বাংলা গল্প 'একটি তুলসী গাছের কাহিনি' -সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

[লেখক-পরিচিতিঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট গ্রামে জনুগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আহমদউল্লাহ। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল নোয়াখালী। কলকাতা ও ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দেশে-বিদেশে সরকারের বিভিন্ন উচ্চতর পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার, জীবনসন্ধানী ও সমাজ-সচেতন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনায় উজ্জ্বল রূপে প্রতিফলিত হয়েছে ধর্মীয় সামাজিক কুসংস্কার, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবমনের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রভৃতি। বাংলাদেশের কথাশিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন তিনি। 'লালসালু', 'চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো' তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে- গল্পগ্রন্থ: 'নয়নচারা' এবং ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প'; নাটক; 'বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’ ও ‘সুড়ঙ্গ'। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক (মরণোত্তর) পেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১০ই অক্টোবর তিনি প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
একটি তুলসী গাছের কাহিনি

ধনুকের মতো বাঁকা কংক্রিটের পুলটির পরেই বাড়িটা। দোতলা, উঁচু এবং প্রকাণ্ড বাড়ি। তবে রাস্তা থেকেই সরাসরি দণ্ডায়মান। এদেশে ফুটপাত নাই বলে বাড়িটারও একটু জমি ছাড়ার ভদ্রতার বালাই নাই। তবে সেটা কিন্তু বাইরের চেহারা। কারণ, পেছনে অনেক জায়গা। প্রথমত প্রশস্ত উঠোন। তারপর পায়খানা-গোসলখানার পরে আম-জাম-কাঠাল গাছে ভরা জঙ্গলের মতো জায়গা। সেখানে কড়া সূর্যালোকে ও সূর্যাস্তের ম্লান অন্ধকার এবং আগাছায় আবৃত মাটিতে ভ্যাপসা গন্ধ।

অত জায়গা যখন তখন সামনে কিছু ছেড়ে একটা বাগান করলে কী দোষ হতো? সে-কথাই এরা ভাবে। বিশেষ করে মতিন। তার বাগানের বড় শখ, যদিও আজ পর্যন্ত তা কল্পনাতেই পুষ্পিত হয়েছে। সে ভাবে, একটু জমি পেলে সে নিজেই বাগানের মতো করে নিতো। যত্ন করে লাগাতো মৌসুমি ফুল, গন্ধরাজ-বকুল-হাস্নাহেনা, দু-চারটে গোলাপও। তারপর সন্ধ্যার পর আপিস ফিরে সেখানে বসতো। একটু আরাম করে বসবার জন্যে হাল্কা বেতের চেয়ার বা ক্যানভাসের ডেকচেয়ারই কিনে নিতো । তারপর গা ঢেলে বসে গল্প-গুজব করতো। আমজাদের হুকোর অভ্যাস। বাগানের সম্মান বজায় রেখে সে না হয় একটা মানানসই নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিতো। কাদের গল্প-প্রেমিক। ফুরফুরে হাওয়ায় তার কণ্ঠ কাহিনিময় হয়ে উঠতো।

একটি তুলসী গাছের কাহিনি - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | Ekti Tulsi Gacher Kahini - Syed Waliullah
লেখকঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

কিংবা পুষ্পসৌরভে মদির জ্যোৎরাতে গল্প না করলেই বা কী এসে যেতো? এমনিতে চোখ বুজে বসেই নীরবে সান্ধ্যকালীন স্নিগ্ধতা উপভোগ করতো তারা। আপিস থেকে শ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রায় রাস্তা থেকেই চড়তে থাকা দোতলায় যাবার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মতিনের মনে জাগে এসব কথা । বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, তা নয়। দেশভঙ্গের হুজুগে এ শহরে এসে তারা যেমন-তেমন একটা ডেরার সন্ধানে উদয়াস্ত ঘুরছে, তখন একদিন দেখতে পায় বাড়িটা। সদর দরজায় মস্ত তালা, কিন্তু সামান্য পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারে বাড়িতে জনমানব নাই এবং তার মালিক দেশপলাতক। পরিত্যক্ত বাড়ি চিনতে দেরি হলো না।

