একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
বাংলা সহপাঠ গাইড
নাটক
সিরাজউদ্দৌলা
সিকান্দার আবু জাফর
Character discussion of Sirajuddaula play: Mirzafar pdf download
চরিত্রঃ মিরজাফর
ভূমিকা: বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত প্রতীক মিরজাফর। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিপাহ্সালার, সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দেশরক্ষার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার ওপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন নি। নিজের স্বার্থের জন্য বিদেশি বণিক-চক্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে তিনি দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে বসেছিলেন বাংলার মসনদে। তাই মিরজাফর বাংলার ইতিহাসে সর্বাধিক ঘৃণিত, ধিকৃত আর অভিশপ্ত ব্যক্তি।
মসনদলোভী: সিপাহ্সালারূপে বাংলার নবাবের প্রতি তার আনুগত্য ছিল না। তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখতেন বাংলার নবাবীর। “একটা দিন, মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম।” -এ লোভই তাকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকে স্খলিত করেছিল।
ওয়াদাভঙ্গকারী: মসনদে বসার পর থেকে সিরাজ মিরজাফরকে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। তবু দেশের জনগণের কল্যাণের খাতিরে তিনি তাকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত না করেন। জবাবে মিরজাফর দেশের স্বার্থের জন্য পবিত্র কোরান ছুঁয়ে ওয়াদা করলেন আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। অথচ তাঁর স্বার্থবোধ ধর্মবোধকে গলা টিপে মেরেছে, করেছে নিষ্ক্রিয়।
হীন স্বার্থপর: মিরজাফরের মতো দুর্জনের ছলের অভাব নেই। নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার ব্যাপারে এ লোকটা ছিলেন সদা তৎপর। নিজের কার্যকলাপের কথা ভুলে গিয়ে তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন সিরাজ তাঁকে মর্যাদা দেন না। প্রকাশ্য দরবারে মোহনলালের তরবারি নিষ্কাশনে তিনি অপমানিত বোধ করেন। অথচ এই মর্যাদা-অভিমানী সিপাহ্সালার অন্তরের অন্তস্থলে ছিল ঘৃণ্য কাপুরুষতা। মোহনলালের উন্মুক্ত তরবারি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। ক্লাইভের কাছে কৃতজ্ঞতায় তিনি লজ্জাজনকভাবে নতজানু।
ধূর্ত: ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মিরজাফর ছিলেন সবচেয়ে ধূর্ত। ধরা পড়বার ভয়ে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতেন খুবই কম। ক্লাইভের দাবি দেশের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অযৌক্তিক জেনেও তিনি তা মেনে নিতে ষড়যন্ত্রের সাথিদের অনুরোধ করেন। তিনি রাজা রাজবল্লভকে বলেন, “আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি রাজা রাজবল্লভ। ও কথা আর এখন ভাবলে চলবে না। সকলের স্বার্থের খাতিরে ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।”
তার সাংগঠনিক বুদ্ধিও ছিল প্রচুর। তিনি বিভিন্ন স্বার্থের পূজারী একদল বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্রকারীকে এক জোটে কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন, তাদের মধ্যে ঐক্য রক্ষার দুঃসাধ্য কাজে সফলতা অর্জন করেছেন।
ক্ষীণ দেশপ্রেম: এমন যে স্বার্থান্ধ দেশদ্রোহী, তাঁর প্রাণেও দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। ক্লাইভের সাথে ভবিষ্যতের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দেবার পূর্ব মুহূর্তে তিনিও বিবেকের দংশন অনুভব করেছেন, কল্পনায় অমঙ্গলসূচক মরাকান্না শুনেছেন। তার সে সময়ের অস্বস্তি চতুর ক্লাইভের দৃষ্টি এড়ায় নি। এ জন্য ক্লাইভ তাকে 'পড়ধিৎফ' আখ্যা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও কলম হাতে নিয়েও মিরজাফর বলেছেন, “কিন্তু রাজবল্লভ যেমন বলেন, সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?” কিন্তু চতুর ক্লাইভ লোকটার আসল দুর্বলতার খোঁজ রাখতেন। তাই প্রচণ্ড উত্তেজনায় মিরজাফর শেষ পর্যন্ত সে ঐতিহাসিক ঘৃণ্য দলিলে স্বাক্ষর করেন।
চক্রান্তকারী: পলাশির রণক্ষেত্রে মিরজাফরের চক্রান্ত চরমে ওঠে। তিনি তার বিরাট বাহিনী নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিরমর্দানের দুর্বার আক্রমণে ইংরেজ সৈনিকেরা যখন লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল, তখন এলো বৃষ্টি। সিপাহ্সালার হিসেবে তখন মিরজাফর যুদ্ধরত নবাব বাহিনীকে হুকুম দেন যুদ্ধ বন্ধ করতে। তারা বিশ্রামের জন্য শিবিরের দিকে ফিরছে এমন সময় কিলপ্যাট্রিক আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ক্লাইভের সাথে হাত মিলিয়ে মিরজাফর প্রবেশ করেন নবাবের শিবিরে।
অন্যের হাতের পুতুল: ইংরেজের সেবাদাস মিরজাফর নবাব হয়ে প্রথম দরবারে ক্লাইভ না আসা পর্যন্ত মসনদে বসেন নি। ক্লাইভ এলে তিনি গদগদ কণ্ঠে সিংহাসনের জন্য ক্লাইভের কাছে প্রকাশ্য দরবারে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং তাঁর হাত ধরে মসনদে আসন গ্রহণ করেন। তিনি ক্লাইভকে বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের চব্বিশ পরগণার জমিদারীর স্থায়ী মালিকানা প্রদান করেন। তিনি প্রকৃত নবাব হন নি, হয়েছিলেন ক্লাইভের হাতের পুতুল। ইতিহাসে এ কারণে তাঁকে বলা হয়েছে ‘ক্লাইভের গর্দভ’।
উপসংহার: মিরজাফর নবাব হবার পরও সিরাজ সম্পর্কে তার অন্তরের ভীরু সঙ্কোচ ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন সিরাজকে রাজধানীতে না এনে বাইরে কোথাও আটকে রাখতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের চাতুর্যের কাছে তাকে হার মানতে হয়। ক্লাইভের কথায় তিনি ঘোষণা করেন সিরাজের বিচার হবে এবং কেউ ভূতপূর্ব নবাবের প্রতি অনুকম্পা দেখালে তার শাস্তি হবে। এ ঘোষণা তার অন্তর থেকে বেরোয়নি, ক্লাইভই তাঁকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়েছেন। সিরাজকে রাজপথে অপমানিত করার যে প্রস্তাব ক্লাইভ করেছিলেন মিরজাফর তা মেনে নেন নি।
নাট্যকার মিরজাফরকে কিছুটা মানবিক গুণে গুণান্বিত করে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। তাই মিরজাফরকে পুরোপুরি হৃদয়হীন টাইপ চরিত্র বলা চলে না। মিরজাফর দুরাকাক্সক্ষী, মিরজাফর লোভী, কিন্তু তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ, সংবেদনশীল চরিত্র। তিনি কিছুতেই সিরাজের হত্যার আদেশে স্বাক্ষর করতে পারেন নি, তার মুরুব্বি ক্লাইভের পরোক্ষ ইঙ্গিতেও তা তিনি করেন নি। এ মানবিক গুণটি বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত-প্রতীক মিরজাফরকে দোষে-গুণে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
0 Comments:
Post a Comment