বাংলা গল্প 'ভুলের মূল্য' -কাজী মোতাহার হোসেন

[লেখক-পরিচিতিঃ কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০এ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার লক্ষ্মীপুরে। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কাজী গওহর উদ্দীন আহমদ, মায়ের নাম তসিরুন্নেসা। পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র মোতাহার হোসেন কর্মজীবনে অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত হওয়া প্রথম তিনজনের অন্যতম ছিলেন তিনি। বিশ ও ত্রিশের দশকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে পরিচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক এবং ওই আন্দোলনের মুখপত্র বিখ্যাত ‘শিখা পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। মননশীল লেখক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। তিনি বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি নিয়ে অনেক তথ্যসমৃদ্ধ মননশীল প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- প্রবন্ধ সংকলন: “সঞ্চয়ন ও ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ'; সমালোচনাগ্রন্থ : 'নজরুল কাব্য পরিচিতি'; পাঠ্য বিজ্ঞানগ্রন্থ: ‘গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস', 'আলোক বিজ্ঞান ইত্যাদি। যুক্তিশীলতা ও স্বচ্ছতা কাজী মোতাহার হোসেনের গদ্যরচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
ভুলের মূল্য

চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকলাপে ভুল করা মানুষের পক্ষে শুধু স্বাভাবিক তাই নয়, অপরিহার্যও বটে। স্বাভাবিক এইজন্য যে মানুষ বড় দুর্বল, সর্বদা নানা ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে পারে না। অপরিহার্য এইজন্য যে তার জ্ঞান অতি সংকীর্ণ, কোনটি ভুল, কোনটি নির্ভুল তা নির্ধারণ করাই অনেক সময় কঠিন, এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এখানে কেবল যে দুর্বলচেতা ও স্বল্পজ্ঞান মানুষের কথা বলছি তা নয়। এ মন্তব্য সবল-দুর্বল এবং অজ্ঞ-বিজ্ঞ-নির্বিশেষে সকলের পক্ষেই খাটে। প্রতারক, দস্যু, মাতাল, ঘোড়দৌড়ের খেলোয়াড় প্রত্যেকেই জানে যে তার কাজ ঠিক হচ্ছে না-সে ভুল পথে চলেছে। কিন্তু সে পথ হতে ফিরবার ক্ষমতা তার কোথায়? তার বিবেক হয়ত দংশন করছে, কিন্তু প্রবৃত্তি বশ মানছে না। এইরূপে ক্রমে ক্রমে বিবেক-বুদ্ধিই শিথিল অথবা শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

অন্য কথায়, সে নিজের কাজের সমর্থক যুক্তি বের করে বিবেকের উগ্রতাকে প্রশমিত করে নিচ্ছে। প্রবৃত্তির হাতে বিবেকের এই নিগ্রহই মানুষের দুর্বলতার প্রধান পরিচয়। তাছাড়া মানুষ এমন সব ঘটনার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যায় যে, তাকে বাধ্য হয়ে খেলার পুতুলের মতো নিরুপায়ভাবে একটার পর আর একটা ভুল করে যেতে হয়, একটা ভুল ঢাকতে গিয়ে আরও দশটার আশ্রয় নিতে হয়। মানুষ বড় জটিল জীব। তাকে দশ দিক বজায় রেখে কাজ করতে হয়।

আবার পৃথিবীও এমন কঠিন ঠাই যে, অনেক সময় এক কুল বজায় রাখতে গেলে আর-এক কুলে ভাঙন লাগে। জীবনে এইগুলোই সবচেয়ে বড় সমস্যা, এইখানেই ভুল হয় বেশি। আবার এখানেই মানুষের বিশেষত্বও ফুটে ওঠে অপূর্বভাবে। এইরূপ নানা বিচিত্র ঘটনাবর্তের ভেতর দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা দিতে দিতে যেতে হয় বলেই তার শ্রেষ্ঠত্ব, আর এই আত্ম-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলবার মধ্যেই তার সৌন্দর্যের বিকাশ এবং যোগ্যতার পরিচয়। পর্বেই বলেছি মানুষের জ্ঞান অতি সংকীর্ণ।
ভুলের মূল্য - কাজী মোতাহার হোসেন
লেখকঃ কাজী মোতাহার হোসেন
ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন জ্ঞানভাপর খুলে যাচ্ছে আর পরনো জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, কাব্য, দর্শন, রাজনীতি, ধর্মনীতি, ব্যবহারিক জ্ঞান, কলা-বিদ্যা প্রভৃতি সমুদয় ক্ষেত্রেই এর এত অধিক দৃষ্টান্ত বর্তমান যে, তার উদাহরণ দেওয়া বাহুল্য মাত্র। এর থেকে বোঝা যায়, আজ যেটি সত্য এবং নির্ভুল মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটি হয়ত মিথ্যা অথবা আংশিক সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে।

