গৃহ -রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

[লেখক-পরিচিতিঃ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তাঁর প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিক সূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড়ভাই-বোনের সাহচর্যে রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৮৯৮ সালে উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনই নারীশিক্ষার লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি; বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। মতিচুর’ ও ‘অবরোধবাসিনী’ তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ গদ্যগ্রন্থ। এছাড়া সুলতানার স্বপ্ন ও ‘পদ্মরাগ' নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।]

গল্পঃ
গৃহ

গৃহ বলিলে একটা আরাম বিরামের শান্তিনিকেতন বুঝায়- যেখানে দিবাশেষে গৃহী কর্মক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে। গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে।

পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবত সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্টি বোধ হয় না। পুরুষেরা যদিও সর্বদা বিদেশে যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া অপরাহ্নে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়- বাড়ি আসিলে যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে। এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই।

আমাদের সামাজিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিতা। যাহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকদের বাটীকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহ তাহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, সে নিজেকে পরিবারের একজন গণ্য বলিয়া মনে করিতে সাহসী নহে, তাহার নিকট গৃহ শান্তিনিকেতন বোধ হইতে পারে না।

কুমারী, সধবা, বিধবা- সকল শ্রেণির অবলার অবস্থাই শোচনীয়। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অন্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবর্তী কোন শহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ি আছে।

সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্মীয় পুরুষদের বন্ধুত্ব আছে বলিয়া শরাফত? উকিলের বাড়ীর স্ত্রীলোদিগকে দেখিতে আমাদের আগ্রহ হয়। দেখিলাম, মহিলা কয়টি অতিশয় শান্ত শিষ্ট মিষ্টভাষিণী, যদিও কূপমণ্ডুক! তাহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। সেখানে শরাফতের পত্নী হসিনা, ভগ্নী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধূ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন।

অতঃপর জমিলাকে যখন আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে তাঁহারা কোন কালে বাড়ির বাহির হন না, ইহাই তাহাদের বংশগৌরব। কখনও ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন নাই। 

আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শশুরবাড়ি যান কিরূপে? আপনার ভ্রাতৃবধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্মীয়-কন্যা- এ পাড়ায় কেবল আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ি পাশাপাশি দেখিবে।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ি; এখন আমার বাড়ি চল।” তিনি আমাকে একটা অপ্রশস্ত গলির ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন।

তাঁহার সকলগুলি কক্ষ দেখাইলেন। কক্ষগুলি “অসূৰ্য্যম্পশ্য” বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বার খুলিলে দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধূ আছে! - জমিলা বলিলেন, “দেখিলে এই দ্বারের ওপার্শ্বে আমার ভাইয়ের বাড়ি, এপার্শে আমার বাড়ি। ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি।

আমাদের সওয়ারির দরকার হয় না কেন, তাহা এখন বুঝিলে?" ঐরূপে সকল বাড়িই প্রদক্ষিণ করা যায়। পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গৃহে আছেন? অবশ্য না; কেবল চারি প্রাচীরের ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না। এদেশে বাসরঘরকে “কোহ্বর” বলে, কিন্তু ‘কবর’ বলা উচিত!!

গৃহ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এইচএসসি বাংলা ১ম সৃজনশীল প্রশ্ন
লেখিকাঃ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বাড়িখানা ত শরাফতের, সেখানে যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুক্কুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলোকও আছেন? অথবা স্ত্রীলোকদের বন্দিনী” বলা যাইতে পারে। সাধারণত পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল ‘‘আমার বাটী”- পরিবারস্থ অন্যান্য লোকেরা তাঁহার আশ্রিতা। মালদহে কয়েকবার আমরা এক বাটীতে যাতায়াত করিয়াছি।

গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনও প্রফুল্লমুখী দেখি নাই। তাহার প্লান মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত। ইহার কারণ এই কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রা ভাইয়ের সহিত বিবাদ করিয়াছেন; তাহার ফলে কলিমের পত্নী স্বীয় ভগ্নীর সহিত দেখা করিতে পান না!