কিন্তু এমন বাড়ি পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যের কথা। সৌভাগ্যের আকস্মিক আবির্ভাবে প্রথমে তাদের মনে ভয়ই উপস্থিত হয়। সে ভয় কাটতে দেরি হয় না। সেদিন সন্ধ্যায় তারা সদলবলে এসে দরজার তালা ভেঙে রই-রই আওয়াজ তুলে বাড়িটায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে তখন বৈশাখের আম-কুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনা বলে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিন-দুপুরে ডাকাতির মতো মনে হয় না। কোনো অপরাধের চেতনা যদি বা মনে জাগার প্রয়াস পায় তা বিজয়ের উল্লাসে নিমেষে তুলোধুনো হয়ে উড়ে যায়। পরদিন শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে অনাশ্রিতদের আগমন শুরু হয়। মাথার ওপর একটা ছাদ পাবার আশায় তারা দলে-দলে আসে। বিজয়ের উল্লাসটা ঢেকে এরা বলে, কী দেখছেন? জায়গা নাই কোথাও। সব ঘরেই বিছানা পড়েছে। এই যে ছোটো ঘরটি, তাতেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন তো শুধু বিছানা মাত্র। পরে দু-ফুট বাই আড়াই-ফুট চারটি চৌকি এবং দু-একটা চেয়ার-টেবিল এলে পা ফেলার জায়গা থাকবে না। একজন সমবেদনার কণ্ঠে বলে, –আপনাদের তলিফ আমরা কি বুঝি না?

একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি? তবে আপনাদের কপাল মন্দ। সেই হচ্ছে আসল কথা। যারা হতাশ হয় তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে সমবেদনা ভরা উক্তিতে। -ঐ ঘরটা? নিচের তলার রাস্তার ধারে ঘরটা অবশ্য খালিই মনে হয়। খালি দেখালেও খালি নয়। ভালো করে চেয়ে দেখুন। দেয়ালের পাশে সতরঞ্জিতে বাঁধা দুটি বেডিং। শেষ জায়গাটাও দু-ঘণ্টা হলো অ্যাকাউন্টস-এর মোটা বদরুদ্দিন নিয়ে নিয়েছে। শালার কাছ থেকে বিছানাপত্তর আনতে গেছে । শালাও আবার তার এক দোস্তের বাড়ির বারান্দায় আস্তানা গেড়েছে। পরিবার না থাকলে শালাটিও এসে হাজির হতো। নেহাত কপালের কথা। আবার একজনের কণ্ঠ সমবেদনায় খলখল করে ওঠে। যদি ঘণ্টা দুয়েক আগে আসতেন তবে।

বদরুদ্দিনকে কলা দেখাতে পারতেন। ঘরটায় তেমন আলো নেই বটে কিন্তু দেখুন জানালার পাশেই সরকারি আলো। রাতে কোনোদিন ইলেকট্রিসিটি ফেল করলে সে-আলোতেই দিব্যি চলে যাবে। বা কিঞ্জনতা যদি করতে চায় অবশ্য এ-সব পরাহত বাড়ি-সন্ধানীদের কানে বিষবৎ মনে হয়। যথাসময়ে বেআইনি বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করবার জন্যে পুলিশ আসে । সেটা স্বাভাবিক। দেশময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন বটে কিন্তু কোথাও যে রীতিমতো মগের মুলুক পড়েছে তা নয়। পুলিশ দেখে তারা ভাবে, পলাতক গৃহকর্তা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সে-কথা বিশ্বাস হয় না দু-দিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে যে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে। সন্দেহ থাকে না যে, পুলিশকে খবর দিয়েছে তারাই যারা সময় মতো এখানে না এসে শহরের অন্য কোনো প্রান্তে নিষ্ফলভাবে বাড়ি দখলের ফিকিরে ছিল। মন্দভাগ্যের কথা মানা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না। ন্যায্য অধিকারস্বত্ব এক কথা, অন্যায়ের ওপর ভাগ্য লাভ অন্য কথা।

