে যায়।

1 comment:

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here