তিনি এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, ‘আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।” হায়! বাটী যে কলিমের! তিনি যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না। আবার ওদিকে ও বাটীখানা সলিমের! সেখানে কলিমের পত্নীর প্রবেশ নিষেধ!

গৃহ -রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন Griho By Rokeya Sakhawat Hossain
গৃহ গল্পের ভিডিওঃ

বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র বা অলংকারের অভাব নাই। বলি, অলংকার কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ভুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্নী-কণ্টক হইতেও বিমুক্ত নহে! এরূপ অবস্থায় তাহার নিকট গহ কি শান্তিনিকেতন বলিয়া বোধ হয়?

আমরা রমাসুন্দরীকে অনেকদিন হইতে জানি। তিনি বিধবা; সন্তান সন্ততিও নাই। তাঁহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই চারিটি পাকা বাড়িও আছে। তাঁহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুণ্ঠিত। আমরা বলিলাম, “ইনি হয়ত দেবর-পত্নীর সহিত কোদল করেন।

এ কথার উত্তরে একজন বলিলেন, “রমা সব করিতে জানে, কেবল কোঁদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি ও করিয়া পরকে আপন করিতে হয়; কেবল আপনাকে পর করিতে জানে না।”

“এত গুণ সত্ত্বেও দেবরের বাড়ি থাকিতে পান না কেন?”

“কপালের দোষ!

আমরা একটি রাজবাড়ি দেখিতে গিয়াছিলাম। বাড়িখানি কৰি-বর্ণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোহর। বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে।

রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসজ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধূলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল না। রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম। কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরূপ মূর্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূর্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত।

তিনি পরমা সুন্দরী বালিকা- পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; মাথায় রুক্ষ কেশের জটা অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে রাণীকে মূর্তিমতী ‘বিষাদ" বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ। রাণীর নয়ন দু'টিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম। 

আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, “তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি!” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে! ‘মহম্মদীয় আইন অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই- “আমাদের বাড়িও হয়।

কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, - বাড়ির প্রকৃত কর্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর ইত্যাদি হন। তাঁহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ির মালিক! গৃহকত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কত্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কত্রী তাহাই বুঝেন।। ঐরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাঁহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্তু কুলীন বিদ্বান। 

হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়িতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরি কি? ইহাতে যদি খদিজা সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে প্রবীণা মহিলাগণ তাঁহার হৃদয়ে স্বামীভক্তির অভাব দেখিয়া নিন্দা করেন।

আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাহা নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই- কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি? কেবল রমণীহৃদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। ঐ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে- ভগ্নীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।। 

সুখের বিষয় আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে যথেষ্ট শান্তিতে গৃহসুখে রাখেন। কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন।

যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না, দরিদ্রের জীর্ণতম কুটিরের শেষ চালোনা ঝঞানিলে উড়িয়া যায়, - টুপটাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি, - চপলা-চমকে নয়নে ধাধা লাগে, – বজ্ৰনাদে মেদিনী কাঁপে, এবং আমাদের বুক কাঁপে- প্রতি মুহূর্তে ভাবি, বুঝি বজ্রপাতে মারা যাই- তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি!

যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধূরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে থাকি। আবার যখন ঐ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়, - সোপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই, - তখনও অভিভাবকদের বাটীতে থাকি!!

অথবা গৃহস্থের বৌ-ঝি রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি; আর যখন চৈত্র মাসে ঘোর অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়, সব জিনিসপত্রসহ ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে, - আমরা একসনে প্রাণটি হাতে করিয়া কোনমতে দৌড়াইয়া গিয়া দূরস্থিত একটা কূলগাছতলে দাঁড়াইয়া কাপিতে থাকি, তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!!