এজন্য আমরা আজকাল যে আদর্শ ধরে চলছি, তা নিয়ে অতিরিক্ত উল্লাসের সাথে আস্ফালন করতে পারিনে—যেহেতু, আমাদের আজকার উদ্ধত অহংকার কালকার দীন লজ্জায় পরিণত হতে পারে। মানুষের প্রকৃত যে জ্ঞান, তা ইন্দ্রিয়ের দ্বার দিয়ে অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই আসে। শিশুকে আগুনের শিখা, ছুরির ধার, মরিচের ঝাল, এসব থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। যদি তা পারা যেত, তবে বোধ হয়, সে চিরকাল শিশুই থাকত।

শিশুর পক্ষে যা, পরিণত মানুষের পক্ষেও কতকটা তাই সত্য। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের যেখানে অভাব, সেখানে সমস্ত জ্ঞানই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যে কোনো দিন পথ ভোলার কষ্ট ভোগ করে নাই, সে কখনো ঠিক পথে চলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না; যে কোনো দিন পানিতে পড়ে হাবুডুবু না খেয়েছে, সে কখনো নিরাপদে নৌকায় চড়ার সুখ ভালো করে বুঝতে পারে না।। মানুষ ভুল করে, পরে সেই ভুল সংশোধন করেই সত্যের সন্ধান পায়। সাধারণের ধারণা, ঠেকে শেখার চেয়ে দেখে শেখাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি বলেও একটা কথা আছে। নিরুদ্বেগ আপদহীনতার ভেতরেই অনেক সময়ে বিপদের বীজ প্রচ্ছন্ন থাকে। আসল কথা, জীবনের অভিজ্ঞতা ও গভীর অনুভূতিলব্ধ যে জ্ঞান ও শিক্ষা, বাস্তবিকই তার তুলনা নাই।

স্বল্প পরিসর টবের ভেতরে জীবন ধারণ করার চেয়ে, বাইরের বিস্তৃতির ভেতরে আনন্দে বিকশিত হওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। তবে অন্যের দুর্দশা দেখেও অবশ্য শিক্ষা লাভ করতে হবে। কারণ একজনের পক্ষে সকল রকম অভিজ্ঞতা লাভ করা অসম্ভব। আমাদের এই বর্তমান কোটি কোটি অভিজ্ঞতারই ফল, সুতরাং জীবন-যাত্রায় অন্যের অভিজ্ঞতারও যে প্রয়োজন আছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। অন্যের নিকট থেকে পাওয়া অসম্পূর্ণ বা অপরীক্ষিত জ্ঞানকে নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচাই করে নিজস্ব করে নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিপুষ্ট জীবনের এই-ই ধারা।। মানুষ এইরকম ভুলের ওপর চরণ ফেলে ফেলে সত্যকে খুঁজে পাচ্ছে এবং এভাবেই ক্রমশ অগ্রসর হয়ে চলেছে। ভুল না করলে যেন সত্যের প্রকৃত রূপটি ধরা পড়ে না, এ যেন আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলা।

যেমন একটা ফুলকে নানাভাবে চারদিক থেকে দেখলে তার নতুন নতুন সৌন্দর্য চোখে পড়ে, এরূপ সত্যুকেও নানা ঘটনার ভেতরে দিয়ে নানাভাবে পরখ করে দেখতে হয়; তবেই তার সমগ্র রূপ ধরা পড়ে। কোনো বৃহৎ সত্যই এ পর্যন্ত সমগ্রভাবে আমাদের কাছে ধরা পড়েছে কিনা সন্দেহ। তবে যে-সত্যের যত বেশি ব্যতিক্রম আমাদের চোখে পড়েছে, তা আমরা ততই ভালো করে বুঝতে পেরেছি। দুঃখ যত প্রবলভাবে মানুষের মনে আঘাত করে, সুখ ততটা করে না। সুখকে কোনো কোনো লোকে যত নিহভাবে গ্রহণ করতে পারে, চেষ্টা করলেও দুঃখকে তত সহজে মনের গোপনে লুকিয়ে রাখতে পারে না। এজন্য জীবনে দুঃখের মূল্য বড় বেশি।