হিংসাটা ন্যায়সঙ্গত-তো মনে হয়-ই, কর্তব্য বলেও মনে হয়। এরা রুখে দাঁড়ায়। আমরা দরিদ্র কেরানি মানুষ বটে কিন্তু সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। বাড়ি দখল করেছি বটে কিন্তু জানালা-দরজা ভাঙি নাই, ইট-পাথর খসিয়ে চোরাবাজারেও চালান করে দিই নাই আমরাও আইন-কানুন বুঝি । কে নালিশ করেছে? বাড়িওয়ালা নয়। তবে নালিশটাও যথাযথ নয়। কাদের কেবল কাতর রব তোলে! যাবো কোথায়? শখ করে কি এখানে এসে উঠেছি? সদলবলে সাব-ইন্সপেক্টর ফিরে গিয়ে না-হক না বে-হক না-ভালো না-মন্দ গোছের ঘোর-ঘোরালো রিপোর্ট দেয় যার মর্মার্থ উদ্ধারের ভয়েই হয়ত ওপরওয়ালা তা ফাইল চাপা দেয়া শ্রেয় মনে করে। অথবা বুঝতে পারে, এই হুজুগের সময়। অন্যায়ভাবে বাড়ি দখলের বিষয়ে সরকারি আইনটা যেন তেমন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। কাদের চোখ টিপে বলে, সত্য কথা বলতে দোষ কী? সাব-ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় বউ আমার এক রকম আত্মীয়া। বলো না কাউকে কিন্তু।

কথাটা অবশ্য কারোরই বিশ্বাস হয় না। তবে অসত্যটির গোড়ায় যে কেবল একটা নির্মল আনন্দের উস্কানি, তা বুঝে কাদেরকে ক্ষমা করতে দ্বিধা হয় না। উৎফুল্ল কণ্ঠে কেউ প্রস্তাব করে, কী হে, চা-মিষ্টিটা হয়ে যাক।। রাতারাতি সরগরম হয়ে ওঠে প্রকাণ্ড বাড়িটা। আস্তানা একটি পেয়েছে এবং সে আস্তানাটি কেউ হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। শুধু এ বিশ্বাসই তার কারণ নয়। খোলামেলা ঝরঝরে তকতকে এ বাড়ি তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবন-সঞ্চার করেছে যেন। এদের অনেকেই কলকাতায় ব্লকম্যান লেন-এ খালাসি পট্টিতে, বৈঠকখানায়। দফতরিদের পাড়ায়, সৈয়দ সালেহ লেন-এ তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বা কমরু খানসামা লেন-এ অকথ্য দুর্গন্ধ নোংরার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।

তুলনায় এ বাড়ির বড় বড় কামরা, নীলকুঠি দালানের ফ্যাশানে মস্ত মস্ত জানালা, খোলামেলা উঠোন, আরও পেছনে বনজঙ্গলের মতো আম-জাম-কাঁঠালের বাগান—এসব একটি ভিন্ন দুনিয়া যেন। এরা লাটবেলাটের মতো একখানা ঘর দখল করে নাই সত্য, তবু এত আলো-বাতাস কখনো তারা উপভোগ করে নাই। তাদের জীবনে সবুজ তৃণ গজাবে ধমনীতে সৰল সতেজ রক্ত আসবে, হাজার-দুহাজারওয়ালাদের মতো মুখে ধন-স্বাস্থ্যের জৌলুস আসবে, দেহও ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর-ক্ষয় ব্যাধিমুক্ত হবে। রোগাপটুকা ইউনুস ইতোমধ্যে তার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখতে পায়। সে থাকতো ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। গলিটা যেন সকাল বেলার আবর্জনা-ভরা ডাস্টবিন। সে গলিতেই নড়বড়ে ধরনের একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে সঁাসেঁতে একটি কামরায় কচ্ছদেশীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চার বছর সে বাস করেছে।

পাড়াটি চামড়ার উল্কট গন্ধে সর্বক্ষণ এমন ভরপুর হয়ে থাকতো যে রাস্তার ড্রেনের পচা দুর্গন্ধ নাকে পৌছতো না, ঘরের কোণে ইদুর-বেড়াল মরে পচে থাকলেও তার খবর পাওয়া দুষ্কর ছিল। ইউনুসের জ্বরজারি লেগেই থাকতো, থেকে থেকে শেষ রাতে কাশির ধমক উঠতো। তবু পাড়াটি ছাড়ে নি এক কারণে। কে তাকে বলেছিল, চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গন্ধটা তাই সে। অম্লানবদনে সহ্য তো করতেই, সময় সময় আপিস থেকে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির নিচ্ছিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতো। তাতে অবশ্য তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখা যায় নাই। খানাদানা না হলে বাড়ি সরগরম হয় না। তাই এক সপ্তাহ ধরে মোগলাই কায়দায় তারা খানাদানা করে। রান্নার ব্যাপারে সকলেরই গুপ্ত কেরামতি প্রকাশ পায় সহসা।

