পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার
[য. বো. ১৫, ঢা. বো. ১৪, কু. বো. ১৪, রা. বো. ১২]
ভূমিকা: মানুষ ও প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ বা অন্য যেকোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর জীবনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পরিবেশ থেকে তারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে। সে পরিবেশ যদি কোনো কারণে দূষিত হয়ে ওঠে তবে তা জীবের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ পরিবেশ দূষণের প্রধান নিয়ামক, আবার সে মানুষই আজ পরিবেশের সুস্থতা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। কারণ, এ কথা মানুষের অজানা নয় যে, পরিবেশ এভাবে ক্রমাগত প্রতিকূল হয়ে উঠলে তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
পরিবেশ দূষণ কী? পরিবেশ হলো জীবজগতের প্রাণের ধারক। মানুষের কর্মকাণ্ডে এই পরিববেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিকর পরিবর্তন হলে পরিবেশ দূষণ হয়। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। কোনো কারণে এই পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিœত হওয়াকে পরিবেশ দূষণ বলে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, খাদ্য দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, ওজোন গ্যাস হ্রাস, গ্রিনহাউস ইফেক্ট ইত্যাদি সবকিছুই পরিবেশ দূষণের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণই পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের ধরন: সুজলা-সুফলা নদীকেন্দ্রিক জীবন স্বভাবতই বাংলাদেশের মানুষকে করেছে প্রকৃতি ও পরিবেশপ্রেমী। কিন্তু সীমিত ভূখণ্ড ও সম্পদ এবং অতি ঘনবসতি ও দুর্যোগপ্রবণ ভৌগোলিক অবস্থান এ দেশের মানুষকে পরিবেশ দূষণের শিকারে পরিণত করেছে। পরিবেশ দূষণ মূলত দুই ভাবে হয়ে থাকে। যথা: স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক উপায়ে এবং কৃত্রিম উপায়ে।
সাধারণত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় পরিবেশে যে অবনতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে-তাই প্রাকৃতিক দূষণ। প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে সিসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের মলমূত্র এবং বিভিন্ন প্রকার পচন থেকেও প্রাকৃতিক দূষণ হয়ে থাকে।
কৃত্রিম দূষণের নিয়ামক হচ্ছে নানা কীটনাশক, গুঁড়া সাবান, ওষুধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিক। এগুলো বহুদিন ধরে পরিবেশে টিকে থাকে। রোদ, পানি, বৃষ্টি, বাতাস, এগুলোকে কিছুই করত পারে না। তাই এগুলো মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে।
পরিবেশ দূষণের কারণ: স্থান ও কালভেদে পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ:
১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি
২। অপরিকল্পিত নগরায়ন
৩। বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার
৪। প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার
৫। দ্রুত শিল্পায়ন
৬। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার
৭। বনভূমি উজাড়
৮। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ
৯। গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া
১০। ওজোন স্তরের ক্রমাবনতি
১১। অ্যাসিড বৃষ্টি
১২। অপরিকল্পিত গৃহ নির্মাণ
১৩। দারিদ্র্য
১৪। প্লাস্টিক ইত্যাদি।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
পরিবেশ দূষণের ফলাফল: পরিবেশ দূষণ মানবসভ্যতায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ফল বয়ে নিয়ে আসে। পরিবেশ দূষণের ফলে মানবসভ্যতা হুমকির সম্মুখীন হয়। মানবজীবনে পরিবেশ দূষণের ফলে যেসব ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা হলো-
(ক) বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা ও খরা বেড়ে যাবে।
(খ) জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে।
(গ) বিকলাঙ্গ মানবশিশু জন্ম নেবে।
(ঘ) মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাবে।
(ঙ) পানি ও বায়ুদূষণের ফলে অনেক অজানা রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে।
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ: পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য সারা বিশ্ব সচেতন হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যবস্থা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন:
১. পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ (২০০০) ঘোষণা ও আইন করা হয়েছে।
২. টু-স্ট্রোক যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড, সিসা, কার্বন মনোঅক্সাইডসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবশেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
৩. পরিবেশ দুষণরোধে সিএনজি জ্বালানির ব্যবহার আরম্ভ করেছে।
৪. মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৫. বনায়ন কর্মসূচির ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
৬. পরিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে। এ আদালতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশে পরিবেশ অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।
৭. সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল ২০০২’ এবং ‘পরিবেশ আদালত (সংশোধন) বিল ২০০২’ নামে দুটি আইন পাস করেছে।
৮. জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করেছে।
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে করণীয়: পরিবেশ দূষণ সমগ্র জীবজগতের জন্যই ক্ষতিকর। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য গোটা বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। অনতিবিলম্বে বের করতে হবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার যথার্থ উপায়। প্রথমে গোটা বিশ্ববাসীকে পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
গ্রিনহাউজ গ্যাসসমূহের নির্গমন সবসময় পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া গোটা বিশ্বের জীবজগতের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। যেসব যন্ত্র বা গাড়ি থেকে ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস বের হয় তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প শক্তির ব্যবহার যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌরশক্তি-নির্ভর যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবেশকে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক রাখতে পারে।
নির্বিচারে যাতে গাছ কাটা না হয় সেদিকে সকলকে নজর দিতে হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বনায়ন বা বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সারের (যেমন সম্প্রতি আবিষ্কৃত স্বর্ণা সার) ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
উপসংহার: প্রাণিজগতের জন্যই পরিবেশ প্রয়োজন। তাই পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। তা না হলে জীবজন্তুর অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন। পরিবেশ দূষণ জাতির জন্যে এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতার মানসিকতা একান্ত অপরিহার্য। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট। তাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে এটি মোকাবেলা অত্যাবশ্যক।
0 Comments:
Post a Comment