আগে দুঃখ পেতে হবে, তবেই সমস্ত অনুভূতি সজাগ ও তীক্ষ হবে। ভুল। করে যে দুঃখ পায়, তাহার ভুল করা সার্থক। আর ভুল করলেও যে নির্বিকার, আত্ম-বিচার যার নাই- তার কাছে সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুণ্য, অর্থশূন্য শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যক্তিগত জীবনে ভুলের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানে যে, ভুল মানুষকে দুঃখ ও অনুশোচনার আগুনে পুড়িয়ে তাকে বিশুদ্ধ করে তোলে এবং মনুষ্যত্ব-সাধনের দিকে অনেক দূর অগ্রসর করে দেয়। ভুল সম্বন্ধে আর-একটা বড় কথা, এই যে ভুল না করলে বুঝি-বা লোকে প্রেমময় হতে পারে না। তার কারণ, প্রেমের মূল উৎস হচ্ছে সহানুভূতি।

নিজের ভুল করে যার অহংকার চূর্ণ হয়নি, সে মুখে যতই বলুক না কেন তার ব্যবহারের মধ্যে প্রায়ই প্রচ্ছন্নভাবে একটা আত্মম্ভরিতা এবং অন্যের প্রতি উপেক্ষা বা কৃপার ভাব থেকে যায়। আমার মনে হয়, এজন্য গোঁড়া নীতিবাগীশের দল অন্যের প্রতি অতি কঠোর বিচারের প্রয়োগ করেন এবং এ কারণেই তারা রীতিমতো সামাজিক হতে পারেন না। কিন্তু যখন বিচারের সেই নিষ্ঠুর মাপকাঠি দিয়ে নিজের (বা প্রিয়াস্পদের) জীবন যাচাই করে দেখবার সময় আসে, তখনই প্রথম চোখে পড়ে, ভুল করা কত স্বাভাবিক, কত অবশ্যম্ভাবী। তখন তার দৃষ্টি বদলে যায়, করুণায় প্রাণ-মন ভরে ওঠে; তখন তার কল্পনার মোহ ভেঙে যায়। তখনই সে প্রথম বুঝতে পারে, সে রক্তমাংসের মানুষ।

আত্মকৃত ভুল মানুষকে ঘৃণা থেকে নিবৃত্ত করে, প্রেমময় হতে শেখায়, সকল মানুষের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা বোধ জন্মায়। একথা শুনতে অদ্ভুত লাগে বটে, কিন্তু এ সত্য। ভুলের মতো একটা সাধারণ ব্যাপার, যা অহরহ ঘটছে, তাই আবার মানুষের এতখানি কাজে লাগে, এটি বিশ্বের পক্ষে সামান্য সৌভাগ্যের বিষয় নয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্যোদঘাটনের প্রচেষ্টার চেয়েও বোধ হয় ভুলের এই কার্যকারিতা বেশি কল্যাণপ্রসূ হয়েছে। 

বাস্তবিক, ভুল আছে বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর। ভুল না থাকলে পৃথিবীর দয়া, মায়া, ক্ষমা, ভালোবাসা প্রভৃতি ও কোমল গুণগুলির এত অবকাশ ও বিকাশ হতো কিনা সন্দেহ। তাছাড়া ভুল না থাকলে এত দিন মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা এবং অগ্রগতি কবে রুদ্ধ হয়ে সমস্ত অসাড় নিস্পন্দ হয়ে যেত। এখানেই ভুলের মূল্য।