নানির হাতে শেখা বিশেষ পিঠা তৈরির কৌশলটি শেষ পর্যন্ত অখাদ্য বস্তুতে পরিণত হলেও তারিফ প্রশংসায় তা মুখরোচক হয়ে ওঠে। গানের আসরও বসে কোনো কোনো সন্ধ্যায়। হাবিবুল্লা কোত্থেকে একটা বেসুরো হারমনিয়াম নিয়ে এসে তার সাহায্যে নিজের গলার বলিষ্ঠতার ওপর ভর করে নিশীথ রাত পর্যন্ত একটি অবক্তব্য সংগীতসমস্যা সৃষ্টি করে। এ সময়ে একদিন উঠানের প্রান্তে রান্নাঘরের পেছনে চৌকোনা আধ হাত উঁচু ইটের তৈরি একটি মঞ্চের ওপর তুলসী গাছটি তাদের দৃষ্টিগত হয়। সেদিন রোববার সকাল। নিমের ডাল দিয়ে মেছোয়াক করতে করতে মোদাব্বের উঠোনে পায়চারি করছিল, হঠাৎ সে তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। লোকটি এমনিতেই হুজুগে মানুষ। সামান্য কথাতেই প্রাণ-শীতল-করা রই-রই আওয়াজ তোলার অভ্যাস তার।

তবু সে আওয়াজ উপেক্ষা করা সহজ নয়। শীঘ্রই কেউ কেউ ছুটে আসে উঠানে।
—কী ব্যাপার?
—চোখ খুলে দেখ!
-কী? কী দেখবো? সাপখোপ দেখবে আশা করেছিল বলে প্রথমে তুলসী গাছটা নজরে পড়ে না তাদের। দেখছো না? এমন বেকায়দা আসনাধীন তুলসী গাছটা দেখতে পাচ্ছো না? উপড়ে ফেলতে হবে ওটা। আমরা যখন এ বাড়িতে এসে উঠেছি তখন এখানে কোনো হিন্দুয়ানির চিহ্ন আর সহ্য করা হবে না। একটু হতাশ হয়ে তারা তুলসী গাছটির দিকে তাকায়। গাছটি কেমন যেন মরে আছে । গাঢ় সবুজ রঙের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে। নিচে আগাছাও গজিয়েছে । হয়ত বহুদিন তাতে পানি পড়েনি। -কী দেখছো? মোদাব্বের হুংকার দিয়ে ওঠে। বলছি না, উপড়ে ফেল!

এরা কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। আকস্মিক এ আবিষ্কারে তারা যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। যে বাড়ি এত শূন্য মনে হয়েছিল, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা ক-টা নাম থাকা সত্ত্বেও যে বাড়িটা এমন বেওয়ারিশ ঠেকেছিল, সে বাড়ির চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে শুষ্কপ্রায় মৃতপ্রায়। নগণ্য তুলসী গাছটি হঠাৎ সে বাড়ির অন্দরের কথা প্রকাশ করেছে যেন। এদের অহেতুক স্তব্ধতা লক্ষ করে মোদাব্বের আবার হুংকার ছাড়ে।

—ভাবছো কী অত? উপড়ে ফেলো বলছি! কেউ নড়ে না। হিন্দু রীতিনীতি এদের তেমন ভালো করে জানা নেই। তবুও কোথাও শুনেছে যে, হিন্দুবাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকত্রী তুলসী গাছের তলে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। আজ যে তুলসী গাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে পরিত্যক্ত তুলসী গাছের তলেও প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিতো।

আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব। রক্তাক্ত স্পর্শে একটা শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠতো প্রতিদিন। ঘরে দুর্দিনের ঝড় এসেছে, হয়ত কারো জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে, আবার হাসি-আনন্দের ফোয়ারাও ছুটেছে সুখ-সময়ে, কিন্তু এ প্রদীপ দেওয়া অনুষ্ঠান একদিনের জন্যও বন্ধ থাকে নাই। যে-গৃহকর্তী বছরের পর বছর এ তুলসী গাছের তলে প্রদীপ দিয়েছে সে আজ কোথায়? মতিন এক সময়ে রেলওয়েতে কাজ করতো। অকারণে তার চোখের সামনে বিভিন্ন রেলওয়ে-পট্টির ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, হয়ত আসানসোল, বৈদ্যবাটি, লিলুয়া বা হাওড়ায় রেলওয়ে-পট্টিতে সে মহিলা কোনো আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।

