‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। এ উপন্যাস আপাততভাবে সে কুসংস্কার, শঠতা ও প্রতারণার প্রতীক। সে প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এই কারণে যে প্রথা টিকে না থাকলে তার প্রভুত্ব টিকে থাকবে না।
মহব্বতনগর গ্রামে নিজের পরাক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কোনো কর্ম নেই, যা সে না করেছে- তাহের-কাদেরের বাবাকে শাস্তি, আওয়ালপুরের প্রতিদ্বন্দ্বী পীরকে হঠানো, গ্রামবাসীকে সব সময় খোদাভীতির কথা বলে নিজের অনুগত করে রাখা, খালেক ব্যাপারীর ওপর কড়া নজরদারি, আমেনা বিবিকে তালাক দানে বাধ্য করা, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়া, পরিশেষে জমিলাকে শায়েস্তা করা। তবে অন্য সব ক্ষেত্রে মজিদ আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করলেও জমিলাকে সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি-বরং বলা যায়, পুরোপুরি সে ব্যর্থ হয়েছে।
শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় ও শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন; বার বার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন। উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
আপাতদৃষ্টিতে মজিদ একটি চরিত্র; শুধু চরিত্র নয়, উপন্যাসটির একদম কেন্দ্রীয় চরিত্র অথচ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে যারা জানেন, তাঁর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যাঁদের কমবেশি পরিচয় আছে, তাঁরা সবাই জানেন, মজিদ মূলত একটি প্রতীক।
কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের মূর্তিমান প্রতীকও সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে যেকোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক।
‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রাণধর্ম ও প্রথাধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্বকে দেখিয়েছেন। মজিদ ধর্মের নামে প্রচলিত প্রথাধর্ম তথা কুসংস্কারের প্রতীভূ। সে প্রাণধর্মের প্রবল বিরোধিতায় তৎপর থেকেছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। কারণ, সে জানে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ জেগে উঠলে তার ধর্মব্যবসা লাটে উঠবে।
ফলে ফসল ওঠার সময় গ্রামবাসীরা যখন আনন্দে গান গেয়ে ওঠে, তখন সে থামিয়ে দেয়; হিন্দুপাড়ায় ঢোল বাজলে নিষ্ফল ক্রোধে ছটফট করে- কেননা, ওই সমাজে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তার মোদাচ্ছের পীরের দোহাই তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। রহিমা উঁচু গলায় কথা বললে কিংবা শব্দ করে হাঁটলে সে খোদার ভয় দেখায়; জমিলা প্রাণোচ্ছ্বল হাসি হাসলে সে নিষ্ঠুরভাবে ওই হাসি বন্ধ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায়।
মজিদ প্রতিষ্ঠাকামী। যেকোনোভাবেই হোক, সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চালচুলোহীন মজিদ অল্পদিনের মধ্যেই মহব্বতনগরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটি তার এই যোগ্যতা বলে। তবে তার এই প্রতিষ্ঠাপর্বে শোষণের আশ্রয় নিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার ছিল কথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার।
অপরাধবোধ মানুষের নিঃসঙ্গবোধ জাগিয়ে তোলে। মজিদকেও আমরা চূড়ান্ত রকম নিঃসঙ্গবোধে আক্রান্ত থাকতে দেখি। তার মন সবসময়ই বিচলিত ছিল। একবারই রহিমার কাছে তার প্রকাশ ঘটেছে। রহিমার কাছে সমর্পিত মজিদ যখন বলে, “কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?” তখন তার অন্তর্শায়িত হতাশা, নিঃসঙ্গতাকে আমরা প্রত্যক্ষ করি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পাশ্চাত্য অস্তিত্ববাদী দর্শন দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মজিদ চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি এই অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত্বটিকে মূর্ত করে তুলেছেন। অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত মানুষের ক্রমশ অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠা এবং তারপর অশুভ শক্তিতে পরিণত হয়ে নিজেই অন্যের অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি করার এক অপূর্ব বৃত্ত মজিদ চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
এই অর্থে, মজিদ একই সঙ্গে মানুষ এবং একই সঙ্গে তত্ত্ব। সে অশুভ কিন্তু লেখকেরই অন্তরশায়িত অপপুত্র।
0 Comments:
Post a Comment