একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
বাংলা সহপাঠ গাইড
উপন্যাস
লালসালু
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। সীমিত আয়তনের এ উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে কিশোরী এ মেয়েটির আগমন; যে-কিনা নিতান্তই হতদরিদ্র একটি পরিবারের কন্যা।
কিন্তু তার প্রভাবে প্রবল মজিদ বিচলিত, উন্মূলিত হয়ে পড়ে। জমিলা যে দারিদ্র লাঞ্ছিত, সাধারণ একটি গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে, সেটি খুব সহজেই আমরা কল্পনা করতে পারি এই সূত্রে যে, তার বাবা পৌঢ় এবং বিবাহিত মজিদের সাথে কন্যার বিবাহ দিতে কোনো রকম দ্বিধা করেনি- বরং আমাদের সংগত অনুমান: কন্যাদায়গ্রস্ত হতভাগ্য পিতার কাছে এটি সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই গণ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি লক্ষযোগ্য, সেটি হলো: জমিলাও এটি অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে করেনি শুধু একটু কৌতুক অনুভব করেছিল। স্বামীগৃহে আসার পর সতীন রহিমাকে একদিন পরিহাস করে সে বলেছিল, প্রথম দেখায় মজিদকে সে শ্বশুর মনে করেছিল, আর রহিমাকে দেখে ভেবেছিল শাশুড়ি।
এই পরিহাসের তরল স্রোতের মধ্যে হয়তো অন্তর্লীন হয়ে আছে একটুখানি হতাশা, দুঃখ, গ্লানিও; তবে তার মধ্যে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার প্রবল একটা ব্যাপার ছিল- আবহমান কালের সব বাঙালি নারীর ভেতরই যেমন থাকে সব দুর্ভাগ্যের সাথেই নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার একটা দীর্ঘশ্বাসজড়িত বিচ্যুতি।
তাহলে সমস্যা কোথায়? জমিলা তো সব মেনেই নিয়েছিল। পৌঢ় স্বামীর কাছে এসে সে সবকিছু সমর্পণ করেছিল একে একে। সবকিছু দিয়ে দেওয়ার পরেও প্রতিটি মানুষের কিছু কিছু জিনিস থেকেই যায়, যেটা কাউকে দেওয়া যায় না- আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।
জমিলা তার এই হাতের পাঁচগুলো যক্ষের ধনের মতো বুকের মধ্যে আগলে ধরে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু দুর্বার মজিদ সেগুলোও কেড়ে নিতে যখন তৎপর হয়ে উঠলো, তখন জমিলাকে আমরা দেখি নতুন এক রূপে-মজিদেরই প্রতিপক্ষ হিসেবে। মহব্বতনগর অঞ্চলে কেউ যা কল্পনাও করতে পারে না, ঘরের ভেতরে থেকে জমিলা করে বসলো তাই। তার আক্রমণটা আসলো ভেতর থেকে। মজিদকে সে ধরাশায়ী করে ফেলে।
প্রশ্ন ওঠতেই পারে, জমিলার হাতিয়ারটি কী? জমিলার হাতিয়ার হচ্ছে (হাতিয়ার না বলে মারণাস্ত্র বলাই ভালো) সহজ প্রাণধর্ম। সে ধর্মের নমে প্রচলিত শাস্ত্রশাসনের অনুগামী নয় বরং মুক্তধর্মে বিশ্বাসী। সে প্রাণোচ্ছ্বল। মন খুলে সে হাসে, নানা রকম কৌতুককর কথা বলে। ভুয়া মাজারের ভয় তাকে দেখালে সে ভয় পায় না।
মজিদ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে-এটা সে মেনে নিতে পারে না, তার সাথে করা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনগুলো সে অকপটে হজম করতে পারে না। ঘুমকাতুরে জমিলা নামাজ পড়েই শুয়েছিল-কিন্তু সে এশার নামাজ পড়েছে কিনা-এই নিয়ে মজিদ হল্লা করলে সে হ্যাঁ, না কিছুই বলে না। স্পষ্টতই, মজিদকে সে ঘৃণা করে তাই মজিদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতেও সে দ্বিধা করে না।
বিশ শতক পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের আদর্শবাদী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মানসকন্যা, যথার্থ আদর্শবাদী চরিত্র, যাকে দিয়ে ঘুনেধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মুখে থুতু দিয়েছিল। লালসালু কাপড়ে ঢাকা ধর্মব্যবসায়ীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং উপন্যাসের শেষে তাঁর এই মানসকন্যাকে দিয়েই তথাকথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার (শেয়ালের গর্ত)-কে পক্ষাঘাত করেছেন।
বলা যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি সাহিত্যিক পরিকল্পনা ছিল, ‘লালসালু’ উপন্যাস রচনা করে জমিলা চরিত্রটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে তার বাস্তবায়ন ঘটেছে।
0 Comments:
Post a Comment