ইংরেজিতে (Home) বলিতে যা বুঝায়, “গৃহ" শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই। শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতন যাহা, তাহাই গৃহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ বাসের অযোগ্য হয়; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রাতার শরণাপন্ন হয়। একটা হিন্দি প্রবাদ আছেঃ

“ঘর কি জ্বলি বনমে গেয়ী-বনমে লাগি আগ।
বন বেচারা কিয়া করে,- করম্নমে লাগি আগ!”

অর্থাৎ “গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন; বন বেচারা কি করিবে, (আমার) কপালেই লাগিয়াছে আগুন।

তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই। প্রাণিজগতে কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয়া নহে। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের।
[সংক্ষেপিত]


শব্দার্থ ও টীকাঃ
বিরাম - বিশ্রাম
নিকেতন - বাড়ি।
শ্রান্ত - কাজ করে ক্লান্ত।
গৃহী - গৃহে বসবাসকারী।
উপাদেয় - সুস্বাদু।
বাটী - বাড়ি।
অন্তঃপুর - ভেতর বাড়ি।
কূপমণ্ডুক - স্বল্পজ্ঞানী।
যথোচিত - যথার্থ।
অসূর্যম্পশ্য - সূর্যের আলো দেখতে পায় না এমন।
সওয়ারি - যাত্রী। এখানে গাড়িতে চড়ে যাত্রী হওয়ার দরকার পড়ে না বোঝানো হয়েছে।
কোহবর - কল্পনার স্বর্গ (ফাঃ)।
কুক্কুট - মোরগ, মুরগি।
প্রফুল্লমুখী - আনন্দিত।
সপত্নী-কণ্টক - সতীনকে এখানে কাটা বা যন্ত্রণা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অধীশ্বর - মালিক।
অমরাবতী - স্বর্গ।
কোদল - কোন্দল বা বিবাদের কথ্য রূপ।
মনোহর - মন হরণকারী।
টিপাই - ইংরেজি teapoy শব্দ থেকে এসেছে। হালকা খাবার পরিবেশনের জন্য তিন পা বিশিষ্ট ছোট টেবিল।
বৈঠকখানা - বসার ঘর।
বিলাত - আরবি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ। বিদেশ, ইংল্যান্ড, ইউরোপ ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
নায়েব- নায়েব ফারসি শব্দ। প্রতিনিধি অর্থে ব্যবহৃত হয়। জমিদারি ব্যবস্থায় নায়েবরা জমিদারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।
বর্ষীয়সী - বয়স্ক।
ক্রীড়াপুতুল - খেলার পুতুল।
প্রভূত - প্রচুর, অনেক।
কুলীন - উচ্চ বংশজাত।
আত্মসাৎ - অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হয়েছে এমন।
নরাকার - মানুষ স্বরূপ।
পিশাচ  - নিষ্ঠুর, লোভী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঝঞ্ঝালিন -  ঝড়ের বাতাস।
বজ্রনাদ - বজ্রের শব্দ।
চপলা-চমক - বিদ্যুচ্চমক।
মেদিনী - পৃথিবী।
ত্রিতল - তিন তলা বিশিষ্ট।
অট্টালিকা - দালান।
সোপান - সিঁড়ি।
কলেবর - দেহ, শরীর।
গোশালা - গোয়ালঘর।
অমানিশীথ - অন্ধকার রাত্রি।
লঙ্কাকাণ্ড - রাম-রাবণের যুদ্ধ। এখানে ‘দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয়’ বলতে বোঝানো হয়েছে বাজে লোকের আক্রমণ। 
শরণাপন্ন - শরণ অর্থ সাহায্য বা আশ্রয়। শরণ ও আপন্ন শব্দ দুটি যুক্ত হয়ে শরণাপন্ন, অর্থাৎ আশ্রয় বা সাহায্যপ্রার্থী।
পর্ণকুটীর - পাতার ঘর
নিরাশ্রয়া - আশ্রয়হীন