বিশাল ইয়ার্ডের পাশে রোদে শুকোতে-থাকা লাল পাড়ের একটি মসৃণ কালো শাড়ি সে যেন দেখতে পায়। হয়ত সে শাড়িটি গৃহকত্রীরই । কেমন বিষন্নভাবে সে শাড়িটি দোলে স্বল্প হাওয়ায়। অথবা মহিলাটি কোনো চলতি ট্রেনের জানালার পাশে যেন বসে। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে দৃষ্টি খোজে কিছু দূরে, দিগন্তের ওপারে । হয়ত তার যাত্রা এখনো শেষ হয় নাই। কিন্তু যেখানেই সে থাকুক এবং তার যাত্রা এখনো শেষ হয়েছে কি হয় নাই, আকাশে যখন দিনান্তের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে তখন প্রতিদিন এ তুলসীতলার কথা মনে হয় বলে তার চোখ হয়ত ছলছল করে ওঠে। গতকাল থেকে ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাব। সে বলে, –থাক না ওটা। আমরা তো তা পুজো করতে যাচ্ছি না। বরঞ্চ ঘরে তুলসী গাছ থাকা ভালো। সর্দি-কফে তার পাতার রস বড়ই উপকারী। মোদাব্বের অন্যদের দিকে তাকায়।

মনে হয়, সবারই যেন তাই মত। গাছটি উপড়ানোর জন্যে কারো হাত এগিয়ে আসে না। ওদের মধ্যে এনায়েত একটু মৌলভি ধরনের মানুষ। মুখে দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও আছে, সকালে নিয়মিতভাবে কোরান-তেলাওয়াত করে। সে পর্যন্ত চুপ। প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকত্রীর সজল চোখের দৃশ্যটি তার মনেও জাগে কি? অক্ষত দেহে তুলসী গাছটি বিরাজ করতে থাকে। তবে এদের হাত থেকে রেহাই পেলেও এরা যে তার সম্বন্ধে পর মুহূর্তেই অসচেতনতায় নিমজ্জিত হয় তা নয়। বরঞ্চ কেমন একটা দুর্বলতার ভাব, কর্তব্যের সম্মুখে পিছ-পা হলে যেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা আসে তেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা তাদের মনে জেগে থাকে। তারই ফলে সেদিন সান্ধ্য আড়ড়ায় তুর্ক ওঠে। তারা বাকবিতণ্ডার স্রোতে মনের সে দুর্বলতা অস্বচ্ছলতা ভাসিয়ে দিতে চায় যেন।

আজ অন্যান্য দিনের মতো রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার বদলে সাম্প্রদায়িকতাই তাদের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।

-ওরাই তো সবকিছুর মূলে, মোদাব্বের বলে । উলঙ্গ বালবৃ-এর আলোয় তার সযত্নে মেছোয়াক করা দাঁত  ঝকঝক করে। তাদের নীচতা হীনতা গোড়ামির জন্যেই তো দেশটা ভাগ হলো। কথাটা নতুন নয়। তবু আজ সে উক্তিতে নতুন একটা ঝাঁঝ । তার সমর্থনে এবার হিন্দুদের অবিচার-অত্যাচারের অশেষ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস সংকীর্ণ হয়ে আসে।

দলের মধ্যে বামপন্থী বলে স্বীকৃত মকসুদ প্রতিবাদ করে। বলে, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কী? মোদাব্বেরের ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বাড়াবাড়ি মানে? বামপন্থি মকসুদ আজ একা। তাই হয়ত তার বিশ্বাসের কাটা নড়ে। সংশয়ে দুলে দুলে কাটাটি ডান দিকে হেলে থেমে যায়।

রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তুলসী গাছটা মোদাব্বেরের নজরে পড়ে। সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না। তার তলে যে আগাছা জন্মেছিল সে আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে গাঢ় সবুজ পাতাগুলি পানির অভাবে শুকিয়ে খয়েরি রং ধরেছিল, সে পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ থাকে না যে তুলসী গাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ।

