বাংলা গল্প 'কারবালা প্রান্তর' -মীর মশাররফ হোসেন

[লেখক-পরিচিতিঃ ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়ায় মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম। তাঁর পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর না হলেও মীর মশাররফ হোসেন ফরিদপুর নবাব এস্টেটে ও দেলদুয়ার এস্টেটে চাকরি করে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। এরপর তিনি কলকাতা ও পরে পদমদিতে অনেক দিন অবস্থান করেন। ছাত্রজীবনেই ‘সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়। মুসলিম রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক হিসেবে তিনি খ্যাত।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে- নাটক: ‘বসন্তকুমারী’, ‘জমিদার দর্পণ', এর উপায় কি; গদ্য: “বিষাদ-সিন্ধু’, ‘নিয়তি কি অবনতি’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা', গাজী মিয়ার বস্তানী’, ‘ফাস কাগজ প্রভৃতি। মহররমের বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তার বিস্ময়কর সৃষ্টি। তাঁর রচিত মহাকাব্যধর্মী এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। মীর মশাররফ হোসেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
কারবালা প্রান্তর
ইমাম হোসেনের অশ্বের পদধ্বনি শ্রবণ করিয়া এজিদের সৈন্যগণ চমকিত হইল। সকলের অন্তর কাপিয়া উঠিল। সকলেই দেখিতে লাগিল, হোসেন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতেছেন। দেখিতে দেখিতে চক্ষের পলকে মহাবীর হোসেন যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাপাত্মা এজিদ! তুই কোথায়? তুই নিজে দামেস্কে থাকিয়া নিরীহ সৈন্যদিগকে কেন রণস্থলে পাঠাইয়াছিস? আজ তোকে পাইলে জ্ঞাতিবধবেদনা, ভ্রাতৃপুত্র কাসেমের বিচ্ছেদবেদনা এবং স্বীয় পুত্রগণের বিয়োগবেদনা, সমস্তই আজ তোর পাপশোণিতে শীতল করিতাম। ওরে অর্থলোভী পিশাচেরা, ধর্মভয় বিসর্জন দিয়া আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিস! আয় দেখি, কে সাহস করিয়া আমার অস্ত্রের সম্মুখে আসিবি, আয়! আর বিলম্ব কেন?

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

এজিদপক্ষীয় সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আবদুর রহমান; হোসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে তাহার চিরসাধ । অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করিয়া সেই আবদুর রহমান অসি চালনা করিতে করিতে হোসেনের সম্মুখে আসিয়া বলিতে লাগিল, “হোসেন। তুমি আজ শোকে তাপে মহা কাতর; বোধহয়, আজ দশ দিন তোমার পেটে অন্ন নাই; পিপাসায় কণ্ঠতালু বিশুষ্ক; এই কয়েকদিন কেন বাচিয়া আছ বলিতে পারি না। আর কষ্ট ভোগ করিতে হইবে না, শীঘ্রই তোমার মনের দুঃখ নিবারণ করিতেছি। বড় দর্পে অশ্বচালনা করিয়া বেড়াইতেছ; এই আবদুর রহমান তোমার সন্মুখে দাঁড়াইল, যত বল থাকে, অগ্রে তুমি আমাকে আঘাত কর। তোমার বল বুঝিয়া দেখি; যদি আমার অস্ত্রাঘাত সহ্য করিবার উপযুক্ত হও, আমি প্রতিঘাত করিব; নতুবা ফিরিয়া যাইয়া তোমার ন্যায় হীন, ক্ষীণ, দুর্বল যোদ্ধাকে খুঁজিয়া তোমার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিব।
কারবালা প্রান্তর মীর মশাররফ হোসেন এইচএসসি বাংলা ১ম সৃজনশীল প্রশ্ন
লেখকঃ মীর মশাররফ হোসেন
হোসেন বলিলেন, “এত কথার প্রয়ােজন নাই! আমার বংশমধ্যে কিংবা জ্ঞাতিমধ্যে অগ্রে অস্ত্র নিক্ষেপের রীতি থাকিলে তুমি এত কথা কহিবার সময় পাইতে না। অস্ত্রই বল পরীক্ষার প্রধান উপকরণ! কেন বিলম্ব
করিতেছিস? যে কোনো অস্ত্র হউক, একবার নিক্ষেপ করিলেই তোর যুদ্ধসাধ মিটাইতেছি। বিলম্বে তোর মঙ্গল বটে, কিন্তু আমার অসহ্য।”

হোসেনের মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলনপূর্বক “তোমার মস্তকের মূল্য লক্ষ টাকা!” এই বলিয়া আবদুর রহমান ভীম তরবারি আঘাত করিল। হোসেনের বর্মোপরি আবদুর রহমানের তরবারিসংলগ্ন হইয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