পাঠ-পরিচিতিঃ
প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সাধারণত বলা হয়ে থাকে, নারীর জন্য বরাদ্দ ‘ঘর', আর পুরুষের জন্য আছে ‘বাহির। অর্থাৎ পুরুষ সম্পৃক্ত থাকবে বাইরের জীবন ও জগতের সঙ্গে। অন্য দিকে, গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে নারী। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে পুরুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; নারীকে করে তোলে ঘরের সামগ্রী। কিন্তু নারীর সত্যিই কোনো ঘর বা গৃহ আছে কিনা- এ নিয়েই তৈরি হতে পারে প্রশ্ন; রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছেন ‘গৃহ' প্রবন্ধে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন, ঘর বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপন- প্রায় সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে পুরুষ। পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ ও সম্পত্তিও দখল করে নিয়েছে পুরুষ। প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে রোকেয়া দেখিয়েছেন পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বে নিজস্ব গৃহের আনন্দ ও অনুভূতি থেকে নারী প্রবলভাবে বঞ্চিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষ গৃহ বা ঘর প্রকৃতপক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। গৃহ' রচনায় প্রাবন্ধিক কাদেরকে ‘কূপমন্ডুক বলেছেন?
ক. পুরুষদের
খ. মহিলাদের 
গ. সমাজপতিদের
ঘ. রাজাদের

২। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের প্রাবন্ধিকের একথা বলার কারণ কী?
ক. দরিদ্রতা।
খ. অধিকারহীনতা 
গ. গৃহবিমুখতা
ঘ. গৃহ ভস্মীভূত হওয়া। 

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও।
দিশাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্রান্ত ঘরে। সুশিক্ষিত দিশা স্বামী-সংসারে স্বাধীনভাবে বসবাস করছেন। চাকরির পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজও করেন। সব কাজে-কর্মে সবাই সহযোগিতা করেন সবাই তাকে ভালোবাসেন। তিনিও আত্মনির্ভরশীল ও পরিতৃপ্ত।

৩। উদ্দীপকের দিশার মধ্যে গৃহ’ প্রবন্ধের কোন্ দিকটি অনুপস্থিত?
ক. স্বকীয়তা
খ. স্বাধীনতা 
গ. অভাবগ্রস্থতা
ঘ. পুরুষ-আধিপত্য 

৪। উক্ত বৈশিষ্ট্যটি নিচের যে বাক্যে পাওয়া যায়-
i. অধিকাংশ ভারত-নারী গৃহ সুখে বঞ্চিত। 
ii. প্ৰকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি 
iii. অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন। 

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii 
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
দাও হেন বর সাগরের মত 
গম্ভীর যার বাণী, 
আন্-ভুবনের অজানা সুরভি 
পরানে মিলাবে আনি,
--------------
দাও হেন স্বামী যে আমার পানে 
চাহিবে সহজ সুখে, 
যে চোখে শ্যামল প্রান্তর চায় 
উষার অরুণ মুখে, 
(কাব্য সঞ্চয়ন – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

ক. অনেকের মতে চক্ষু কীসের দর্পণ? 
খ. বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়’- একথা বলার কারণ কী? 
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘গৃহ’ রচনার বৈসাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. উদ্দীপকটি যেন প্রাবন্ধিকের মূল চাওয়া’- মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার কর।
Share:

বাংলা গল্প 'বর্ষা' -প্রমথ চৌধুরী

[লেখক-পরিচিতিঃ প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী। শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন কৃতী ছাত্র। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। সেই সঙ্গে পরিশীলিত বাগবৈদগ্ধ্যময় রম্যরচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে ‘বীরবল ছদ্মনামে। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষারীতির প্রথম মুখপত্র ‘সবুজপত্র পত্রিকাটি ছিল তারই সম্পাদিত। রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন বিখ্যাত মননশীল লেখকদের অনেকেই ছিলেন এই পত্রিকার লেখক। প্রমথ চৌধুরীর গদ্যশৈলীর নিদর্শন রয়েছে ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘বীরবলের হালখাতা', রায়তের কথা’, ‘তেল-নুন-লকড়ি ইত্যাদি গদ্যগ্রন্থে। সনেট পঞ্চাশৎ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। গল্পকার ও সনেটকার হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিশিষ্ট অবস্থান রয়েছে। প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের দোসরা সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
বর্ষা
এমন দিনে কী লিখতে মন যায়?
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে, যে দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমগ্র আকাশ বর্ষায় ভরে গিয়েছে। মাথার উপর থেকে অবিরাম অবিরল অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টির ধারা পড়ছে। সে ধারা এত সূক্ষ্ম নয় যে চোখ এড়িয়ে যায়, অথচ এত স্থূল নয় যে তা চোখ জুড়ে থাকে। আর কানে আসছে তার একটানা আওয়াজ; সে আওয়াজ কখনো মনে হয় নদীর কুলুধ্বনি, কখনো মনে হয় তা পাতার মর্মর। আসলে তা একসঙ্গে ও দুই-ই; কেননা আজকের দিনে জলের স্বর ও বাতাসের স্বর দুই মিলে-মিশে এক সুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

এমন দিনে মানুষ যে অন্যমনস্ক হয় তার কারণ তার সকল মন তার চোখ আর কানে এসে ভর করে। আমাদের এই চোখ-পোড়ানো আলোর দেশে বর্ষার আকাশ আমাদের চোখে কী যে অপূর্ব স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা বাঙালি মাত্রেই জানে। আজকের আকাশ দেখে মনে হয়, ছায়ার রঙের কোনো পাখির পালক দিয়ে বর্ষা তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে দিয়েছে, তাই তার স্পর্শ আমাদের চোখের কাছে এত নরম, এত মোলায়েম। 
বর্ষা প্রমথ চৌধুরী এইচএসসি বাংলা ১ম সৃজনশীল প্রশ্ন
লেখকঃ প্রমথ চৌধুরী
তার পর চেয়ে দেখি গাছপালা মাঠঘাট সবারই ভিতর যেন একটা নতুন প্রাণের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণের আনন্দে নারকেল গাছগুলো সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে, আর তাদের মাথার ঝাকড়া চুল কখনো-বা এলিয়ে পড়ছে, কখনো-বা জড়িয়ে যাচ্ছে। আর পাতার চাপে যেসব গাছের ডাল দেখা যায় না, সেসব গাছের পাতার দল এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, পরস্পর কোলাকুলি করছে; কখনো-বা বাতাসের স্পর্শে বেঁকে-চুরে এমন আকার ধারণ করছে। যে, দেখলে মনে হয় বৃক্ষলতা সব পত্রপুটে ফটিকজল পান করছে। আর এই খামখেয়ালি বাতাস নিজের খুশিমতো একবার পাঁচ মিনিটের জন্য লতা-পাতাকে নাচিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ধারাকে ছড়িয়ে দিয়ে আবার থেমে যাচ্ছে।

তারপর আবার সে ফিরে এসে যা ক্ষণকালের জন্য স্থির ছিল তাকে ছুঁয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সে যেন জানে যে তার স্পর্শে যা-কিছু জীবন্ত অথচ শান্ত সে সবই প্রথমে কেঁপে উঠবে, তার পর ব্যতিব্যস্ত হবে, তারপর মাথা নাড়বে, তারপর হাত-পা ছুড়বে; আর জলের গায়ে ফুটবে পুলক। বৃষ্টির সঙ্গে বৃক্ষপল্লবের সঙ্গে সমীরণের এই লুকোচুরি খেলা আমি চোখ ভরে দেখছি আর কান পেতে পেতে শুনছি। মনের ভিতর আমার এখন আর কোনো ভাবনাচিন্তা নেই, আছে শুধু এমন-একটা অনুভূতি যার কোনো স্পষ্ট রূপ নেই, কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই।
মনের এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কী লেখা যায়? যদি যায় তো সে কবিতা, প্রবন্ধ নয়।

