চরিত্র
ভূমিকা: চরিত্রের ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিত্ব। ভালো চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ সব গুণের অধিকারী হয়ে উঠতে পারে। ফলে চরিত্র ভালো হলে সেই ব্যক্তি সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে। কোনো ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতে চরিত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়। উত্তম চরিত্র মানুষকে ন্যায়পথে, সৎপথে পরিচালিত করে।
এই চরিত্রের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। চরিত্র ভালো হলে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। আবার চরিত্র খারাপ হলে মানুষ তাকে ঘৃণা করে। চরিত্র অনুযায়ীই গঠিত হয় ব্যক্তিজীবন, যার প্রভাব পড়ে পরিবেশ ও সমাজের ওপর।
চরিত্রের ধারণা: মানুষের সামগ্রিক জীবনের কাজ-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায়, ওঠা-বসা, আচার-আচরণে প্রকাশিত ভাবকেই চরিত্র বলে। গুরুজনের প্রতি ভক্তি, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মসংযম ইত্যাদি নানা উৎকর্ষবাচক গুণের মাধ্যমে সচ্চরিত্রের প্রকাশ পায়। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে লুক্কায়িত অপকর্ম বা পশুত্ব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলে তার মধ্যে দুশ্চরিত্রের ভাব প্রকাশ পায়।
চরিত্র গঠনের উপায়: সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সূত্র ধরেই শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীর পরিবেশের মধ্য দিয়েও চরিত্র গঠিত হয়। শিশু যখন বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে এবং সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করে তখনই তার চরিত্রের রূপ বিকশিত হতে থাকে। সেজন্য এ অবস্থায় অভিভাবক এবং শিক্ষকদের বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত, এছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানব চরিত্রের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়।
চরিত্র গঠনে পারিবারিক পরিবেশ: চরিত্র গঠনে পারিবারিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুকাল ও শৈশবকালই হচ্ছে চরিত্র গঠনের উৎকৃষ্ট সময়। তাই বাসগৃহকে চরিত্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে মনে করা হয়। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। তাই শৈশবে শিশুর কোমল হৃদয়ে যা প্রবিষ্ট হয় তা চিরস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। এজন্য শিশুর পরিবার যদি সৎ ও আদর্শবান হয় তাবে শিশুও সৎ ও আদর্শবান হতে বাধ্য। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যমে। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনেক অনুষ্ঠান রয়েছে যা শিশুদের জন্য অনুপযোগী। তাই অভিভাবককে এদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এভাবে পারিবারিক পরিবেশ শিশুর চরিত্র গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে।
চরিত্র গঠনে নিজের ভূমিকা: চরিত্র গঠনে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা ভূমিকা রাখতে পারে। বহুদিনের সাধনার ফলে মানুষ সচ্চরিত্রবান হয়ে উঠতে পারে। সাধনার মাধ্যমে সচ্চরিত্রবান হতে নিজেকে প্রত্যয়ী হতে হবে। বাস্তবজীবনে মানুষ নানা প্রয়োজনে তাড়িত হয়। কিন্তু প্রলোভনে পড়লে মানুষ তার অমূল্য সম্পদ চরিত্রকে হারাতে পারে। তাই চরিত্রকে মজবুত করতে হলে নিজেকে সকল প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাকে সকল লোভ মোহ ত্যাগ করে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে সে সচ্চরিত্র গঠনে সফল হবে বলে আশা করা যায়।
চরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও সঙ্গীদের প্রভাব: মানবচরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়। সেজন্য সে যাতে পরিবারের বাইরে কুসংসর্গে মিশতে না পারে অথবা কুকার্যে লিপ্ত হতে না পারে, সেদিকেও অভিভাবকদের লক্ষ রাখা উচিত। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাকে অন্যের সান্নিধ্য গ্রহণ করতে হয়, বন্ধু নির্বাচন করতে হয়।
সৎ চরিত্রের প্রভাবে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর ও মহৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আবার সঙ্গদোষে মানুষ কুসংসর্গে পড়ে নিজের অজ্ঞাতে পাপের পথে পরিচালিত হয়। তাই সঙ্গ নির্বাচনে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত: পৃথিবীতে যারা স্বীয় কর্মবলে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা সবাই ছিলেন চরিত্রবান ও আদর্শ মানব। আদর্শ মহাপুরুষ হযরত মুহম্মদ (সা.), মহামানব হযরত ঈসা (আ.) বা আধুনিককালের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, জগদীশ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ মহাপুরুষ চরিত্রবলেই জগতে অসাধ্য কর্মকে সহজতর করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভবপর করেছেন। তাই প্রত্যেক চরিত্রবান ব্যক্তির চরিত্রে একটা বিশেষ ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। তাঁদের অনমনীয় সেই ব্যক্তিত্ব দিয়ে তারা চারপাশের বিপন্ন পরিবেশকে সুস্থ করেছেন।
সমাজে চরিত্রবান ব্যক্তির অবস্থান: চরিত্রহীন লোক পশুর চেয়েও অধম। স্বাস্থ্য, অর্থ এবং বিদ্যাকে আমরা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাদান বিবেচনা করি। কিন্তু জীবনক্ষেত্রে এগুলোর যতই অবদান থাকুক না কেন, এককভাবে এগুলোর কোনোটিই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে সক্ষম নয়। কারণ, সমৃদ্ধিময় জীবনের জন্য চরিত্র প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তি চরিত্রবান না হলে সকলে তাকে অত্যন্ত নীচু মানসিকতার লোক মনে করে।
চরিত্র গঠনের গুরুত্ব: প্রকৃত মানুষ হতে হলে অনেক সাধনা করতে হয়। তাই এ সাধনা বা প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ হলো তার চরিত্র গঠনের সাধনা। চরিত্র গঠনের গুরুত্ব এতই ব্যাপক যে, জীবনের যাবতীয় সফলতার পূর্বশর্ত হিসেবেই একে বিবেচনা করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সুখী, সফল, আত্মপ্রত্যয়ী এবং জয়ী হওয়ার জন্য চরিত্রের প্রয়োজন। সামাজিক জীবনে প্রভাবশালী এবং বরণীয় হওয়ার জন্য ভালো চরিত্রের প্রয়োজন। ভালো চরিত্রের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য।
উপসংহার: সমাজে ভালো চরিত্রের অবস্থান অনেক ওপরে। প্রাচুর্যের বিনিময়ে সেই চরিত্রকে কেনা যায় না। ধনসম্পত্তির অভাবে মানুষ অতৃপ্ত থাকতে পারে, কিন্তু যার চরিত্র প্রকৃত অর্থে সচ্চরিত্রের গুণ লাভ করেছে সে চিরপূর্ণ ও চিরতৃপ্ত মানুষ। নশ্বর এই পৃথিবীতে বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টির সার্থকতা রয়েছে চরিত্রবান মানুষের ভালো কাজের মধ্যে।
চরিত্র মাধুর্য মানুষকে অনন্যতা দান করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার। মানবজীবনে চরিত্রর মতো বড় অলংকার আর নেই। তাই আমাদের সকলকেই চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করতে হবে।
0 Comments:
Post a Comment