শব্দার্থ ও টীকাঃ
পারিপার্শ্বিক - চতুর্দিকস্থ। পার্শ্ববর্তী।
দুর্বলচেতা - দুর্বল চিত্ত এমন।
অজ্ঞ-বিজ্ঞ-নির্বিশেষে - মূর্খ-জ্ঞানী সকলেই।
বিবেক  - মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি; যার দ্বারা ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, ধর্মাধর্ম বিচার করা যায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ।
উগ্রতাকে প্রশমিত - রূঢ়তা বা তীব্রতাকে শান্ত বা নিবারণ করা।
প্রবৃত্তি  - স্পৃহা। আকাক্সক্ষা। ইচ্ছা।
ঘূর্ণিপাক  - বায়ু বা পানির প্রচ’ আবর্ত।
ঘটনাবর্ত - ঘটনার আবর্ত। ঘটনাবলি।
‘অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি' - একটি প্রবাদ বাক্য। অতি চালাকের মন্দ পরিণতি বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়।
পরিপুষ্ট - অতিশয় পুষ্ট। সুপুষ্ট।
নিস্পৃহভাবে - স্পৃহাহীনভাবে। কামনা-বাসনাহীনভাবে।
আত্মম্ভরিতা - অহংকার। দম্ভ।
গোড়া  - ধর্মমতে অন্ধবিশ্বাসী ও একগুঁয়ে। অন্ধভক্ত।
নীতিবাগীশ - নীতি-নিষ্ঠা সম্পর্কে দাম্ভিক।
প্রিয়াস্পদ - প্রিয়ভাজন। প্রিয়পাত্র।
আত্মকৃত - নিজে সম্পাদিত। নিজের করা যা।
নিবৃত্ত - বিরত। ক্ষান্ত।
সত্যোঘাটন - সত্য + উদ্ঘাটন = সত্যোঘাটন। প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করা।
কল্যাণপ্রসূ - কল্যাণ বা শুভকর এমন।

পাঠ-পরিচিতিঃ কাজী মোতাহার হোসেন রচিত 'ভুলের মূল্য' প্রবন্ধটি তাঁর রচনাবলির ১ম খণ্ড (১৯৮৪) থেকে সংকলিত। এই প্রবন্ধে লেখক মানবজীবনে ভুলের গুরুত্ব বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। মানবজাতির চিরন্তন আকাক্ষা সাফল্য লাভ। সেই পথ-পরিক্রমায় কর্ম ও চিন্তায় অজ্ঞ-বিজ্ঞ সকলেই কমবেশি ভুল করে থাকে। অনেক সময় প্রবৃত্তির তাড়নায়ও মানুষ ভুল পথে হাঁটে। লেখকের মতে, ভুল মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনাবর্ত অতিক্রমণে যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেওয়াই মানুষের বিশেষত্ব। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধিত হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভুলের মধ্য দিয়েই মানুষ সত্যে পৌছে। আত্মকৃত ভুলের শিক্ষা মানুষকে দুঃখ ও অনুশোচনার আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করে। মানুষকে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও প্রেমময় করে তোলে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভুলের কার্যকারিতা সত্যোদৃঘাটনের শক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে লেখকের কাছে মনে হয়েছে, ভুলই পৃথিবীর অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকা শক্তি। এ রচনায় লেখক জীবনের এক ধরনের দর্শনকেই যেন ব্যক্ত করেছেন।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১. মানুষের প্রকৃত জ্ঞান আসে কিসের মাধ্যমে?
ক. পড়াশোনার
খ. শিক্ষাগুরুর 
গ. অভিজ্ঞতার
ঘ. ভ্রমণের 

২. ভুল না করলে যেন সত্যের প্রকৃত রূপটি ধরা পড়ে না। কারণ—
ক, মানুষের স্বভাব ভুল করা।
খ. সত্যের পূর্বশর্ত হলো ভুল করা 
গ, ভুল মানুষকে পরিশুদ্ধি দান করে
ঘ. ভুলের মাধ্যমে মানুষ সত্যের সন্ধান পায়। 

নিচের কবিতাংশটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
পাপে পুণ্যে সুখে দুখে পতনে উত্থানে,
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে। 

৩. পঙক্তিদ্বয়ের বক্তব্য “ভুলের মূল্য প্রবন্ধের যে যে বাক্যকে সমর্থন করে তা হলো-
i. ভুল না করলে সত্যের প্রকৃত রূপটি ধরা পড়ে না। 
ii. অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে প্রকৃত জ্ঞান আসে 
iii. ভুল আছে বলে পৃথিবীটা এত সুন্দর 

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ.i, ii ও ii 

৪. উক্ত বিবরণের প্রেক্ষিতে শিক্ষণীয় বিষয় কোনটি?
ক, জীবনে পদে পদে ভুল করা।
খ. ভুল থেকে সংশোধিত হওয়া 
গ. মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া 
ঘ. ঠেকে না শিখে দেখে শেখ