খোলাখুলিভাবে না হলেও লুকিয়ে লুকিয়ে তার গোড়ায় কেউ পানি দিচ্ছে। মোদাব্বেরের হাতে তখন একটি কঞ্চি। সেটি সাঁ করে কচুকাটার কায়দায় সে তুলসী গাছের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওপর দিয়েই । তুলসী গাছটি অক্ষত দেহেই থাকে। অবশ্য তুলসী গাছের কথা কেউ উল্লেখ করে না। ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাবটা পরদিন কেটে গিয়েছিল । তুলসী পাতার রসের প্রয়োজন হয় নাই তার। তারা ভেবেছিল ম্যাকলিওড স্ট্রিট খানসামা লেন ব্লকম্যানের জীবন সত্যিই পেছনে ফেলে এসে প্রচুর আলো-হাওয়ার মধ্যে নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু তাদের ভুলটা ভাঙতে দেরি হয় না। তবে শুধু ততখানিই দেরি দরকার, সে বিশ্বাস দৃঢ় প্রমাণিত হবার জন্যে। ফলে আচম্বিত আঘাতটা প্রথমে নিদারুণই মনে হয়।

সেদিন তারা আপিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে সকালের পরিকল্পনা মোতাবেক খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করেছে, এমন সময় বাইরে সিঁড়িতে ভারি জুতার মচমচ আওয়াজ শোনা যায়। বাইরে একবার উঁকি দিয়ে মোদাব্বের ক্ষিপ্রপদে ভেতরে আসে। পুলিশ এসেছে আবার। সে ফিসফিস করে বলে । পুলিশ? আবার কেন পুলিশ? ইউনুস ভাবে, হয়ত রাস্তা থেকে ছ্যাচড়া চোর পালিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকেছে এবং তারই সন্ধানে পুলিশের আগমন হয়েছে । কথাটা মনে হতেই নিজের কাছেই তা খরগোশের গল্পের মতো ঠেকে। শিকারির সামনে আর পালাবার পথ না পেয়ে হঠাৎ চোখ বুজে বসে পড়ে খরগোশ ভাবে, কেউ তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। আসলে তারাই কি চোর নয়?

সব জেনেও তারাই কি সত্য কথাটা স্বীকার না করে এ বাড়িতে একটি অবিশ্বাস্য মনোরম জীবন সৃষ্টি করেছে নিজেদের জন্য? পুলিশ দলের নেতা সাবেকি আমলের মানুষ । হ্যাট বগলে চেপে তখন সে দাগ-পড়া কপাল থেকে ঘাম মুছছে। কেমন একটা নিরীহ ভাব। তার পশ্চাতে বন্দুকধারী কনস্টেবল দুটিকেও মস্ত গোঁফ থাকা সত্ত্বেও নিরীহ মনে হয়। তাদের দৃষ্টি ওপরের দিকে। তারা যেন কড়িকাঠ গোনে। ওপরের ঝিলিমিলির খোপে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। হয়ত তারা কবুতর দুটিকেই দেখে চেয়ে। হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে। সবিনয়ে মতিন প্রশ্ন করে, কাকে দরকার? —আপনাদের সবাইকে। পুলিশদের নেতা একটু খনখনে গলায় ঝট করে উত্তর দেয়। আপনারা বেআইনিভাবে এ বাড়িটা কজা করেছেন। কথাটা না মেনে উপায় নাই।

ওরা প্রতিবাদ না করে সরল চোখে সামান্য কৌতূহল জাগিয়ে পুলিশদের নেতার দিকে চেয়ে থাকে।
—চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। সরকারের হুকুম । এরা নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অবশেষে মোদাব্বের গলা সাফ করে প্রশ্ন করে, কেন, বাড়িওয়ালা নালিশ করেছে নাকি?

