দেশটাই যেন কেমন। ফসল একদম ফলে না অথচ অনেক মানুষের সেখানে বসবাস। ঘরে খাবার নেই। ঘরে অভাব থাকলে যা হয়-সারাক্ষণ এলাকার মানুষ ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে, কখনও খুনখারাবিও। তাই তারা ছোটে। এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আশাই তাদের দেশ থেকে বাহিরে নিয়ে আসে। খিদে সহ্য করতে না পেরে তারা ঘর ছাড়া। এদের একজনই মজিদ- ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র।
শ্রাবণ মাসের শেষ দিক। মহব্বতনগর গ্রামের দুই যুবক তাহের ও কাদের কোচ জুতি নিয়ে ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করছিল। তারাই প্রথমে মজিদকে দেখে। দেখে মজিদ মতিগঞ্জের সড়কের ওপরে আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মজিদের এমন নাটকীয়তার কারণ এই যে, সে জানে গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক কোনো ঘটনা পছন্দ করবে না। তার আগমন যতটা নাটকীয় বানানো যায়, সেটা সে করার চেষ্টা করেছে।
এর অংশ হিসেবে সে খুঁজে বের করে গ্রাম থেকে একটু বাইরে একটা বড় বাঁশ-বাগান। বাঁশ-ঝাড়ের ওধারে পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ভাঙা একটি প্রাচীন কবর। ইটগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো। শেয়ালের বাসা হবে হয়তো। সেই কবরটিকে সে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে দাবি করে।
মহব্বতনগর গ্রামে ঢুকে সে সোজা চলে যায় গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারীর বাড়ি। সবাইকে চিৎকার করে সে ‘জাহেল’, ‘বেএলেম’ ‘আনপাড়াহ্’ বলে বিস্তর গালমন্দ করে জানায় যে, এ-রকম একজন কামেল পীরের মাজারকে এভাবে অযত্নে ফেলে রেখে এরা মহাপাপ করেছে। গ্রামবাসী তো বটেই মোড়ল খালেক ব্যাপারী, মাতাব্বর রেহান আলীও লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকে। মজিদ তাদের জানায়, সে গারো পাহাড়ে খুব শান্তিতে ছিল, কিন্তু এখানে সে ছুটে এসেছে তার কারণ এক দৈবস্বপ্ন। স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মহব্বতনগরে চলে আসার জন্য। তাই তার এ আগমন।
জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলা হলো। কবর নতুন করে বাঁধানো হলো। আগরবাতির গন্ধে, মোমবাতির আলোয় সৃষ্টি হলো নতুন এক পরিবেশ। কবরের ওপরে টানিয়ে দেওয়া হলো লালসালু কাপড়। এ গ্রাম ও গ্রাম থেকে লোকজন আসে। তাদের নানা আশার কথা, নানা কষ্টের কথা লালসালু কাপড়ে ঢাকা কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তিকে শোনায় আর যাবার সময় দিয়ে যায় টাকা-পয়সা। শুরু হলো মজিদের ব্যবসা।
মজিদের ঘরবাড়ি উঠতে বেশিদিন লাগে না। জমিজমা হলো। তারপর সে একদিন তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়েও করে। পাত্রীর নাম রহিমা। লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী হলেও সে স্বামীর খুব অনুগামী। গ্রামের মানুষ মজিদকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে, খালেক ব্যাপারীকে হয়তো ভয়ই কেবল পায় অথবা এড়িয়ে চলে। মেয়ে-মহলে রহিমার আলাদা একটা কদর। মহিলারা তো আর মজিদের বরাবর তাদের আর্জি পেশ করতে পারে না, তাই রহিমাই তাদের অবলম্বন। রহিমার মাধ্যমেই তারা তাদের ফরিয়াদ জানায়।