আনন্দে-বিষাদে মেশানো ঐ অনামিক অনুভূতির জমির ওপর অনেক ছোটোখাটো ভাব মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠছে, আবার মুহূর্তেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে। এই বর্ষার দিনে কত গানের সুর আমার কানের কাছে গুনগুন করছে, কত কবিতার শ্লোক, কখনো পুরোপুরি কখনো আধখানা হয়ে আমার মনের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকে আমি ইংরেজি ভুলে গিয়েছি। যেসব কবিতা যেসব গান আজ আমার মনে পড়ছে সেসবই হয় সংস্কৃত, নয় বাংলা, নয় হিন্দি।

মেঘৈমেদুরষরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্ৰমৈঃ

গীতগোবিন্দের এই প্রথম চরণ যে বাঙালি একবার শুনেছে চিরজীবন সে আর তা ভুলতে পারবে না। আকাশে ঘনঘটা হলেই তার কানে ও-চরণ আপনা হতেই বাজতে থাকবে। সেইসঙ্গে মনে পড়ে যাবে মনের কত পুরনো কথা, কত লুকানো ব্যথা। আমি ভাবছি মানুষ ভাষায় তার মনের কথা কত অল্প ব্যক্ত করে, আর কত বেশি অব্যক্ত রয়ে যায়। ভাষায় মনোভাব ব্যক্ত করবার জন্যই যারা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরাও, অর্থাৎ কবির দলও, আমার বিশ্বাস, তাদের মনকে অর্ধেক প্রকাশ করেছেন, অর্ধেক গোপন রেখেছেন। আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের একটি পুরনো গানের প্রথম ছত্রটি ঘুরে-ফিরে ক্রমান্বয়ে আমার কানে আসছে – “এমন দিনে তারে বলা যায়। এমন দিনে যা বলা যায় তা হয়ত রবীন্দ্রনাথও আজ পর্যন্ত বলেন নি, শেক্সপিয়রও বলেন নি।

বলেন যে নি, সে ভালোই করেছেন। কবি যা ব্যক্ত করেন তার ভিতর যদি এই অব্যক্তের ইঙ্গিত না থাকে তা হলে তাঁর কবিতার ভিতর কোনো mystery থাকে না, আর যে কথার ভিতর mystery নেই, তা কবিতা নয় – পদ্য হতে পারে। সে যাই হোক, আজ আমার কানে শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের সুর লেগে নেই, সেইসঙ্গে তিনি বর্ষার যে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন সেইসব চিত্র বায়োস্কোপের ছবির মতো আমার চোখের সুমুখ দিয়ে একটির পর আর-একটি চলে যাচ্ছে। ভালো কথা – এটা কখনো ভেবে দেখেছেন যে, বাংলার বর্ষা রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন, ও-ঋতুর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে রবীন্দ্রনাথের ভারতী ভরপুর, তার ভীমমূর্তি আর তার কান্তমূর্তি, দুইই তাঁর চোখে ধরা পড়েছে, দুইই তাঁর ভাষায় সমান সাকার হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে সেকালের একটা কবিতা আছে যা একাই একশো-

রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন।
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে॥

সংগীত হিসেবে এ কবিতা গীতগোবিন্দের তুল্য। আর কাব্য হিসেবে তার অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ। আজ আমার মনের ভিতর দিয়ে যেসব কথা আনাগোনা করছে সেসব এতই বিচ্ছিন্ন এতই এলোমেলো যে, সেসব যদি ভাষায় ধরে তার পর লেখায় পুরে দেওয়া যায় তা হলে আমার প্রবন্ধ এতই বিশৃঙ্খল হবে যে, পাঠক তার মধ্যে ভাবের গোলকধাঁধায় পড়ে যাবেন। আর যদি এমন পাঠকও থাকেন যিনি বাংলাদেশের ছেলেভুলানো ছড়া-পাঁচালির অনুরূপ অসম্বন্ধ গদ্যরচনা মনের সুখে পড়তে পারেন তা হলেও আমি আজ মন খুলে লিখতে প্রস্তুত নই। অনেক কথা যা আজ মনে পড়ছে তার যা-কিছু মূল্য আছে তা আমার কাছেই আছে, অপর কারো কাছে নেই।

