কৃষিকাজে বিজ্ঞান
[রা. বো. ১৪, দি. বো. ১৪, সি. বো. ১১]
সূচনা: মানুষের সবচেয়ে আদি পেশা হলো কৃষি। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে কৃষির ক্রমবিবর্তন ধারা। এই পেশায় নিয়োজিতদের কৃষক বলা হয়। কৃষকরা মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা খাদ্যের সরাসরি জোগানদাতা। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে কৃষিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন পদ্ধতি। এ কথা কারো অজানা নয় সভ্যতার অগ্রগতি আর উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। কৃষিতে এই বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োগ না হলে এত দিনে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত। কারণ প্রতিদিন মানুষ বাড়ছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমি বাড়ছে না। সময়ের এই দাবি পূরণ বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতি ছাড়া সম্ভব নয়।
অধিক ফলনের মূলমন্ত্র: অধিক ফলন, উন্নত জাত উদ্ভাবন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া চাহিদা পূরণ করতে কৃষিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ১৯৬১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ।
এই বাড়তি সংখ্যার খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতির কারণেই। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি অধিক ফলনের মূলমন্ত্র।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের পরিধি: বীজ বাছাই, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, রোপণ থেকে শুরু করে মাঝের পরিচর্যা বীজতলা তৈরি এবং ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। উন্নত বিশ্বে কৃষি এখন আর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কৃষকের হাতের নিয়তির ভাগ্যচক্র কিংবা প্রকৃতির জুয়াখেলার ওপর নির্ভরশীল নয়। কৃষির প্রতিটি পর্যায়েই রয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির স্পর্শ।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণেও তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেয়। এতে দ্রুত ফসল ভোক্তার কাছে পৌঁছে এবং অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা নিচের উপশিরোনামগুলোতে তুলে ধরা হলো।
মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা: ফসল রোপণের আগে অবশ্যই মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা অপরিহার্য। মাটির বিভিন্ন ধরনের উপাদান যেমন খনিজ লবণ, কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রজেন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পরিমাণমতো আছে কি না, তা জানা থাকলে সার প্রয়োগ ও ফসলের জাত নির্ণয়ে সুবিধা হয়। মাটির গুণাগুণ এবং অঞ্চল ভেদে অনুপাতের তারতম্য নির্ণয়ে এখন কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
চাষের জমি তৈরি: ফসল রোপণের আগে হাল-চাষের মাধ্যমে জমি তৈরি করতে হয়। সনাতন পদ্ধতিতে এ কাজে গরু ও কাঠের লাঙল ব্যবহার করা হতো। আধুনিক বিজ্ঞান জমির হাল-চাষের জন্য তৈরি করেছে ট্রাক্টর বা কলের লাঙল। এর মাধ্যমে দিয়ে কম সময়ে বেশি জমি গভীরভাবে কর্ষণ করা যায়। ফলে এতে কৃষকের শ্রম, সময় ও অর্থ যেমন বাঁচে উৎপাদনও বেশি হয়।
সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যা: আধুনিক কৃষি আজ আর প্রকৃতির বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে সেচ দিয়ে ফসলকে খরার কুপ্রভাব থেকে রক্ষা হয়। বীজ রোপণ, বীজতলা তৈরি, আগাছা পরিষ্কার ও সার-কীটনাশক ছিটানোসহ অন্যান্য পরিচর্যাও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে করলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস: কৃষিকাজের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়া অনুকূল হলে অধিক ফসল কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে বর্তমানে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
জিন গবেষণা: জিনের মধ্যে জীবের বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে। জিন গবেষণা কৃষি জগতে এক ধরনের বিপ্লব এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন বুঝে একই প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের আদান-প্রদান করছেন। এতে অল্প জায়গায় অধিক ফসলের পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশেও ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে।
খামার পরিচালনা: খামার ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক মডেল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য খরচ, উৎপাদন, কর্মী নির্বাচন, বিপণন, আবহাওয়া, ফসল বাছাই এগুলোর গাণিতিক সূক্ষ হিসাব জানা জরুরি। এজন্য উন্নত বিশ্বে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খামারের প্যারামিটারগুলো হিসাবের জন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।
প্রযুক্তি বিনিময়: উন্নত বিশ্বে কৃষকদের মাঝে কম্পিউটারনির্ভর নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টি করা। এজন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, ফ্যাক্স, সিডি, পত্রিকা, বুলেটিন, জার্নাল ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার দরকার। বাংলাদেশেও কয়েকটি মোবাইল অপারেটর ইতোমধ্যেই কৃষি তথ্যসেবা সার্ভিস চালু করেছে।
বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা: আমাদের কৃষি এখনও সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। এর অন্যতম কারণগুলো হলো:
১. কম্পিউটার ও প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব,
২. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক, যন্ত্রপাতি এবং সংগঠনের অভাব,
৩. ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা,
৪. তথ্যকেন্দ্রের অভাব,
৫. ভাষাগত সমস্যা। কারণ অধিকাংশ তথ্যই থাকে ইংরেজিতে, যা সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জটিল।
আমাদের করণীয়: কৃষিপ্রধান অর্থনীতির এই দেশের অবস্থার পরিবর্তন উল্লিখিত সমস্যাসমূহের সমাধান ছাড়া সম্ভব নয়। বিশ্লেষকদের মতে এ জন্য আমাদের করণীয় হলো:
১. কৃষকদের কম্পিউটারের সাধারণ ব্যবহার বিষয়ে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৩. গ্রামে গ্রামে কৃষি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা।
৪. মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে জটিল তথ্য সহজ করে কৃষকের মাঝে উপস্থাপন করা।
৫. কৃষকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য স্থানীয়, এনজিও এবং সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া।
উপসংহার: বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে। কৃষিই তাদের প্রধান জীবিকা। কৃষকরা চাষাবাদের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে। কিন্তু দুঃখের কথা এখনও এ দেশের কৃষক সম্প্রদায় সেই চিরাচরিত প্রাচীন পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ করে চলছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা এখনও খুব নিম্নমানের। এর অবসান খুবই জরুরি। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই কৃষিতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। কৃষি বিশ্লেষকদেরকে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সাথে অংশগ্রহণ করে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ সার্বিক উন্নতি লাভ করতে পারব।
👍
ReplyDelete