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
i. নাসির সাহেবের স্ত্রী সবকিছুতে শুরুতেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। ছেলে-মেয়েদের কোনো ভুল তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। ফলে, তিনি যেমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তেমনি সন্তানেরাও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে।
ii. অফিস থেকে ফিরে নাসির সাহেব দেখলেন, তার স্ত্রী সন্তানদের বকাবকি করছেন নিশ্চয়ই তারা কোনো ভুল করেছে। তিনি স্ত্রীকে বললেন- ভুল করা খুব স্বাভাবিক বিষয়, একটি ভুল মানুষকে শত ভুল না করার শিক্ষা দেয়। ভুল করা ছাড়া মানুষ পরিশুদ্ধি লাভ করতে পারেন না, আর ভুল আছে বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর।
ক. ভালোবাসা বা প্রেমের মূল উৎস কী? 
খ. লেখক ভুলকে একই সাথে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য বলেছেন কেন? 
গ. অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশে “ভুলের মূল্য প্রবন্ধের কোন দিকটি ফুটে উঠেছে? ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. নাসির সাহেবের স্ত্রীর মানসিকতা পরিবর্তনে “ভুলের মূল্য প্রবন্ধের বক্তব্য কতটুকু কার্যকর বলে তুমি মনে কর। মতের পক্ষে যুক্তি দাও।
Share:

বাংলা গল্প 'তাজমহল' -বনফুল

[লেখক-পরিচিতিঃ বনফুল ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়ার মণিহারপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলির শিয়াখালায়। সাহিত্য জগতে ‘বনফুল' ছদ্মনামে খ্যাত ছোটগল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবির আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। পেশায় ডাক্তার এই লেখক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর স্বচ্ছন্দ দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় রয়েছে ছোটগল্পে। সেখানে উঠে এসেছে বিচিত্র সব মানুষের জীবনছবি, যাঁদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে। তাঁর রচিত শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জঙ্গম', ‘স্থাবর’, ‘হাটে বাজারে’, ‘ভুবন সোম’, ‘গল্প সংগ্রহ’, ‘কিছুক্ষণ’, ‘রাত্রি’, ‘ডানা ইত্যাদি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী অবলম্বনে রচিত ‘শ্রীমধুসূদন' নাটক তার অন্যতম বিখ্যাত রচনা। তাঁর বেশকিছু উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি পেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদকসহ বহু পদক ও সম্মানে। ভূষিত হয়েছেন। বনফুল ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ

তাজমহল

প্রথম যখন আগ্রা গিয়েছিলাম তাজমহল দেখতেই গিয়েছিলাম। প্রথম দর্শনের সে বিস্ময়টা এখনও মনে আছে। ট্রেন তখনও আগ্রা স্টেশনে পৌছায়নি। একজন সহযাত্রী বলে উঠলেন- ওই যে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালাম।

দূর থেকে দিনের আলোয় তাজমহল দেখে দমে গেলাম। চুনকাম-করা সাধারণ একটা মসজিদের মতো ওই তাজমহল! তবু নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম। হাজার হোক তাজমহল। শাহজাহানের তাজমহল। ... অবসন্ন আপরাহ্নে বন্দি শাহজাহান আগ্রা দুর্গের অলিন্দে বসে এই তাজমহলের দিকেই চেয়ে থাকতেন। মমতাজের বড় সাধের তাজমহল। ... আলমগীর নির্মম ছিলেন না।

পিতার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন নি তিনি ... মহাসমারোহে মিছিল চলেছে ... সম্রাট শাহজাহান চলছেন প্রিয়া সন্নিধানে? আর বিচ্ছেদ সইল না ... শবাধার ধীরে ধীরে নামছে ভূগর্ভে ... ওই তাজমহলেই মমতাজের ঠিক পাশে শেষ-শয্যা প্রস্তুত হয়েছে তাঁর। আর একটা কবরও ছিল ... হয়ত এখনও আছে ... ওই তাজমহলেরই পাশে। দারা সেকোর ... চুনকাম-করা সাধারণ মসজিদের মতো তাজমহল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। পূর্ণিমার পরদিন।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