বহুকাল-মৃত বহুকাল-বিস্মৃত কোনো শুকনো ফুলের পাপড়ি যদি হঠাৎ আবিষ্কার করা যায় তা হলে যে সেটিকে এককালে সজীব অবস্থায় সাদরে সঞ্চিত করে রেখেছিল, একমাত্র তারই কাছে সে শুষ্কপুষ্পের মূল্য আছে, অপরের কাছে তা বর্ণগন্ধহীন আবর্জনা মাত্র। মানুষের স্মৃতির ভিতরও এমন অনেক শুকনো ফুল সঞ্চিত থাকে যা অপরের কাছে বার করা যায় না। কিন্তু এমন দিনে তা আবিষ্কার করা যায়। আবার ঘোর করে এল, বাতি না জ্বালিয়ে লেখা চলে না; আর কালির অপব্যয় করা যত সহজ বাতির অপব্যয় করা তত সহজ নয়। অতএব এইখানেই এ লেখা শেষ করি। 


শব্দার্থ ও টীকাঃ
মর্মর - শুকনো পাতার খসখস ধ্বনি।
হিল্লোল - ঢেউ।
এলিয়ে - শিথিল হয়ে।
পত্রপুট - পাতা দিয়ে তৈরি ঠোঙা।
ফটিকজল - স্বচ্ছ পানি।
অনামিক অনুভূতি  - নাম দেয়া যায় না এমন অনুভূতি।
শ্লোক - ছন্দোবদ্ধ বাক্য।
‘মেঘৈ... মৈ’- মেঘেতে মেদুর আকাশ, তাল তমালে শ্যামা বনভূমি। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের বর্ষা বর্ণনা। জয়দেবের বর্ষার এই সহজ-সরল রূপ বাঙালির চিরচেনা।
গীতগোবিন্দ - কবি জয়দেবের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
ঘনঘটা - মেঘের আড়ম্বর।
ছত্র - পঙক্তি। লাইন। 
Mystery - রহস্য। 
বায়োস্কোপ - চলচ্চিত্র। ছায়াছবি।
কান্তমূর্তি - সুন্দর বা কমনীয় মূর্তি।
সাকার - আকার বিশিষ্ট।
ঘন - মেঘ।
দেয়া - আকাশ। মেঘ।
বরিষে - বর্ষিত হচ্ছে।
রঙে - আনন্দে। আমোদে।
বিগলিত চীর অঙ্গে - অঙ্গের শিথিল বা অবিন্যস্ত পোশাকে।
নিদ - নিদ্রা
হরিষে - আনন্দে।
গোলকধাঁধা - প্রহেলিকা।
পাঁচালি - গীতাভিনয়।