তাহের-কাদেরের বাবা-মার বয়স হয়েছে, কিন্তু ঝগড়াঝাটি করার অভ্যাস তো কমেইনি বরং দিনদিন তা অশ্লীল গালাগালিতে গিয়ে পৌঁছেছে। বুড়ো এক কালে মারপিটে ওস্তাদ ছিল, এখন বয়স হয়ে গেছে বলে হাতের সেই জোরটা নেই, কিন্তু বুড়ির বয়স হলে হবে কি, মুখের ধারটা যেন আরও বেড়েছে। সে যা বলে, তা শুনে পাড়া-পড়শি তো বটেই, তার বিধবা মেয়েও আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসে।
বুড়ির বক্তব্য একটিই- তার পেটে যে ছেলেমেয়েগুলো জন্মেছে, এগুলো বুড়োর নয়-বুড়োর আবার ওই ক্ষমতা ছিল নাকি কোনো কালে? ঝগড়া তো নয় সে এক এলাহি কাণ্ড! তাহের-কাদেরের বাবা কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েকে-হাসুনির মাকে-পিটিয়েছিল। মজিদ ভর মজলিশে তাহের-কাদেরের বাবাকে অপমান করে, যার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধ লোকটি এক সন্ধ্যায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সে আর বাড়ি ফেরে না। যে বুড়ি প্রতিদিন তাকে নানা গালমন্দ করতো, সে-ও স্তব্ধ হয়ে যায়; শিশুর মতো ডাকতে থাকে: ‘আল্লা আল্লা ........’
হাসুনির মা বিধবা। রহিমার কাছে সে জানিয়েছে যে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মানুষ নয়। বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছে। ভাইয়েরা অকর্মণ্য, অপদার্থ। সে তো একাও নয়, সঙ্গে আছে তার শিশুপুত্র। তাই সে কাজ নেয় মজিদের বাড়িতে। রহিমাকে ঘর গেরস্থালিতে সাহায্য করা। হাসুনির মা মজিদের বাড়িতে কাজ করতে এলে মজিদের কুদৃষ্টি তার ওপর পড়ে। মুখে যদিও সে হাসুনির মাকে ‘বিটি’ (মেয়ে) সম্বোধন করেছে, কিন্তু তার চেপে রাখা আদিম আবেগ শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনি-না হাসুনির মার কাছে, না রহিমার কাছে। যদিও প্রতিবাদ করেনি দুজনের কেউই, বরং দুজনই বুঝে তা না বোঝার ভান করেছে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল মজিদের। হঠাৎ পাশের গ্রাম আওয়ালপুরে তাশরিফ নিলেন এক বয়স্ক পীর সাহেব। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ তার পুরানো মুরিদ। সেখানেই তিনি উঠেছেন। উর্দু ভাষাটা তার আয়ত্তে। তাঁর বোলচালে আওয়ালপুরের বাসিন্দা মুগ্ধ, দিওয়ানা। মজিদ দেখলো যে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হতে চলেছে, তাই সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হঠাতে নিজেই আওয়ালপুরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে দেখে ওই পীর সাহেব এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছেন।
বিচিত্র সুরে তিনি ফারসি ভাষায় ওয়াজ করছেন। উপস্থিত উত্তাল জনতা তার অর্থ না বুঝেই হাউ মাউ করে কাঁদছে। পীর সাহেব সেদিন দফায় দফায় ওয়াজ করছেন, ওদিকে জোহরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। হুজুরের মুরিদরা একবাক্যে মেনে নিয়েছে তাদের পীর-এ কামেল সূর্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন। তিনি যতক্ষণ না সূর্যকে হুকুম দেবেন, সূর্য এক আঙ্গুলও নড়তে পারে না।
অবেশেষে আসরের নামাজের সময় যখন জোহরের নামাজ পড়ার জন্য সবাই কাতারবদ্ধ হয়, মজিদ চিৎকার করে প্রতিবাদ করে, “যতসব শয়তানী, বেদাতী কাজ কারবার। খোদার সঙ্গে মস্করা।” উল্লেখ্য, একই কাজ এতদিন সে নিজে করে এসেছে, কিন্তু আজ যখন মাঠে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত, তার মুখে শোনা যায় উল্টো কথা।