তখনও চাঁদ ওঠেনি। জ্যোৎস্নার পূর্বাভাষ দেখা দিয়েছে পূর্ব দিগন্তে। সেই দিন সন্ধ্যার পর দ্বিতীয়বার দর্শন করতে গেলাম তাজমহলকে। অনুভূতিটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই অস্ফুট মর্মর-ধ্বনি কানে এলো। ঝাউ-বীথি থেকে নয় মনে হলো যেন সুদূর অতীত থেকে; মর্মর-ধ্বনি নয়, যেন চাপা কান্না। ঈষৎ আলোকিত অন্ধকারে পুঞ্জীভূত তমিস্রার মতো স্তুপীকৃত ওইটেই কি তাজমহল? ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলাম।

মিনার, মিনারেট, গম্বুজ স্পষ্টতর হতে লাগল ক্রমশ। শুভ্র আভাসও ফুটে বেরুতে লাগলো অন্ধকার ভেদ করে। তারপর অকস্মাৎ আবির্ভূত হলো- সমস্তটা মূর্ত হয়ে উঠলো যেন সহসা বিস্মিত চেতনা-পটে। চাঁদ উঠলো। জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ ওড়নায় অঙ্গ ঢেকে রাজ-রাজেশ্বরী শাহজাহান-মহিষী মমতাজের স্বপ্নই অভ্যর্থনা করলে যেন আমাকে এসে স্বয়ং। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। তারপর অনেক দিন কেটেছে।
তাজমহল - বনফুল
লেখকঃ বনফুল
কোন কনট্রাক্টার তাজমহল থেকে কত টাকা উপার্জন করে, কোন হোটেল-ওয়ালা তাজমহলের দৌলতে রাজা বনে গেল, ফেরিওয়ালাগুলো বাজে পাথরের ছোট ছোট তাজমহল আর গড়গড়ার মতো সিগারেট পাইপ বিক্রি করে কত পয়সা পেত রোজ, নিরীহ আগন্তুকদের ঠকিয়ে টাঙাগুলো কি ভীষণ ভাড়া নেয়- এ সব খবরও পুরোনো হয়ে গেছে। অন্ধকারে, জ্যোৎস্নলোকে, সন্ধ্যায়, উষায়, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরতে বহুবার বহুরূপে দেখেছি তারপর তাজমহলকে। এতবার যে আর চোখে লাগে না। চোখে পড়েই না। ... পাশ দিয়ে গেলেও নয়। তাজমহলের পাশ দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয় আজকাল। আগ্রার কাছেই এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছি আমি। তাজমহল সম্বন্ধে আর মোহ নেই। একদিন কিন্তু গোড়া থেকেই শুনুন তাহলে।

সেদিন ‘আউট ডোর সেরে বারান্দা থেকে নামছি, এক বৃদ্ধ মুসলমান গেট দিয়ে ঢুকলো। পিঠে প্রকাণ্ড একটা ঝুড়ি বাধা। ঝুড়ির ভারে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে বেচারির। ভাবলাম কোনও মেওয়াওয়ালা বুঝি। ঝুড়িটা নামাতেই কিন্তু দেখতে পেলাম, ঝুড়ির ভেতর- মেওয়া নয়, বোরখাপরা মহিলা বসে আছে একটি। বৃদ্ধের চেহারা অনেকটা বাউলের মতো, আলখাল্লা পরা, ধপধপে সাদা দাড়ি। এগিয়ে এসে আমাকে সেলাম করে চোস্ত উর্দু ভাষায় বললে- নিজের বেগমকে পিঠে করে বয়ে এনেছে সে আমাকে দেখাবে বলে। নিতান্ত গরিব সে। আমাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ‘ফি’ দিয়ে দেখাবার সামর্থ্য তার নেই। আমি যদি মেহেরবানি করেকাছে যেতেই দুর্গন্ধ পেলাম একটা। হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে বোরখা খুলতেই (আপত্তি করেছিল সে ঢের) ব্যাপারটা বোঝা গেল। ক্যাংক্রাম অরিস!

মুখের আধখানা পচে গেছে। ডানদিকের গালটা নেই। দাঁতগুলো বীভৎসভাবে বেরিয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। দুর থেকে পিঠে করে বয়ে এনে এ রোগীর চিকিৎসা নডোরেও জায়গা নেই তখন। অগত্যা হাসপাতালের বারান্দাতেই থাকতে বললাম। বারান্দাতেও কিন্তু রাখা গেল না শেষ পর্যন্ত। ভীষণ দুর্গন্ধ। অন্যান্য রোগী আপত্তি করতে লাগল। কম্পাউন্ডার, ড্রেসর, এমনকি মেথর পর্যন্ত কাছে যেতে রাজি হলো না। বৃদ্ধ কিন্তু নির্বিকার। দিবারাত্র সেবা করে চলেছে। সকলের আপত্তি দেখে সরাতে হলো বারান্দা থেকে। হাসপাতালের কাছে একটা বড় গাছ ছিল। তারই তলায় থাকতে বললাম। তাই থাকতে লাগল। হাসপাতাল থেকে রোজ ওষুধ নিয়ে যেত। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ইনজেকশান দিয়ে আসতাম।