আ্যাকউন্টস আপিসের মোটা বদরুদ্দিন গলা বাড়িয়ে কনস্টেবল দুটির পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালার সন্ধানে। সেখানে কেউ নেই। তবে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা।
—কোথায় বাড়িওয়ালা? না হেসেই গলায় হাসি তোলে পুলিশ দলের নেতা। এদের একজনও হেসে ওঠে। একটা আশার সঞ্চার হয় যেন।
—তবে?
—গভর্নমেন্ট বাড়িটা রিকুইজিশন করেছে। এবার হাসি জাগে না। বস্তুত অনেকক্ষণ যেন কারো মুখে কোনো কথা সরে না। তারপর মকসুদ গলা বাড়ায়। আমরা কি গভর্নমেন্টের লোক নই? এবার কনস্টেবল দুটির দৃষ্টিও কবুতর কড়িকাঠ ছেড়ে মকসুদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়। তাদের দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময়ের ভাব। মানুষের নির্বুদ্ধিতায় এখনো তারা চমকিত হয়।

তারপর প্রকাণ্ড সে বাড়িতে অপর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকলেও একটা গভীর ছায়া নেমে আসে। প্রথমে অবশ্য তাদের মাথায় খুন চড়ে। নানারকম বিদ্রোহী ঘোষণা শোনা যায়। তারা যাবে না কোথাও, ঘরের খুঁটি ধরে পড়ে থাকবে; যাবে তো লাশ হয়ে যাবে। তবে মাথা শীতল হতে দেরি হয় না। তখন গভীর ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। কোথায় যাবে তারা? পরদিন মোদাব্বের যখন এসে বলে তাদের মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা থেকে সাতদিন হয়েছে তখন তারা একটা গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেও সে-ঘন ছায়াটা নিবিড় হয়েই থাকে। এবার কাদের পুলিশ সাব ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কথা বলে না। তবু না বলা কথাটা সবাই মেনে নেয়। তারপর দশম দিনে তারা সদলবলে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়।

যেমনি ঝড়ের মতো এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মতোই উধাও হয়ে যায়। শুন্য বাড়িতে তাদের সাময়িক বসবাসের চিহ্নস্বরূপ এখানে-সেখানে ছিটিয়ে থাকে খবরে কাগজের ছেঁড়া পাতা, কাপড় ঝোলাবার একটা পুরোনো দড়ি, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, একটা ঘেঁড়া জুতোর গোড়ালি। উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারও মনে পড়েনি। কেন পড়েনি সে কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।


শব্দার্থ ও টীকাঃ
কংক্রিটের পুল - চুন-বালি-সিমেন্ট ও চুনাপাথরের মিশ্রণে তৈরি পাকা সেতু।
ক্যানভাস - মজবুত মোটা কাপড় বিশেষ।
ডেক চেয়ার - ঘরের বাইরে ব্যবহারের জন্য কাঠ বা ধাতুর কাঠামোর ওপর ক্যানভাস দিয়ে তৈরি সংকোচনযোগ্য আসন।
গুড়গুড়ি - আলবোলা। ফরসি। নলযুক্ত হুঁকো।
মদির - মত্ততা জাগায় বা সৃষ্টি করে এমন।
দেশভঙ্গের হুজুগে - ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আবেগবশত।
ডেরা - অস্থায়ী বাসস্থান। আস্তানা।
পরাহত - ব্যাহত। বাধাগ্রস্ত। পরাজিত।
ফিকির - ফন্দি। মতলব। উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়।
না হক - ন্যায়সঙ্গত নয় এমন।
না বেহক - অন্যায় নয় এমন।
ঘোর-ঘোরালো - খুবই জটিল। অত্যন্ত প্যাঁচালো।
লাটবেলাট - গভর্নর বা অনুরূপ সম্রান্ত ব্যক্তিবর্গ।
কচ্ছদেশীয় - গুজরাটের উত্তরে অবস্থিত সমুদ্রতীরবর্তী স্থান।
ইয়ার্ড - স্টেশনসংলগ্ন চত্বর।
সাম্প্রদায়িকতা - সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতা ও ক্রিয়াকলাপ।
বামপন্থি - সাম্যবাদী। প্রগতিবাদী। বিপ্লবী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী।
রিকুইজিশন - কোনো কিছু চেয়ে লিখিত ফরমাশ। তলব করা। Requisition.
কড়িকাঠ - ছাদের তলায় দেওয়া আড়াআড়ি লম্বা কাঠ।
ভদ্রতার বালাই - সাধারণ সৌজন্যবোধ।
পৃষ্ঠপ্রদর্শন - পালানো।
দিনে দুপুরে ডাকাতি - প্রকাশ্য প্রতারণা ও মিথ্যাচার। ডাকাতির মতো দুঃসাহসিক কাজ।
তুলোধুনো হওয়া - ধুনা তুলোর মতো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া।
কলা দেখানো - আলংকারিক অর্থে ফাঁকি দেওয়া।
মগের মুল্লুক - আলংকারিক অর্থে অরাজক দেশ বা রাজ্য।

