গ্রাম্য মেলা | রচনা

গ্রাম্য মেলা

ভূমিকা: গ্রামীণ জীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ গ্রাম্য মেলা। বিনোদনহীন নিরানন্দ একঘেয়ে গ্রাম্য জীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা। গ্রামবাসী এই দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। মানুষের সাথে মানুষের, শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয়। মানুষের মেলা আর মেলার মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়ে।

মেলার উৎপত্তি: মেলার শুরু ঠিক কবে থেকে সে সম্পর্কে কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। অর্থাৎ, মেলার জন্মকথা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথা বলা যায়, যখন থেকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের শুরু, তখন থেকে মেলারও শুরু।

মেলার স্থান, উপলক্ষ্য: গ্রামের বেশির ভাগ মেলাই বসে নদীর তীরে। মেলার পসরা সাজিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসে নৌবহর। বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের ছায়ায়, কখনো বা বিস্তৃত খোলা মাঠে বসে মেলা। নির্জন অশ্বত্থতল কিংবা নদীতীর হয়ে ওঠে কোলাহল মুখরিত। নানা উপলক্ষে গ্রামে মেলা বসে। আবহাওয়া ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়। প্রবীণরা এখনো বলেন, এলো পৌষ বলে শীত যখন জেঁকে বসে তখন প্রথমেই মনে পড়ে যায় মেলার কথা। শীতের শেষে গাঁয়ের মানুষের শস্যভাণ্ডার থাকে পূর্ণ। পিঠা-পার্বণের উৎসব চলে।

এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা

এ সময় তাদের অখণ্ড অবসর। এই অবসরে আনন্দের স্পর্শ জাগায় মেলা। বাংলা বছরের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির মেলার মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় আর বৈশাখি মেলায় নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এ ছাড়াও মহররমের সময়ও মেলা বসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। আবহমানকাল থেকেই ধর্মীয় ও লৌকিক উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা। রবীন্দ্র পরিবারে ছিল মেলার চল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীক্ষা উপলক্ষে বাংলা ১২৫০ সনের ৭ই পৌষ একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মেলার উদ্বোধনী দিনে তিনি ভাষণও দিতেন। এমনই এক মেলায় উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেলার উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। হৃদয় খুলে দান করবার ও গ্রহণ করবার এই মেলাই হলো প্রধান উৎস ও উপলক্ষ।’

গ্রাম্য মেলার পুরনো ইতিহাস: বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে মেলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মোগল আমলে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গ্রাম্য মেলা বসত। ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা হয়েছে, মেলা এলেই গ্রামে পড়ে যেত সাজ সাজ রব। গ্রামবাংলার আসল রূপ যেন তখনই ফুটে উঠত। মানুষের মন তখন আনন্দমুখর। এরও আগে মেলা রাজ-আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কালের আবর্তে মেলা সাধারণ জনগণের আওতায় আসে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে গ্রাম্য মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা ছিল গ্রাম্য মেলাগুলোর। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, পালাগান, যাত্রা, লেটোর আসর। অতীতে প্রধানত শীতকালেই মেলা হতো। কালক্রমে তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, লোকজ সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ ইত্যাদিতে বিস্তৃতি পায়।

বৈশাখি মেলা, কার্তিকের মেলা, আশুরার মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, রাস পূর্ণিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথি মেলা ইত্যাদি একসময় শুধুই গ্রামবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে তা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের কর্মকোলাহলের মাঝেও ঠাঁই করে নিয়েছে।

মেলায় যেসব জিনিসের সমাগম ঘটে: নতুন ধানের তৈরি পিঠে-পুলি, পায়েস, কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য যেমন- বাঁশ-বেতের ডালা, কুলা ও অন্যান্য আসবাব, বিভিন্ন ধরনের খেলনা; মৃৎশিল্প যেমন- মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিস, পুতুল, তাল পাতার পাখা, শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, লোহার ও কাঠের নানা সামগ্রী, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, নাড়ু, ছাঁচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস যেমন- হাতি, ঘোড়া, পাখি, আম, কাঁঠাল, মসজিদের গম্বুজ, মন্দিরের চূড়ো, নলেন গুড়ের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি ইত্যাদি অসংখ্য সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে।