এভাবেই চলছিল। একদিন মুষলধারে বৃষ্টি নামল। আমি ‘কল’ থেকে ফিরছি, হঠাৎ চোখে পড়ল বুড়ো দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটা চাদরের দুটো খুঁট গাছের ডালে বেঁধেছে আর দুটো খুঁট নিজে দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে ভিজছে লোকটা! মোটর ঘোরালাম। সামান্য চাদরের আচ্ছাদনে মুষলধারা আটকায় না। বেগম সাহেব দেখলাম আপাদমস্তক ভিজে গেছে। কাপছে ঠক ঠক করে। আধখানা মুখে বীভৎস হাসি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। বললাম- “হাসপাতালের বারান্দাতেই নিয়ে চল আপাতত।” বৃদ্ধ হঠাৎ প্রশ্ন করলে- “এর বাঁচবার কোনও আশা আছে হুজুর?” সত্যি কথা বলতে হলো না। বুড়ো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি চলে এলাম। পরদিন দেখি গাছতলা খালি। কেউ নেই। আরও কয়েকদিন পরে- সেদিনও কল থেকে ফিরছি- একটা মাঠের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে বুড়োকে দেখতে পেলাম।

কী যেন করছে বসে বসে। আঁ আঁ করছে দুপুরের রোদ। কী করছে বুড়ো ওখানে? মাঠের মাঝখানে মুমূর্ষ বেগমকে নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছে না কি? এগিয়ে গেলাম। কতগুলো ভাঙা ইট আর কাদা নিয়ে বুড়ো কী যেন গাঁথছে। “কী হচ্ছে এখানে মিয়া সাহেব-” বৃদ্ধ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সেলাম করলে আমাকে। “বেগমের কবর গাঁথছি হুজুর।”

“কবর?” “হ্যা হুজুর।” চুপ করে রইলাম। খানিকক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর জিজ্ঞাসা করলাম- “তুমি থাক কোথায়?” “আগ্রার আশে-পাশে ভিক্ষে করে বেড়াই গরিব-গরবয়।” “দেখিনি তো কখনও তোমাকে। কী নাম তোমার?” “ফকির শাজাহান।” নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।


শব্দার্থ ও টীকাঃ
অলিন্দ - চাতাল। বারান্দা।
দারা সেকো - দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আওরঙ্গজেব তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি ও হত্যা করেন। তিনি উদার-হৃদয় ও বিনয়ী ছিলেন। পারস্য ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ করায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তিনি।
তমিস্রা - অন্ধকার। অন্ধকার রাত।
মিনারেট - মিনারসদৃশ উচু স্তম্ভ। Minaret।
গম্বুজ - গোলাকার ছুঁচালো ছাদ।
গড়গড়া – ছোট এক রকমের আলবোলা। মাটিতে রাখা হয় এমন লম্বা নলযুক্ত হুঁকো।
টাঙা - দুই চাকাওয়ালা এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি।
মেওয়াওয়ালা - ফলবিক্রেতা।
আলখাল্লা - পা পর্যন্ত লম্বা এক রকম ঢিলা জামা।
চোস্ত - নিপুণ। ত্রুটিহীন।
ক্যাংক্রাম অরিস - গলিত মুখক্ষত। Cancrum oris।
ড্রেসার - ক্ষতস্থান শুশৃষাকারী। Dresser।
গরিব-গরবয় - গরিব-গুর্বা। দীন-দরিদ্র।