বহির্গত হইল। রহমান লজ্জিত হইয়া পলায়নের উপক্রম করিল । হোসেন বলিলেন, “অগ্রে সহ্য কর, শেষে পলায়ন করিস।” কেহই আর হোসেনের সম্মুখীন হইতে সাহস করিল না । বলিতে লাগিল, “যদি হোসেন আজ এ সময় পিপাসা নিবারণ করিতে বিন্দুমাত্রও জল পায়, তাহা হইলে আমাদের একটি প্রাণীও ইহার হস্ত হইতে প্রাণ বাঁচাইতে পারিবে না। যুদ্ধ যতই হউক, বিশেষ সতর্ক হইয়া দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা ফোরাতল এখন ঘিরিয়া রাখাই কর্তব্য। যে মহাবীর এক আঘাতে আবদুর রহমানকে নিপাতিত করিল, তাঁহার সম্মুখে কে সাহস করিয়া দাঁড়াইবে? আমরা রহমানের গৌরবেই চিরকাল গৌরব করিয়া বেড়াই, তাহারই যখন এ দশা হইল, তখন আমরা তো হোসেনের অশ্বপদাঘাতেই গলিয়া যাইব।” পরস্পর এইরূপ বলাবলি করিয়া সকলেই একমতে দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা বিশেষ সুদৃঢ়রূপে ফোরাতকূল বন্ধ করিল।

হোসেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত সমরাঙ্গনে কাহাকেও না পাইয়া শত্রুশিবিরাভিমুখে অশ্বচালনা করিলেন। তদ্দর্শনে অনেকেরই প্রাণ উড়িয়া গেল। কেহ অশ্বপদাঘাতে নরকে গমন করিল, কেহ কেহ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া হোসেনের সম্মুখে সশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। 

অবশিষ্ট সৈন্যগণ কারবালা পার্শ্বস্থ বিজন বনমধ্যে পালাইয়া প্রণরক্ষা করিল। ওমর, সীমার, আবদুল্লাহ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই হোসেনের ভয়ে বনমধ্যে লুকাইলেন। 

শত্রুপক্ষের শিবিরস্থ সৈন্য একেবারে নিঃশেষিত করিয়া হোসেন ফোরাতকূলের দিকে অশ্ব চালাইলেন। ফোরাতরক্ষীরা হঠাৎ পলাইল না, কিন্তু অতি অল্পক্ষণ হোসেনের অসির আঘাত সহ্য করিয়া আর তিষ্ঠিবার সাধ্য হইল না । যে এজিদের সৈন্যকোলাহলে প্রচণ্ড কারবালা প্রান্তর, সুপ্রশস্থ ফোরাতকল ঘন ঘন বিকম্পিত হইত; এক্ষণে হোসেনের অস্ত্রাঘাতে সেই কারবালা একেবারে জনশূন্য নীরব প্রান্তর; শীঘ্র শীঘ্র ফোরাতকূলে যাইয়া অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক একেবারে জলে নামিলেন। জলের পরিষ্কার স্নিগ্ধ ভাব দেখিয়া ইচ্ছা করিলেন যে, এককালে নদীর সমুদয় জল পান করিয়া ফেলেন। 

অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া মুখে দিবেন, এমন সময় সমুদয় কথা মনে পড়িল; আলী আকবর প্রভৃতির কথা মনে পড়িল, পিপাসার্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথা মনে পড়িল। একবিন্দু জলের জন্য ইহারা কত লালায়িত হইয়াছে, কত কাতরতা প্রকাশ করিয়াছে, কত কষ্টভোগ করিয়াছে, “এই জলের নিমিত্তই আমার পরিজনেরা পুত্রহারা, পতিহারা, ভ্রাতৃহারা হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া মরিতেছে, আমি এখন শহস্ত হইতে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া সর্বাগ্রেই নিজে সেই জল পান করিব! নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করিব! আমার প্রাণের মায়াই কি এত অধিক হইল! ধিক আমার প্রাণে! –এই জলের জন্য আলী আকবর আমার জিহ্বা পর্যন্ত চুষিয়াছে। একপাত্র জল পাইলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি মহাবীর কাসেম আজ শক্তহস্তে প্রাণত্যাগ করিত না। 

এখনো যাহারা জীবিত আছে তাহারাও তো শোকতাপে কাতর হইয়া পিপাসায় মৃতবৎ হইয়া রহিয়াছে। এ জল আমি কখনোই পান করিব না, ইহজীবনেও আর পানি পান করিব না।” এই কথা বলিয়া হস্তস্থিত জল নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়া তীরে উঠিলেন। একবার আকাশের দিকে লক্ষ্য করিয়া পবিত্র শিরস্ত্রাণ শির হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। দুই-এক পদ অগ্রসর হইয়া কোমর হইতে কোমরবন্ধ খুলিয়া দুরে ফেলিয়া দিলেন। ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক, সকল শোক একত্র আসিয়া তাহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিল। অস্ত্রশস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করিয়া ফোরাতস্রোতের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