এরপর পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে মজিদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। অবশেষে মজিদ এলাকার লোকজনকে সাথে করে মহব্বতনগর গ্রামে ফিরে আসে-যদিও গ্রামবাসী দোটানায় ছিল। একদিন তাদের মনে ছিল মোদাচ্ছের পীরের প্রতি ভয় তথা মজিদের প্রতি আনুগত্য। অন্যদিকে আওয়ালপুরে আগত উর্দু-ফারসিভাষী বয়স্ক পীর সাহেবের প্রতি কৌতূহল ও মোহ। তবু তারা গ্রামে ফেরে বরং বলা চলে ফিরতে হয়।
গ্রামে ফেরার পর ওই রাতেই গ্রামবাসীকে একত্র করে খালেক ব্যাপারীকে নিয়ে মজিদ এক জরুরি বৈঠক বসালো। যেখানে সে পাশের গ্রামে আগত পীর সাহেবকে ‘মনোমুগ্ধকর শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করে তার কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। সভায় সাব্যস্ত হলো: অন্তত এ গ্রামের কোনো মানুষ আওয়ালপুরের পীর সাহেবের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না। এই কড়া নিষেধাজ্ঞার পরেও মহব্বতনগর গ্রামের কয়েকজন যুবক পাশের গ্রামে পীর সাহেবের সভায় গিয়েছিল। আওয়ালপুরবাসী তাদের উত্তম মধ্যম দিয়েছিল। ফলে তাদের করিমগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
খালেক ব্যাপারীর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর নাম আমেনা বিবি, দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম তানু বিবি। আমেনা বিবি তের বছর বয়সে স্বামীর ঘরে এসেছেন আজ তার বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে। কোনো সন্তানাদি তার হয়নি। অথচ সতীন তানু বিবি বছর বছর ছেলেপুলে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কত আর সহ্য হয়? এদিকে লোকজন বলাবলি করছে: আওয়ালপুরে যে পীর সাহেব এসেছেন, উনি খুব কামেল মানুষ, তার ‘পানি পড়া’ খেলেই পেটে বাচ্চা আসবে। এদিকে আওয়ালপুরে তো যাওয়া বারণ। সেখানকার পীর সাহেবের সাথে মজিদের নাকি কী সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমেনা বিবি এসব শুনতে নারাজ। তার ‘পানি পড়া’ চাই-ই চাই। খালেক ব্যাপারী গোপনে রাজী হয়।
আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে ‘পানি পড়া’ নিয়ে আসার দায়িত্ব খালেক ব্যাপারী দিল তার সম্বন্ধী ধলা মিঞাকে। ধলা মিঞা তানু বিবির বড় ভাই। সে খালেক ব্যাপারীর বাড়িতেই থাকে। খায় দায় ঘুমায়- কোনো কাজকর্ম করে না। বাইরে থেকে তাকে বোকা কিসিমের মানুষ মনে হলেও সে আসলে ধুরন্ধর ও প্রতারক। সে তার ভগ্নিপতিকে জানায় যে আওয়ালপুরে গিয়ে ‘পানি পড়া’ এনে দেবে কিন্তু সে তা করে না।
সে সোজা মজিদের কাছে চলে যায় এবং তাকেই পানি পড়ে দিতে বলে। মজিদ এতে অপমানিত হয় এবং সরাসরি টাকার ইঙ্গিত দেওয়ার পরেও সে ‘পানি পড়া’ দেয় না। ধলা মিঞা যে আওয়ালপুরের পীরের কাছে গেল না এটি মজিদের প্রতি তার আনুগত্য নয় বরং সে ছিল অলস, অকর্মণ্য ও শঠ প্রকৃতির মানুষ। তার উপর দুই গ্রামের মাঝখানে ছিল একটা মস্ত তেঁতুল গাছ- সবাই ওটাকে ভুতুড়ে গাছ বলে রাত বিরেতে এড়িয়ে চলতো। ধলা মিঞাকে রাতের বেলা ওই গাছতলা দিয়েই যেতে হতো, ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিল বলে সে তা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে।