পাঠ-পরিচিতিঃ প্রমথ চৌধুরীর “বর্ষা” প্রবন্ধটি তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহ' (১৯৫২) থেকে সংকলিত এবং ঈষৎ সংক্ষেপিত। নদীমাতৃক এই দেশে বর্ষা ঋতু অত্যন্ত পরিচিত। অবিরাম বৃষ্টিতে বৃক্ষরাজির অবস্থা, মানব মনের আনন্দ-বিষাদ মাখানো অনুভূতি, বর্ষার গান ও কবিতা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের বর্ষার চিত্র প্রাবন্ধিকের মন জুড়ে বয়ে চলেছে। এমন দিন প্রতিটি বাঙালি ভাবুকজনের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর অনুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করা কঠিন। মন্ময় এই প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। বর্ষা মানবহৃদয়কে যে ভাবাবেগে আপ্লুত করে, একই সঙ্গে করে তোলে সজীব ও স্মৃতিকাতর, নৈঃসঙ্গ্যানুভূতিতে জর্জর ও সৃষ্টিমুখর- তারই মর্মকথা ব্যক্ত হয়েছে এ রচনায়। বর্ষা প্রকৃতিতে যে সজীবতা ও আনন্দানুভূতির সঞ্চার করে তা মানবের প্রাণকেও আন্দোলিত করে গভীরভাবে। এই গভীর হৃদয়ানুভূতি “বর্ষা” প্রবন্ধে অভিব্যক্ত হয়েছে; যার মধ্য দিয়ে এ রচনার ভাষা হয়ে উঠেছে নান্দিনিক অনুভব-সঞ্জাত বক্তব্য প্রকাশের বিশেষ উপযোগী।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। প্রাবন্ধিকের মতে বাংলায় বর্ষা কে আবিষ্কার করেছেন?
ক. জয়দেব
খ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
গ. কায়কোবাদ
ঘ. জসীমউদ্দীন 

২। আনন্দে-বিষাদে মেশানো অনামিক অনুভূতি বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
ক. মন খারাপ করা
খ. আত্মভোলা 
গ. মনের বিক্ষিপ্ততা
ঘ. উচ্ছ্বসিত মন 

নিচের কবিতাংশটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান
মন হারাবার আজি বেলা পথ ভুলিবার খেলা
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চির ঋণে। 

৩। উক্ত কবিতাংশটির প্রাকৃতিক অবস্থা “বর্ষা” প্রবন্ধের কোন বিষয়টির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
ক. অবিরাম বর্ষণের
খ. বর্ষায় উন্মনা মনের 
গ. সাহিত্য রচনায় অনীহার
ঘ. শুষ্কতা থেকে মুক্তির 

৪। প্রকৃতির এই অবস্থা প্রমথ চৌধুরীকে উদাস করে তোলে, কারণ—
i. বর্ষা মানবমনকে আলোড়িত করে 
ii. বর্ষায় মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে 
iii. বর্ষার আগমনে প্রকৃতি চঞ্চল হয়। 

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii 
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
এইখানে ছিল প্রমত্তা নদী। বর্ষায় এই নদীর জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক অদ্ভুত সুরের জন্ম দিত। আজ এখানে খরা। কতকাল বৃষ্টির শব্দ শুনি না। জলের ফোঁটা পাতার উপর পড়ায় পাতার যে শিহরণ তা দেখে মন ভরে যেত। ঝড়ো বৃষ্টির দাপটে গাছগুলো যেন দাঁড়িয়ে থাকা ভুলে গিয়ে দৌড়ে বেড়াতে চাইত। এভাবেই কাশেম মাঝি তার নাতনিকে বর্ষার গল্প শোনাচ্ছেন। কেন এমন হলো তা কাশেম মাঝি জানেন না। শুধু শুনেছেন পৃথিবীর মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ে যা খুশি তাই করছে। আর এই কারণে প্রকৃতি আজ এমন বিরূপ। তাহলে কি পৃথিবী থেকে বর্ষা বিদায় নেবে? মানুষ আর বর্ষার রিমঝিম শব্দে উদাস হবে না! এই সব ভাবতে ভাবতে কাশেম মাঝির দুচোখ জলে ভরে উঠে। 

ক. প্রমথ চৌধুরী বর্ষার আকাশকে কিসের সাথে তুলনা করেছেন? 
খ. বর্ষার বাতাসকে ‘খামখেয়ালি' বলা হয়েছে কেন?
গ. অনুচ্ছেদের প্রথমাংশে কাশেম মাঝির অনুভূতিতে “বর্ষা” প্রবন্ধের যে দিকটি ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. অনুচ্ছেদটি “বর্ষা” প্রবন্ধের সমগ্র আবহকে ধারণ করতে পেরেছে কি? তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।
Share: