একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
বাংলা সহপাঠ গাইড
নাটক
সিরাজউদ্দৌলা
সিকান্দার আবু জাফর
Character discussion of Sirajuddaula drama: Lutfunnesa pdf download
চরিত্রঃ লুৎফুন্নেসা
ভূমিকা: নবাব সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ছিলেন পতিগতপ্রাণা মহিয়সী রমণী। তিনি ছিলেন রমণীসুলভ সরলতার মূর্তপ্রতীক, শত্রু-মিত্র চেনার মতো প্রখর দৃষ্টি তাঁর ছিল না।
নবাবের অফুরন্ত ভালোবাসার অমৃত সরোবরে নিশ্চিত হৃদয়া স্বচ্ছন্দ বিহারিণী ছিলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আভিজাত্যের ঔদ্ধত্য বা কূটনীতির বক্রতা তার চরিত্রে কখনও ছায়াপাত করে নি। মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট অভিজাত মির্জা ইরাজ খাঁর কন্যা লুৎফুন্নেসা বাংলার পতন যুগের ইতিহাসে সরলতা, পবিত্রতা ও পতিপ্রেমের জন্য স্মরণীয়া হয়ে আছেন।
শ্রদ্ধাবোধ: প্রাসাদে নিজের কক্ষে তিনি খালা শাশুড়ি ঘসেটি বেগমকে প্রবেশ করতে দেখে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সালাম করে বলেন, তিনি তাকে মায়ের মতো ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। এ সরলা নবাব-পত্নী ঘসেটিকে এ কথাগুলো বলেন তাঁর নিজের কক্ষে তাঁর ও আমিনা বেগমের সামনে সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটির প্রচণ্ড বিষোদগারের পরের মুহূর্তে। রাজনীতির কুটিল আবর্তের বাইরে সাধ্বী রমণীর এসব উক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র কপটতা ছিল না।
বিশ্বস্ত: ঘসেটি বেগম সিরাজ সম্পর্কে অনেক অশ্রাব্য কটূক্তি করার পরও লুৎফুন্নেসার স্বাভাবিক চরিত্র মাধুর্যের ওপর বিন্দুমাত্র ছায়াপাত ফেলে নি। পতিগতপ্রাণা লুৎফুন্নেসা ধীর প্রশান্ত বাক্যে খালা শাশুড়ি ঘসেটিকে নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছেন যে, নবাব তার কাছ থেকে যে-টাকা নিয়েছেন তা অবশ্যই ফেরত দেবেন।
চিরন্তন বাঙালি নারী: সিরাজের সাথে ঘসেটি বেগমের যে-কথা কাটাকাটি হয় ঘসেটি বেগম তাতে নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। কথাটা তিনি সরলভাবে স্বামীকে অবহিত করেছেন। সিরাজ তখন তাকে ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝিয়ে বলেন। লুুৎফুন্নেসা তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বামীর কাছে ক্ষমা চান। নবাবের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি লুৎফুন্নেসার হৃদয় স্পর্শ করে।
তিনি প্রস্তাব করেছেন, নবাব সমস্ত দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তার কাছে দুএকদিন যেন বিশ্রাম করেন। লুৎফুন্নেসা স্বামীর বিশ্রাম কামনা করেছেন, ব্যাকুলভাবে চেয়েছেন স্বামীকে নিজের কাছে একান্তভাবে পেতে। কিন্তু সেনাপতি মোহনলালের কাছ থেকে জরুরি খবর পেয়ে নবাব দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন লুৎফুন্নেসার কামরা থেকে। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে লুৎফুন্নেসার দুগাল বেয়ে। লুৎফুন্নেসার এ চিরন্তনী নারী-মূর্তি সত্যিকার প্রশংসার দাবিদার।
প্রেরণাদাত্রী: পলাশির যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নবাব দরবারে সমবেত জনগণকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য ব্যাকুল আবেদন জানান। কিন্তু তার সে-আবেদনে কেউ সাড়া দেয় নি। সেনাপতি মোহনলালের বন্দি হওয়ার সংবাদ শুনে নবাব যখন মর্মাহত, তখন সবাই দরবার থেকে একে একে বেরিয়ে যায়। তখন হাতাশাপীড়িত অসহায় নিঃসঙ্গ নবাবের পাশে এসে দাঁড়ান বেগম লুৎফুন্নেসা। তিনি স্বামীকে বলেন, ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই।
প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী: লুৎফুন্নেসা ছিলেন নবাবের সত্যিকার জীবনসঙ্গিনী। দুর্দিনের ঘনীভূত অন্ধকারেও তিনি স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন, বলেছেন- ভেঙে পড়া চলবে না। তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে দূরে নির্ভরযোগ্য বন্ধুদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন নবাবকে, সেখান থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহীদের শাস্তি বিধানের কথাও তিনি বলেছেন। স্বামীর নিরাপত্তার জন্য এ সাধ্বী রমণী অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
তাই দেরি না করে প্রাসাদ ত্যাগ করতে তিনি স্বামীকে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি নিজেও প্রাসাদে থাকতে রাজি হননি। নবাব তাকে বলেছিলেন, মানুষের দৃষ্টি থেকে চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে তাকে পথ চলতে হবে পাটনার পথে। লুৎফুন্নেসা সে কষ্ট সইতে পারবেন না। প্রত্যুত্তরে পতিগতপ্রাণা রাজমহিষী লুৎফুন্নেসা বলেছিলেন, তিনি সে কষ্ট সহ্য করতে পারবেন, তাকে পারতেই হবে এবং তিনি নবাবের সহগামিনী হয়েছিলেন।
উপসংহার: লুৎফুন্নেসা রমণী-রত্ন। বাংলার পতনের যুগে নারীত্ব যখন ধূলায় লুণ্ঠিত, মানবতা ও মনুষ্যত্বের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত যখন বিলুপ্ত, তখন লুৎফুন্নেসা নারীত্বের জয় ঘোষণা করেছেন। তিনি চিরন্তন নারীত্বের অম্লান প্রতীক।
0 Comments:
Post a Comment