এ ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে খালেক ব্যাপারীর সঙ্গে মজিদের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তখন খালেক ব্যাপারী মজিদকেই এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহবান জানায়। মজিদ তখন একটা কৌশলের আশ্রয় নেয়। সে বলে, আমেনা বিবির পেটে বেড়ী পড়েছে বলেই তো সন্তানাদি হচ্ছে না। পেটে নানা মাপের বেড়ী পড়তে পারে।
পেটে একুশ পর্যন্ত বেড়ী মজিদ দেখেছে বলে জানায়। সাত বেড়ী পর্যন্ত খোলা যায়, তার বেশি সম্ভব নয়। তার স্ত্রী রহিমার পেটেও তো চৌদ্দ প্যাঁচ আছে, তাই বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছে না তাদের। এ ক্ষেত্রে মজিদ কেন- কারুরই কিছু করণীয় নেই। আমেনা বিবির পেটে যদি সাত বেড়ীর বেশি না পড়ে যাকে, তাহলে মজিদ খুলে ফেলতে পারবে- মজিদ বলে। এজন্য আমেনা বিবিকে মজিদের পড়া পানি খেয়ে মোদাচ্ছের পীরের মাজার সাত পাক ঘুরতে হবে।
নির্ধারিত দিনে আমেনা বিবি রোজা রাখে। উদ্বেগে-ভয়ে-ক্ষুধায় তার দেহ-মন দুর্বল। সে মাজার সাত পাক ঘুরে আসতে সমর্থ হয় না-তিন পাক ঘুরতেই সে জ্ঞান হারিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে এলিয়ে পড়ে। ধূর্ত মজিদ জানায় আমেনা বিবি অসতী, তাই এমনটি ঘটেছে-এমন স্ত্রীকে সে যেন আর ঘরে ঠাঁই না দেয়। মজিদের হাতের পুতুল খালেক ব্যাপারী সেই কথা মতো আমেনা বিবিকে তালাক দেয়।
এদিকে হাওয়ায় কদিন ধরে একটা কথা ভাসছে। মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটা স্কুল বসাবে। আক্কাস বহুদিন বিদেশে ছিল। করিমগঞ্জের স্কুলে নাকি কিছুদিন পড়াশুনাও সে করেছে। তারপর কোথায় পাটের আড়তে না তামাকের আড়তে চাকরি করে কিছু পয়সা কামিয়েছে। কোথায় গিয়ে সে শিখে এসেছে যে স্কুলে না পড়লে মুসলমানদের মুক্তি নেই। সে স্কুলের জন্য চাঁদা তুলতে লাগলো। স্কুলের জন্য সাহায্য চেয়ে সরকারের কাছে একটা দরখাস্তও পাঠিয়ে বসে।
মজিদ আর বরদাস্ত করতে পারে না। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে নবীন প্রজন্মের চোখ-কান খুলে যাবে। এতে তার ধর্মব্যবসার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে সে আক্কাসকে ঠেকাতে উঠে পড়ে লাগে। ঠেকিয়েও দেয়। এক সন্ধ্যার পর বৈঠক ডাকা হলো। তলব করা হলো আক্কাসের বাবা মোদাব্বের মিঞাকে।
ভর মজলিসে ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে মজিদ তাকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তোমার দাড়ি কই মিঞা? ..... তুমি না মুসালমানের ছেলে-দাড়ি কই তোমার?” খালেক ব্যাপারী বলে: “হে নাকি ইংরাজি পড়ছে। তা পড়লে মাথা কি আর ঠান্ডা থাকে?” সভায় সিন্ধান্ত হয়: গ্রামে পাকা মসজিদ দেওয়া হবে। গ্রামবাসী এতে সাধ্যমতো চাঁদা দেবে। সভায় আক্কাস তার স্কুল প্রতিষ্ঠার কথাটা উত্থাপন করলে তা চাপা পড়ে যায়, এমনকি তার বাবাই বলে ওঠে-“চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইসনা।” আক্কাস অগত্যা সভা থেকে আস্তে আস্তে উঠে বের হয়ে যায়।
এদিকে মজিদকে নেশায় পেয়ে বসেছে। সে নেশা জীবনকে উপভোগের নেশা। সে আবার বিয়ে করতে চায়। রহিমাকে নানা উসিলা দেখায়। কখনও বলে: “বিবি আমাগো যদি পোলাপাইন থাকতো।” কখনও খোলাসা করে বলে: “বিবি, আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাথী আনুম?” রহিমা কী বলবে? তার মতে কী আসে যায়?
