গ্রন্থাগার
ভূমিকা: শিক্ষান্বেষী মানুষের কাছে গ্রন্থাগার এক চির-কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান-তীর্থ, সেখানে সে তার মুক্তির সন্ধান পায়। খুঁজে পায় এক দুর্লভ ঐশ্বর্যের খনি। গ্রন্থাগারেই পাঠক সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার স্পর্শ পায়, অনুভব করে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের হৃদয় কল্লোল, শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতান ধ্বনি। দেশে দেশে হৃদয়ে হৃদয়ে রচিত হয় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।
গ্রন্থাগারের সংজ্ঞা: গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Library’-এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Liber থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক’। Liber শব্দটি এসেছে Libraium শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক রাখার স্থান’। অ্যাংলো ফ্রেঞ্চ শব্দ Librarie অর্থ হলো পুস্তকের সংগ্রহ। গ্রন্থাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠক-গবেষকদের ব্যবহারের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, পাণ্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করে রাখা হয়। প্রাচীনকালে গ্রন্থাগার রাজন্যবর্গ ও অভিজাতগণ ব্যবহার করতেন।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। সময়ের বিবর্তন, মুদ্রণযন্ত্র ও কাগজ-কালির আবিষ্কার, গ্রন্থের সহজলভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রন্থাগারের চর্চা সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে তথ্য ও গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অনেক।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস: মুদ্রণ প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে বই-পুস্তক, চিঠিপত্র, দলিলাদি লেখা হতো গাছের পাতা ও বাকল, পাথর, মাটির পাত্র, পশুর চামড়া প্রভৃতির ওপর। এসব উপাত্ত-উপকরণ গ্রন্থাগারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হতো। মেসোপটেমিয়া বা বর্তমান ইরাক অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রায় ৩০ হাজার পোড়ামাটির ফলক নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। মেসোপটেমীয় উপত্যকায় যথাক্রমে সুমেরীয় ব্যাবিলনীয় এবং এশিরীয়রা বসতি গড়ে তোলে এবং সে সময়ে গ্রন্থাগার স্থাপন করে তারা সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখে।
বাংলাদেশে গ্রন্থাগারের ইতিহাস: বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে পুথি-পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের প্রথা ছিল। ১৭৮০ সালে শ্রীরামপুর মিশন মুদ্রিত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে। এরপরই কলকাতা মাদ্রাসা ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পুথি ও মুদ্রিত গ্রন্থের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়। ১৯২০-এর দশক থেকে গ্রন্থাগার একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় বেসরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক জরিপে দেখা যায় সারা দেশে প্রায় ১,৬০০ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার আছে।
গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ: গ্রন্থাগার বলতে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহশালা বোঝায়। এ সংগ্রহ ব্যক্তিগত হতে পারে আবার জনসাধারণ বা রাষ্ট্রেরও হাতে পারে। গ্রন্থাগার তিন প্রকার- ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ব্যক্তিমনের খেয়ালমতো গড়ে ওঠে। তা হয়ে ওঠে ব্যক্তিমনের প্রতিবিম্ব। ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাই বিশেষ ধরনের গ্রন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকা স্বাভাবিক। পারিবারিক গ্রন্থাগার পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া। দশজনের রুচির দিকে নজর রেখেই এ গ্রন্থাগার সাজাতে হয়। আর সাধারণ গ্রন্থাগার আধুনিক জিনিস। এর গ্রন্থ নির্বাচনে বহুজনের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই এ ধরনের লাইব্রেরিতে গ্রন্থের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে।
গ্রন্থাগারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা: একটি লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় পঠিত প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।’ গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব পর্যায়ক্রমে তা তুলে ধরা হলো।
১. জ্ঞানের সংগ্রহশালা: গ্রন্থাগার হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংরক্ষণাগার। এখানে এসে জ্ঞানপিপাসু মানুষ খুব সহজেই তার পিপাসা মেটাতে পারে। একজন মানুষের পক্ষে সকল বিষয়ের গ্রন্থ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা কঠিন। মানুষ যাতে সহজেই বই সংগ্রহ করে জ্ঞানার্জন করতে পারে সেজন্যই গড়ে তোলা হয় গ্রন্থাগার।
২. বর্তমান ও ইতিহাসের সেতুবন্ধ: গ্রন্থাগার অনন্তকালের সাক্ষী। অতীতের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, রহস্য, আবিষ্কার সমস্ত কিছুই গ্রন্থাগারে রাখা বইয়ের কাগজে বাঁধা পড়েছে। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা নির্মাণ করে আমাদের আগামী। এভাবেই লাইব্রেরি অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র রচনা করে।
৩. আলোকিত মানুষ গড়ার হাতিয়ার: আলোকিত ব্যক্তি গঠন করতে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগারে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যচিত্তে নিজের রুচিমাফিক বই পড়তে পারে। এভাবে মানুষ স্বশিক্ষিত তথা সুশিক্ষিত হয়। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটে। মনুষ্যত্বের উদ্দীপ্ত মানুষেরাই দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর কাজে ব্রতী হয়।
৪. পরিবার গঠনে ভূমিকা: কোনো পরিবারে যদি গ্রন্থাগার থাকে, তাহলে সেই পরিবারের মানুষের চালচলনে এর একটি প্রভাব লক্ষ করা যায়। সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য চাই বই। ভালো মানের বই। সন্তানের অবসর সময় কাটানোর জন্য বই হতে পারে তার ভালো বন্ধু। হাতের কাছে বই থাকলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাই হোক সে বই পড়বেই। জানার ক্ষুধা সবারই আছে। ছোটদের মধ্যে নতুনকে জানার ইচ্ছা আরও প্রবল। একটি পারিবারিক গ্রন্থাগার আদর্শ পরিবার গঠনে ভূমিকা রাখে।
৫. চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয়: বই পড়লে মানুষের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয়। মানুষ ভালো গুণাবলি আয়ত্ত করার কৌশল শেখে। একজন সৎ মানুষ আরও সৎ হয়। মানুষের সচেতনতা বাড়ে, দায়িত্বশীল ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সে গড়ে ওঠে। একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার মানুষকে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
৬. চরিত্র গঠনের ভূমিকা পালন করে: একটি ভালো বই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। আদর্শ চরিত্রবান মানুষ তৈরি করতে বইয়ের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা সময় পর মানুষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু গ্রন্থাগারের দুয়ার সব বয়সের মানুষের জন্য খোলা।
৭. সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার: সমাজ থেকে অজ্ঞতা, কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করতে গ্রন্থাগার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করে। আর অজ্ঞতা কুসংস্কার দূর করতে না পারলে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৮. দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করে: আদর্শ চরিত্রবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হবে না। সম্ভব হবে না দেশের প্রতিটি নাগরিকের মুখে হাসি ফোটানো। আর এজন্য শিক্ষিত ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে সুশিক্ষিত ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দরকার তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ব্যাপ্ত করা।
উপসংহার: গ্রন্থাগার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান। অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এর বিকল্প নেই। তাই এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন প্রতিটি মানুষের জন্যই অপরিহার্য। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াত করছে।
আমাদের দেশে শহর ও গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার দিকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারব।
0 Comments:
Post a Comment