পাঠ-পরিচিতিঃ বনফুলের “তাজমহল” গল্পটি তাঁর ‘অদৃশ্যলোকে' গল্প-সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গল্পে অবিস্মরণীয় মহিমা পেয়েছে সমাজের নিচুতলার মানুষ ফকির শাজাহানের পত্নীপ্রেম। সে সম্রাট শাহজাহানের মতো তাজমহল নির্মাণ করতে না পারলেও ইট-বালি দিয়ে নিজের মতো করে মৃত বেগমের কবর গড়েছে। কাহিনি, ঘটনা ও চরিত্র রূপায়ণের দিক থেকে “তাজমহল” গল্পটি বিস্তত পরিসরের নয়। খুব সংহত শিল্প বিন্যাসই এ গল্পের বৈশিষ্ট্য। বনফুল তার অন্যান্য গল্পের মতো এ গল্পেও অত্যন্ত সচেতনভাবে মিতবাক। এ গল্পের শেষ দুটি বাক্য না পড়লে গল্পের অন্তর্গঢ় তাৎপর্য ধরা পড়ে না। অদ্ভুত চমকের ভেতর দিয়ে সেখানে। প্রকাশিত হয় এক গভীর জীবনসত্য। এখানে মানবিক অনুভুতির বাস্তব চিত্রের প্রকাশ ঘটেছে, যেখানে লেখক যুগযুগ ধরে গড়ে ওঠা মানবিক সম্পর্ককে মহিমান্বিত করেছেন। এ গল্পে লেখক নিরপেক্ষ দর্শকের মতো ঘটনা সাজিয়েছেন নিরাসক্ত বর্ণনায়। গল্পটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত হওয়ায় কাহিনি, ঘটনা, চরিত্র কোনো কিছু সম্পর্কেই লেখক কোনো মন্তব্য ও বিশ্লেষণ যোগ করেননি। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য বর্ণনা ও সংলাপের বাইরে নেই কোনো বাহুল্য। সবচেয়ে বড় কথা, এ গল্পে যে জীবনসত্য ফুটে উঠেছে তা গল্পকার পাঠককে সরাসরি বলেননি। গল্প তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়ই পাঠককে দিয়ে তা উপলব্ধি করিয়ে নেয়।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১. তাজমহল কোথায় অবস্থিত?
ক. দিল্লি 
খ. আগ্রা
গ. মাদ্রাজ 
ঘ. মুম্বাই 

২. তাজমহল সম্বন্ধে লেখকের মোহ নেই কেন?
ক. সৌন্দর্যের প্রতি নির্মোহ 
খ. মোঘলদের প্রতি বিরূপতা 
গ. একাধিকবার দর্শন 
ঘ. তাজমহলের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা 

নিচের কবিতাংশটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ
তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।

৩. কবিতাংশে “তাজমহল” গল্পের যে বিশেষ দিকটি প্রতিভাত হয়েছে তা হলো—
i. প্রিয়জনের প্রতি গভীর ভালোবাসা। 
ii. পরহিত্ৰতে আত্মলীনতা 
iii. আর্ত-পীড়িতের সুস্থতা কামনা। 

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii 
খ, ii ও iii
গ. i ও iii 
ঘ. i, ii ও iii 

৪. বিবৃতির বৈশিষ্ট্য “তাজমহল” গল্পে কার মধ্যে বিদ্যমান?
ক. লেখকের 
খ. বৃদ্ধের 
গ. ড্রেসরের 
ঘ. মেথরের

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
i. মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন আবির হাসান যখন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন তখন তার উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ ছিল না। তাদের গাড়ি চট্টগ্রাম অভিমুখে যাওয়ার সময় আবির গাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়েছিলেন কখন পাহাড় আর সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য তার চোখ জুড়াবে। আজ কর্মসূত্রে কক্সবাজারে আছেন ডা. আবির। অথচ সমুদ্রের তীরে যাওয়া হয়ে ওঠে না তার, উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দেখা হয় না সূর্যাস্ত।
ii. অফিসরুমে বসেই অলস সময় কাটাচ্ছিলেন ডা, আবির। একজন বৃদ্ধা এলেন তাঁর সাথে দেখা করতে। আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলেন যে, তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর নামে গড়েছেন হাসপাতাল ও এতিমখানা। চালু করেছেন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এমন দৃষ্টান্ত আবির হাসানকে মুগ্ধ করে।

ক. সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কী?
খ. “মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম”- কেন?
গ. প্রথম অনুচ্ছেদে “তাজমহল” গল্পের যে দিকটির ইঙ্গিত করা হয়েছে- তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের বৃদ্ধা, মোগল সম্রাট শাহজাহান ও “তাজমহল” গল্পের মুসলমান বৃদ্ধ যেন একসূত্রে গাঁথা- বিশ্লেষণ কর।

Share: