একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
বাংলা সহপাঠ গাইড
নাটক
সিরাজউদ্দৌলা
সিকান্দার আবু জাফর
Character discussion of Sirajuddaula play: Ghaseti Begum pdf download
চরিত্রঃ ঘসেটি বেগম
ভূমিকা: ঘসেটি বেগম নবাব আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। তার স্বামী ছিলেন ঢাকার দেওয়ান। কিন্তু বিলাসী নবাব-জামাতা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে আসতেন না। তার অবর্তমানে ঢাকায় শাসনকার্য চালাতেন রাজা রাজবল্লভ।
স্বামীর মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগম বাস করছিলেন মতিঝিলে নিজের প্রাসাদে। নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম নিজের পালিত পুত্র শওকতজঙ্গকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, অপুত্রক নবাব আলিবর্দীর মৃত্যুর পরে অপদার্থ ভাংখোর শওকতকে নামেমাত্র বাংলার মসনদে বসিয়ে নিজেই দেশ শাসন করবেন। তখন তার অনুগ্রহভাজন রাজা রাজবল্লভ বাংলার শাসনকার্য চালাবেন তার হয়ে। কিন্তু নবাব আলিবর্দী মৃত্যুর আগে সিংহাসন দিয়ে যান তাঁর যোগ্যতম দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে।
ফলে ঘসেটির লালিত স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি সিংহাসন লাভেব্যর্থ হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠেন সিরাজের বিরুদ্ধে। অজস্র অর্থ ব্যয় করে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলেন নবাবের বিরুদ্ধে। মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখ প্রভাবশালী আমির-ওমরাহদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে তিনি ষড়যন্ত্র করছিলেন শওকতজঙ্গকে বাংলার মসনদে বসাবার জন্য।
সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করতে শওকতকে যে-যুদ্ধ করতে হবে তা পরিচালনা করবেন পরোক্ষে থেকে তিনি; তিনিই তাঁর ব্যয়ভার বহন করবেন; অর্থ দিয়ে, সৈন্য দিয়ে, মৌখিক অনুমোদন দিয়ে শওকতের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন আমির-ওমরাহরা।
ষড়যন্ত্রকারী: এ ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নাচ-গানের জলসার আড়ালে গোপন বৈঠক হয় ঘসেটির মতিঝিল প্রাসাদে। দেউড়িতে কড়া পাহারা দেয় সশস্ত্র প্রহরী। ঘসেটি বেগম সমবেত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শওকতকে নবাব করার জন্য কে কী পুরস্কার চান তা জানতে চান। জগৎশেঠ বলেন, সিরাজের বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে তারা তো ইতোমধ্যে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছেন। তবে শওকত নবাব হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কী পাবেন তা তিনি স্পষ্টভাবে জানতে চান।
তিনি বলেন, শওকতজঙ্গ নবাবী পেলে বেগম সাহেবা ও রাজা রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে, অন্যদের তেমন কোনো আশা নেই। তাই তাদের পক্ষে নগদ কারবারই তিনি ভালো মনে করেন। তিনি নগদ টাকা চান না, যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা তিনি সাধ্য মতো দেবেন; কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে তাকে একটা কর্জনামা লিখে দিলেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। এভাবে যখন আলোচনা অগ্রসর হচ্ছিল, তখন হঠাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার গোপন বৈঠকের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে অসাধারণ বুদ্ধিমতী ঘসেটি বেগম মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
হীনবুদ্ধি নারী: ঘসেটির বুকে কঠিন আঘাত হেনে নবাব তাঁর খালাআম্মা ও উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তাকে শায়েস্তা করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন। তিনি নিজে এসেছেন তাঁর শ্রদ্ধেয়া খালাআম্মাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যেতে। বুদ্ধিমতী নারী বুদ্ধির খেলায় নিজের কোলে-পিঠে মানুষ করা বোনপোর কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েন। ক্ষোভে-দুঃখে তিনি পাগলিনী হয়ে যান।
তিনি মুখের খোলস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রকাশ্যে উপস্থিত ওমরাহদের সাহায্য কামনা করেন। তিনি একজন অসহায় বিধবা। তার ওপর সিরাজ ওভাবে অত্যাচার করছে জানিয়ে তিনি রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য কামনা করেন। দুঃখে, হতাশায়, আশা ভঙ্গের বেদনায় রমণী সিরাজকে অভিশাপ দেন। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এ উচ্চাভিলাষী রমণীর সকল আশার সমাধি রচনা করে নবাবের আদেশে মোহনলাল তাকে সসম্মানে নিয়ে যান নবাবের প্রাসাদে, নবাব-জননী তার ছোটবোন আমেনা বেগম আর নবাব মহিষী লুৎফুন্নেসার কাছে।
উচ্চাভিলাষী: ঘসেটি বেগম ছিলেন উচ্চাভিলাষী, বাংলার শাসনকার্যে কর্তৃত্ব লাভের জন্য অতিমাত্রায় উৎসাহিনী। তার উচ্চাভিলাষ পূরণের পথে একমাত্র অন্তরায় সিরাজের উচ্ছেদ সাধনে তিনি বদ্ধপরিকর। লুৎফুন্নেসার সশ্রদ্ধ সালামের প্রত্যুত্তরে এই ঈর্ষাপরায়ণা রমণী তাঁকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করতে পারেন নি। বলেছেন, তাকে সুখী ও সৌভাগ্যবতী হবার দোয়া করলে তা তার নিজের পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি সিরাজের সর্বনাশ কামনা করেন, বাংলার সিংহাসন থেকে তাঁকে বিতাড়িত করবার জন্য তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন। অথচ- ছেলেবেলায় সিরাজকে তিনিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন, সিরাজ জননী সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে বলেন, “অদৃষ্টের পরিহাস তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তাহলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।”
উপসংহার: ঘসেটি বেগম ঈর্ষা করতেন সিরাজকে এবং সে কারণে তার ঈর্ষার আগুনে তিনি দগ্ধ করেছেন আমিনা বেগমকে, নবাব মহিষী লুৎফুন্নেসাকে। সিরাজ বাংলার নবাব আর তিনি তাঁর প্রজা- এ ধারণাটা তার কাছে ছিল একান্ত অসহ্য। নবাব তাকে নিজের প্রাসাদে এনে আবদ্ধ করে রেখেছেন, দেশের অশান্তি দূর না হওয়া পর্যন্ত বাইরের কারও সাথে যাতে তিনি যোগাযোগ করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের এ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ সময়োপযোগী, কিন্তু ঘসেটি বেগম তাতে ভীষণ ক্ষুব্ধ।
নিজের ঈর্ষার আগুনে তিনি জ্বলে-পুড়ে মরেছেন, নবাব আর তার স্নেহময়ী জননী আর প্রেমময়ী পত্নীকে পুড়িয়ে মেরেছেন, বাংলার ভাগ্যও সে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বাংলার সমকালীন ইতিহাসে ঘসেটি বেগম ছিলেন মূর্তিমতী অভিশাপ।
0 Comments:
Post a Comment