গ্রাম্য মেলার তাৎপর্য: বাংলার গ্রামীণ জীবন যেন সার্থকভাবে ফুটে ওঠে গ্রামের মেলায়। মেলা যেন উপেক্ষিত গ্রামের মানুষদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র। গ্রামের আর্থ-সামাজিক জীবনের সাথে মেলার যোগ নিবিড়। হস্ত ও কুটিরশিল্প এবং রকমারি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে মেলায়। গ্রামের অবহেলিত সম্প্রদায়- দরিদ্র কুমোর, কামার, তাঁতি তাদের তৈরি পণ্য নিয়ে সহজেই মেলায় আসতে পারে। পণ্যের কারিগরের সাথে ক্রেতার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়।

সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। আবিষ্কৃত হয় নানা রকম নকশা, কারুকাজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান পায় পূর্ণতা। কঠোর পরিশ্রমী মানুষ কিছুদিনের জন্য আনন্দে অভিভূত হয়। এমন প্রাণপ্রাচুর্যময় আয়োজন আর দেখা যায় না। পসরা কেনাবেচার পাশাপাশি চলে লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা, মোরগের লড়াই, হা-ডু-ডু, পুতুল নাচ প্রভৃতি খেলা। বাঙালি নতুন করে স্বাদ পায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের।

উপসংহার: গ্রামবাংলার মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বছরের পর বছর এই মেলা আমাদের সংস্কৃতিকে একভাবে টিকিয়ে রেখেছে, যদিও আজ নগর জীবনের বিলাসিতার উপকরণ গ্রামগুলোকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। শহরের বৈদ্যুতিক বাতি, মাইক্রোফোনে ব্যান্ড সংগীত মেলার পুরনো ঐতিহ্যকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে।

গ্রাম্য মেলা | রচনা

তারপরও মেলার দিনটির জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে গাঁয়ের মানুষ। গ্রামে এমন প্রাণোচ্ছল সময়, এমন প্রাচুর্যময় মিলনমেলা আর কখনো আসে না।
Share:

0 Comments:

Post a Comment

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি

HSC Exam Routine

এইচএসসি পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির গাইডসমূহ
(সকল বিভাগ)
বাংলা ১ম পত্র ১ম পত্র গাইড | বাংলা ২য় পত্র গাইড | লালসালু উপন্যাস গাইড | সিরাজুদ্দৌলা নাটক গাইড | ইংরেজি ১ম পত্র গাইড | ইংরেজি ২য় পত্র গাইড | আইসিটি গাইড | হিসাব বিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | হিসাব বিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | জীববিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | জীববিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র গাইড | ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র গাইড | রসায়ন ১ম পত্র গাইড | রসায়ন ২য় পত্র গাইড | পৌরনীতি ১ম পত্র গাইড | পৌরনীতি ২য় পত্র গাইড | অর্থনীতি ১ম পত্র গাইড | অর্থনীতি ২য় পত্র গাইড | ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা ১ম পত্র গাইড | ফিন্যান্স ব্যাংকিং ও বীম ২য় পত্র গাইড | ভুগোল ১ম পত্র গাইড | ভুগোল ২য় পত্র গাইড | উচ্চতর গণিত ১ম পত্র গাইড | উচ্চতর গণিত ২য় পত্র গাইড | ইতিহাস ১ম পত্র গাইড | ইতিহাস ২য় পত্র গাইড | ইসলামের ইতিহাস ১ম পত্র গাইড | ইসলামের ইতিহাস ২য় পত্র গাইড | কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র গাইড | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র গাইড | যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র গাইড | যুক্তিবিদ্যা ২য় পত্র গাইড | মনোবিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | মনোবিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | পদার্থ বিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ ১ম পত্র গাইড | উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ ২য় পত্র গাইড | সমাজকর্ম ১ম পত্র গাইড | সমাজকর্ম ২য় পত্র গাইড | সমাজবিদ্য ১ম পত্র গাইড | সমাজবিদ্যা ২য় পত্র গাইড | পরিসংখ্যান ১ম পত্র গাইড | পরিসংখ্যান ২য় পত্র গাইড | ইংরেজি শব্দার্থ VOCABULARY

Admission Guide