পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য
[ব. বো. ১৩, ঢা. বো. ১০]
ভূমিকা: স্রষ্টার পরেই প্রতিটি মানুষের জন্য তার সৃষ্টির উৎস হলো পিতা-মাতা। তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে পারি। পিতা-মাতা ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই কল্পনাতীত। তাই পিতা-মাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলাই বাহুল্য।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য: সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা যেভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন তেমনি তাদের প্রতিও প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না এবং মাতাপিতার সাথে উত্তম আচরণ কর।’
মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে- ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী’। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘মাতা-পিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’ ধর্মগ্রন্থগুলো সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশনা প্রদান করে। পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য করা থেকে কখনও বিরত হওয়া উচিত নয়।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বৃহৎ অংশজুড়ে থাকে পিতা-মাতা। কোনো অবস্থাতেই তাদের সাথে অসদাচারণ করা উচিত নয়। পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিলে সে অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। এ সম্পর্কে মহানবি (সা.) বলেন, “আল্লাহতায়ালা তার ইচ্ছামতো বান্দার সকল গুনাহ মাফ করে দেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করেন না বরং এই গুনাহগারকে পার্থিব জীবনে মৃত্যুর পূর্বেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।”
সন্তানের কাছে পিতা-মাতার প্রত্যাশা: প্রত্যেক পিতা-মাতাই সর্বদা তাদের সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন। সন্তানকে সুখে রাখতে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেন। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই পিতা-মাতার মনে সন্তানের মঙ্গলের চিন্তা ঠাঁই পেয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের সেই বিখ্যাত উক্তিতে- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ পিতা-মাতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, তাদেরকে আরাম আয়েশে রাখার সকল ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু বিনিময়ে সন্তানের কাছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করেন না। সন্তানের সুখেই তারা সুখী হন। পিতা-মাতার এসব অবদানের পরিবর্তে তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য হয়ে ওঠে সীমাহীন। পিতা-মাতার ভালোবাসার কোনো বিনিময় মূল্য হয় না। কিন্তু সন্তানের ভালোবাসা তাদেরকে যে মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে তা অমূল্য। তাই পিতা-মাতার প্রত্যাশাকে পূরণ করতে প্রত্যেক সন্তানেরই তৎপর থাকা উচিত।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের ধরন: সন্তানরা পিতা-মাতার প্রতি নানাভাবে কর্তব্য পালন করতে পারে। তারা যেভাবে পিতা-মাতার প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হলো -
(১) পিতা-মাতার প্রতি অনুগত থাকা: প্রতিটি সন্তানের অন্যতম কর্তব্য হলো পিতা-মাতার প্রতি অনুগত থাকা। কোনো অবস্থাতেই তাদের অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, পিতা-মাতা কখনো আমাদের খারাপ পরামর্শ দেন না। তাই তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত।
(২) পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা: আমাদের ছোট থেকে বড় করে তোলার পেছনে পিতা-মাতার অবদান অপরিসীম। তারা যেভাবে আমাদের সকল দায়িত্ব নিয়ে বড় করে তোলেন তেমনি আমাদেরও উচিত তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা, তাদের সুস্থতা বিধান করা এবং যেকোনো বিপদে-আপদে সাহায্য করা। কোনো অবস্থাতেই পিতা-মাতার দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকা যাবে না।
(৩) পিতা-মাতার বৃদ্ধকালীন পরিচর্যা: ছোটবেলায় প্রতিটি শিশু অসহায় থাকে। সে সময় পিতা-মাতা আমাদের আদর-যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তারাও তেমনি অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় আমাদেরও উচিত পিতা-মাতাকে আগলে রাখা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দোয়া প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে যে, “হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতা শৈশবে যেমন স্নেহ-মমতা দিয়ে আমাকে লালন-পালন করেছিলেন, আপনি তাঁদের প্রতি তেমনি সদয় হোন।”
(৪) পিতা-মাতার সন্তুষ্টি বিধান: সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার সন্তুষ্টি বিধান করা প্রত্যেক সন্তানের পরম কর্তব্য। তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই রাগান্বিত করা যাবে না। পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিলে সন্তানের মঙ্গল হয় না। তাই তাদের মনে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলা অনুচিত। সর্বদা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতে হবে।
(৫) পিতা-মাতার দেখানো পথ অনুসরণ করা: পিতা-মাতা আমাদের জীবনে সবচেয়ে উত্তম পথপ্রদর্শক। তাদের দেখানো পথ কখনো ভুল হয় না। তাই সবসময় তাদের কথামতো পথ চলতে হবে যেন সুন্দরভাবে জীবন কাটানো যায়।
মহান ব্যক্তিদের পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের দৃষ্টান্ত: এই বিশ্ব চরাচরে যাঁরা মহামানব এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তাঁরা সকলেই পিতা-মাতার প্রতি অনুগত ছিলেন। হযরত বায়োজিদ বোস্তামি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হযরত আবদুল কাদির জিলানী, হাজি মুহম্মদ মহসীন, জর্জ ওয়াশিংটন, আলেকজান্ডার প্রমুখ ব্যক্তিগণ পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমাদেরও উচিত এ সকল মহান ব্যক্তির অনুসৃত পথে চলা এবং পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করা।
উপসংহার: পিতা-মাতা এই পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে থাকেন। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে স্রষ্টার প্রতিই দায়িত্ব পালন করা হয়। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, “যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে পেল, অথচ তাদের সেবা করে বেহেশত লাভ করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।” পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনে কখনো অবহেলা করা ঠিক না।
সেদিনই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনের সার্থকতা প্রকাশ পাবে যেদিন সকল বৃদ্ধাশ্রমে তালা ঝুলবে। ইহলোক ও পরলোকের সুখ নিশ্চিত করতে আমাদের সকলকে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে।
0 Comments:
Post a Comment