পাঠ-পরিচিতিঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “একটি তুলসী গাছের কাহিনি" গল্পটি ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে সংকলিত। গল্পের সীমিত পরিসরে জীবনের গভীর কোনো তাৎপর্যকে ইঙ্গিতময় ও ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মুন্সিয়ানা রয়েছে। একটি তুলসী গাছের কাহিনিতেও এ গুণটি লক্ষ করা যায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই ঢাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে কলকাতা থেকে আগত কয়েকজন উদ্বাস্তু কর্মচারী। কলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায় কোনোরকমে মাথা গুঁজে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও নিরাশ্রিত উদ্বাস্তু জীবনের যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা এতদিন তাদের গ্রাস করেছিল কলকাতার তুলনায় অনেক অনেক খোলামেলা বাড়ি পেয়ে তারা কেবল যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তা নয়, বরং বাড়িটিকে তাদের কাছে মনে হলো বেহেশৃত।

অচিরেই বাড়ির উঠানে আগাছার মধ্যে তারা আবিষ্কার করল একটি তুলসী গাছ। সবাই প্রথমে গাছটাকে উপড়ে ফেলার জন্য হইচই করলেও সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা দ্বিধাও জাগে এবং শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায় তুলসী গাছটা। দেখা গেল সকলের অজান্তে কেউ একজন গাছটার পরিচর্যা করতে শুরু করেছে। তারপর একদিন সরকারি নির্দেশে বেআইনি দখল থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হলো। শূন্য বাড়িটাতে রইল কেবল ছড়ানো পরিত্যক্ত আবর্জনা আর সেই তুলসী গাছটা। যত্নের অভাবে তুলসী গাছটা অচিরেই আবার শুষ্কপ্রায় হয়ে উঠল । যে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষের শান্ত জীবন তুলসী গাছটাও যে তারই শিকার অসহায় গাছটা তা জানবে কী করে।
Share:

0 Comments:

Post a Comment

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি

HSC Exam Routine

এইচএসসি পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির গাইডসমূহ
(সকল বিভাগ)
বাংলা ১ম পত্র ১ম পত্র গাইড | বাংলা ২য় পত্র গাইড | লালসালু উপন্যাস গাইড | সিরাজুদ্দৌলা নাটক গাইড | ইংরেজি ১ম পত্র গাইড | ইংরেজি ২য় পত্র গাইড | আইসিটি গাইড | হিসাব বিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | হিসাব বিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | জীববিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | জীববিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র গাইড | ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র গাইড | রসায়ন ১ম পত্র গাইড | রসায়ন ২য় পত্র গাইড | পৌরনীতি ১ম পত্র গাইড | পৌরনীতি ২য় পত্র গাইড | অর্থনীতি ১ম পত্র গাইড | অর্থনীতি ২য় পত্র গাইড | ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা ১ম পত্র গাইড | ফিন্যান্স ব্যাংকিং ও বীম ২য় পত্র গাইড | ভুগোল ১ম পত্র গাইড | ভুগোল ২য় পত্র গাইড | উচ্চতর গণিত ১ম পত্র গাইড | উচ্চতর গণিত ২য় পত্র গাইড | ইতিহাস ১ম পত্র গাইড | ইতিহাস ২য় পত্র গাইড | ইসলামের ইতিহাস ১ম পত্র গাইড | ইসলামের ইতিহাস ২য় পত্র গাইড | কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র গাইড | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র গাইড | যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র গাইড | যুক্তিবিদ্যা ২য় পত্র গাইড | মনোবিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | মনোবিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | পদার্থ বিজ্ঞান ১ম পত্র গাইড | পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র গাইড | উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ ১ম পত্র গাইড | উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ ২য় পত্র গাইড | সমাজকর্ম ১ম পত্র গাইড | সমাজকর্ম ২য় পত্র গাইড | সমাজবিদ্য ১ম পত্র গাইড | সমাজবিদ্যা ২য় পত্র গাইড | পরিসংখ্যান ১ম পত্র গাইড | পরিসংখ্যান ২য় পত্র গাইড | ইংরেজি শব্দার্থ VOCABULARY

Admission Guide