তার কোনো নাম নেই। সে পরিচিত হয়েছে তার পুত্রের মাতা হিসেবে। তার বাবা-মায়েরও এই একই দশা-তাহের-কাদেরের বাপ, মা। সমাজে নিশ্চয়ই এই সব মানুষের নাম থাকে কিন্তু সমাজ তা একীভূত করে দেয় তাদের সন্তানের নামের মধ্যে।
তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই যে, সমাজের ওপর তলায় এটি ঘটে না, ঘটে কেবল গ্রামীণ নিম্নবিত্তদের মধ্যে। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় স্ত্রী তানু বিবি বছর বছর সন্তান জন্ম দিয়েও তার নাম কিন্তু সন্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না, নাম বিলীন হয়ে যায় হাসুনির মায়ের।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা হাসুনির মাকে দেখি সহজ, সরল, অনাথ এক পরমদুখিনী নারী। বাবার সংসারে নিত্য অভাব। বাবা-মা সারাক্ষণ অকথ্য ভাষায় ঝগড়া এবং মারপিট করে। বিয়েও হয়েছিল তার। স্বামী মারা গেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব খারপ বলে সেখানেও সে যেতে চায় না। অথচ পেটে তার ক্ষুধা। ক্ষুধা তো তার একার নয়, সাথে আছে তার শিশুপুত্র হাসুনি। সে যাবে কোথায়? বাবার বাড়িতে ভাত নেই, শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই নেই, কোথায় সে যাবে?
হাসুনির মার কাজ মিললো মজিদের বাড়িতেই। রহিমাকে সে খুব আপনজন বলেই মনে করে। তাই মুখ ফুটে তার কষ্টের কথাগুলো বলে। রহিমার কাছে। সে বলে, “আমার আর্জি- এনারে কইবেন আমার যেন মওত হয়।..... জ্বালা আর সহ্য হয় না বুবু।
আল্লাহ যেন আমারে সত্বর দুনিয়া থিকা লইয়া যায়।” হাসুনির মার প্রতি মজিদের আদিম আবেগ, কামনা-বাসনা এবং তার প্রকাশ হিসেবে শাড়ি উপহার, যা কিনা রহিমা বুঝতে পারে, হাসুনির মাও বুঝতে পারে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না- করতে পারে না। স্মরণাতীত কাল থেকেই বাঙালি নারীকে সংসার করতে হলে সহ্য করতে হয়; আমরা দেখি, রহিমা সহ্য করেছে, হাসুনির মা-ও সব বুঝে না বোঝার ভান করে মজিদের বাড়িতেই দাসিবৃত্তি করে যাচ্ছে- না করলে খাবে কী?
তবে কি হাসুনির মা পরিপূর্ণভাবেই একটি দুঃখবাদী চরিত্র? যতই সে নিজের মৃত্যু কামনা করুক, দূরের ধান ক্ষেতের তাজা রং হাসুনির মায়ের মনে পুলুক জাগায়। পাশের বাড়ির তেল চকচকে জোয়ান কালো ছেলেটাকে নিকা করার জন্য তার মন আনচান করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে চরিত্র সৃষ্টি করেছেন মানুষের বহির্জগৎ ও তার অন্তর্জগতের সমন্বয়ে- হাসুনির মা তার বড় একটি দৃষ্টান্ত।
0 Comments:
Post a Comment