নতুন বউ হয়ে এলো যে বালিকাটি নাম তার জমিলা। জমিলাকে প্রথম দিন থেকেই রহিমা সতীন হিসেবে না দেখে মেয়ে হিসেবে দেখেছে। আদর-যত্ন করে তাকে খাওয়ায় পাশে পাশে রাখে। জমিলা খুব হাসিখুশি মেয়ে। রহিমাকে একদিন সে বলেই বসলো: বিয়ের দিন সে মজিদকে ভেবেছিল শ্বশুর আর এখানে এসে রহিমাকে দেখে মনে করেছিল এ মহিলাটি নিশ্চয়ই তার শাশুড়ি। তারপর তার প্রাণখোলা হাসি। রহিমা তাকে হাসতে বারণ করে। মজিদের বাড়িতে হাসা নিষিদ্ধ। মেয়েদের তো বটেই, কোনো মানুষের হাসি সহ্য করতে পারে না মজিদ।
মজিদ খুব কঠোর প্রকৃতির লোক। সে আড়ালে আবডালে হয়তো লক্ষ করে থাকবে যে তার বালিকা-বধূ জমিলা নামাজ পড়ে না। তাই রহিমার মাধ্যমে জমিলাকে সে নামাজ পড়ার তাগিদ দেয়। রহিমা মজিদকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে জমিলা নামাজ জানে এবং পড়বে ধীরে সুস্থে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই জমিলার ঘুম পেয়ে যায়। মজিদ বলা কওয়াতে সে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু প্রায়ই তার এশার নামাজ পড়া হয় না। আজ সে মাগরিবের নামাজ পড়ার পর থেকেই ঘুমে ঢুলছিল, তবু নামাজ পড়ার জন্য সে বসেছিল। এশার নামাজ পড়েই সে সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মজিদ ঘরে এসে হাঁকডাক শুরু করে, টান মেরে বিছানা থেকে তাকে তুলে বসায়, কিন্তু সে বলেও না যে সে এশার নামাজ পড়েই শুয়েছিল।
এরপর মজিদ শুরু করে নির্যাতন। নির্যাতন করে চলে এবং ক্রমশ তার মাত্রা বৃদ্ধি করে। সহ্য করতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে জমিলা একদিন মজিদের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দেয়। এবার মজিদের ভ্যাবাচেকা খাওয়ার পালা।
উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি: জমিলাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একাকী ঝড়ের রাতে মাজারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সারা রাত ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টি হলো। মেয়েটা একা একা পড়ে থাকে মাজারের খোলা প্রাঙ্গণে। সকালে এসে দেখা গেল, কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা। তার একটা পা কবরের গায়ে লেগে আছে। তখনও জীবিত সে।
এরপর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায়। যে রহিমা এতদিন তার অনুগত ছিল, সে ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করে। বলা যায় শুরু করেছিল আরও আগে থেকেই, কিন্তু জমিলাকে মাজারে বেঁধে রেখে আসার পর থেকেই এবার সে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন হলো। মজিদ দেখতে পাচ্ছে: হাতে সব ধরনের অস্ত্র থাকার পরেও সে পরাজিত হচ্ছে। সমাজে সে রাজাধিরাজ হতে পারে, কিন্তু নিজের ঘরে সে উদ্বাস্তু, গৃহহীন, অনাথ।
❤️❤️❤️
ReplyDeleteঅনেক সুন্দর গল্প
ReplyDelete❤️
ReplyDelete👍👍
ReplyDelete🥰🥰🥰
ReplyDelete👍👍👍
ReplyDeleteVery helpful post 🙂
ReplyDelete🙂🙂
ReplyDelete👍
ReplyDelete