‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নানা কারণে আলোচিত, ফলে সাহিত্য সমালোচনায় তা পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা চলে যে, এই চরিত্রটি নিয়ে যত কথা উঠেছে, কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদকে নিয়েও তত কথা ওঠেনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্তবাদী হওয়ার সুবাদে যার জমি যত বেশি, সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও তত বেশি হয়-এটাই নিয়ম।
খালেক ব্যাপারী মহব্বতনগর গ্রামের সমাজপতি। গ্রামীণ সমাজে এ শ্রেণির মানুষকে মোড়ল বা মাতব্বর বলা হয়ে থাকে, যারা গ্রামীণ মানুষের সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সামন্তবাদী সমাজে ভূমি মালিকদের সাথে ধর্মীয় পুরোহিতদের নিবিড় সখ্য থাকে, যা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন। একপক্ষে আছে খালেক ব্যাপারী, অন্যপক্ষের প্রতিনিধি মজিদ।
চিরায়ত বাস্তবতা এই যে, ভূমি মালিক ও ধর্মীয় পুরোহিতদের স্বার্থ সচরাচর অভিন্ন। তাই তাদের পথ এক, তারা একট্টা- হোক তা সজ্ঞানে নতুবা অজান্তে-অনিচ্ছায়। তারা একে অপরের দোসর, পথ চলার সহচর, সঙ্গী। তবে সব সময়ই লক্ষণীয় হলো: সমাজপতিই শেষ পর্যন্ত ধর্মপতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, উচ্চকণ্ঠ হয়ে থাকে; ফলে সমাজ নেতাই হয়ে যায় একচ্ছত্রধারী।
চিরায়ত এই বাস্তবতার লক্ষণ ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই। খালেক ব্যাপারী গ্রামের মোড়ল কিন্তু ধর্মীয় পুরোহিত মজিদের কথায় সে পরিচালিত। মজিদের সব কথাকে খালেক ব্যাপারী সমর্থন করেছেন, মজিদের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন নির্দ্বিধায়।
আমরা আগেই বলেছি: খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নির্মিতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাস্তবতা লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু তিনি কেন সেটি করেছেন? এ ব্যাপারে সমালোচকেরা একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন, এটি তিনি করেছেন স্রেফ শিল্পের তাগিদে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের দাপট দেখাতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার কারণে তিনি যদি খালেক ব্যাপারীকে যথার্থভাবে নির্মাণ করেন, তাহলে মজিদ গৌণ হয়ে পড়তো। মজিদকে সর্বেসর্বা হিসেবে নির্মাণ করার শিল্প পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই খালেক ব্যাপারীকে গৌণ করে অঙ্কন করার প্রয়াস। কেউ কেউ বলেছেন, এটি লেখকের অসর্তকতাপ্রসূত একটি ব্যাপার, তাই ক্ষমার্হ। তাঁরা এই যুক্তি দেন যে, ‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী দ্বারা আর কোনো চরিত্র দুর্বল সৃষ্টি নয়।
তৃতীয় পক্ষের দাবি এই যে: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নগর জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা সবই শহরে। তিনি তাঁর কর্মজীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বিদেশে, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামীণ বাংলার জনজীবনের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতা ছিল না। যার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।
সাহিত্য সমালোচনায় বিভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, তৃতীয় মতটিই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।
0 Comments:
Post a Comment