একুশে ফেব্রুয়ারি
[ঢা. বো. ১৪, রা. বো. ১৪, কু. বো. ১৩, চ. বো. ১২]
সূচনা:
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনটিতে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন করেছিল হাজার হাজার বাঙালি। ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। তাই এই দিনটি আমাদের জন্য একই সাথে গৌরবের ও বেদনার।
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট: একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালেই। তৎকালীন সময়ে ২১ মার্চ পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখনই বাংলার ছাত্র-জনতা এই ঘোষণার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এরপর আবারও ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে বাংলার ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ডাক দেয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। দিনটিতে সর্বস্তরের বাঙালি সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালালে নিহত হয় অনেকে। এই হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে গোটা দেশের ছাত্র-জনতা। আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। এর ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
শহিদ মিনার: প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ হওয়া আবুল বরকত যে স্থানে শহিদ হয়েছিলেন সেখানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি একটি শহিদ মিনার নির্মিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতারাতি ইট দিয়ে স্মৃতিফলকটি গড়ে তোলেন। ২৬ তারিখ পুলিশ সেটি ভেঙে দেয়। অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাজ শরু হয়। ১৯৬৩ সালে শহিদ আবুল বরকতের মা এটি উদ্বোধন করেন।
একুশের চেতনা: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি লড়াই করে তার অধিকার আদায় করেছে। তাই এ দিনটি আমাদের মাঝে অধিকার-চেতনা নিয়ে আসে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনাও ঘটে ভাষা আন্দোলন থেকেই। তাই এই দিনে আমরা সুন্দর দেশ গড়ার প্রেরণা পাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস পাই।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি: একুশে ফেব্রুয়ারি আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ দিনটি পৃথিবীর সব ভাষার মানুষ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। বাংলাদেশে ভাষার জন্য যে জীবনদানের ঘটনা ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাঙালির এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিকভাবে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্বের দরবারে বাঙালি লড়াকু জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্ববাসী জানতে পারে বাঙালিরা অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
একুশে ফেব্রুয়ারি পালন: প্রতিবছর নানা আয়োজনে এ দিনটি সরকারি ও বেসরকারিভাবে পালন করা হয়। সারা দেশের শহিদ মিনারগুলোতে ভোরবেলা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এদিন খালি পায়ে হেঁটে শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে বিশেষ ক্রোড়পত্র। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
উপসংহার: একুশ আমাদের অহংকার। এ দিনটি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি বিভিন্ন দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
দেশের জন্য কাজ করেছিল। তাদের মতোই একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা দেশের জন্য কাজ করব।
0 Comments:
Post a Comment