হোসেনের অশ্ব প্রভুর হস্ত, পদ ও মস্তক শূন্য দেখিয়াই যেন মহাকষ্টে দুই চক্ষু হইতে অনবরত বাষ্পজল নির্গত করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ জেয়াদ, ওমর, সীমার আর কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল তাহারা দূর হইতে দেখিল যে, ইমাম হোসেন জলে ও নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন, পান করিলেন না। এতদ্দর্শনে ঐ কয়েকজন একত্রে ধনুর্বাণ হস্তে হোসেনকে ঘিরিয়া ফেলিল। হোসেন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন, কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না।

স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্ৰুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোনো কথা নাই। এমন নিরস্ত্র অবস্থায় শক্তহস্তে পতিত হইয়া মনে কোনো প্রকার শঙ্কা নাই। অন্যমনস্ক কী ভাবিতেছেন তাহা ঈশ্বরই জানেন, আর তিনি জানেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাতকল হইতে অরণ্যাভিমূখে দুই-এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পর্শে দূরে দূরে তাঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহার পৃষ্ঠ লক্ষ করিয়া এক বিষাক্ত লৌহশর নিক্ষেপ করিল। 

ভাবিয়াছিল যে, এক শরে পৃষ্ঠ বিদ্ধ করিয়া বক্ষস্থল ভেদ করিবে, কিন্তু ঘটনাক্রমে সে শর হোসেনের বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল, গাত্রে লাগিল না। শব্দ হইল, সে শব্দে হোসেনের ধ্যানভঙ্গ হইল না। তাহার পর ক্রমাগতই শর নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। কিন্তু একটিও ইমামের অঙ্গে বিদ্ধ হইল। সীমার শরসন্ধানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন না বলিয়াই খঞ্জর হস্তে করিয়া যাইতেছিলেন। 

এত তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে, একটিও হোসেনের অঙ্গে লাগিতেছে না। কী আশ্চর্য! সীমার এই ভাবিয়া জেয়াদের হস্ত হইতে তীরধনু গ্রহণপূর্বক হোসেনের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া একটি শর নিক্ষেপ করিলেন। তীর পৃষ্ঠে লাগিয়া গ্রীবাদেশের একপা ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। সেদিকে হাসানের ভ্রুক্ষেপ নাই। এমন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন যে, শরীরের বেদনা পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। যাইতে যাইতে অন্যমনষ্ক একবার গ্রীবাদেশে বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন। 

জলের ন্যায় বোধ হইল; -করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন জল নহে-গ্রীবানিঃসৃত সদ্যরক্ত! রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সভয়ে চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন- আবদুল্লাহ জেয়াদ, অলীদ, ওমর, সীমার এবং আর কয়েকজন সেনা চতুর্দিক ঘিরিয়া যাইতেছে। সকলের হস্তেই তীরধনু। ইহা দেখিয়াই চমকিত। যে সমুদয় বসনের মাহাত্মে নির্ভয় হৃদয় ছিলেন- তৎসমুদয় পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, বর্ম, খঞ্জর কিছুই সঙ্গে নাই, কেবল দুখানি হাত মাত্র। অন্যমনস্কভাবে দুই-এক পদ করিয়া চলিলেন; শত্রুরাও পূর্ববৎ ঘিরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল। 

কিছু দূরে যাইয়া হোসেন আকাশপানে দুই-তিন বার চাহিয়া ভূ-তলে পড়িয়া গেলেন। বিষাক্ত তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানের জ্বালা, পিপাসার জ্বালা, শোকতাপ, বিয়োগ দুঃখ- নানা প্রকার জ্বালায় অধীর হইয়া পড়িলেন। জেয়াদ এবং ওমর প্রভৃতি ভাবিল যে, হোসেনের মৃত্যু হইয়াছে। কিছুক্ষণ পরে হস্তপদ সঞ্চালনের ক্রিয়া দেখিয়া নিশ্চয় হোসেনের মৃত্যু মনে করিল না, মৃত্যু নিকটবর্তী জ্ঞান করিয়া কিঞ্চিৎ দূরে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিল। 

হোসেন জীবিত আছেন। উঠিবার শক্তি নাই। অন্যমনস্ক কী চিন্তায় অভিভূত ছিলেন তিনিই জানেন। চক্ষু মেলিয়া বক্ষের উপর খঞ্জরহস্তে সীমারকে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “তুমি ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব- তুমি আমার। বক্ষের উপর বসিলে ?”

“সীমার! আমি এখনই মরিব! বিষাক্ত তীরের আঘাতে আমি অস্থির হইয়াছি। বক্ষের উপর হইতে নামিয়া আমায় নিশ্বাস ফেলিতে দাও । একটু বিলম্ব কর। একটু বিলম্বের জন্য কেন আমাকে কষ্ট দিবে? আমার প্রাণ বাহির হইয়া গেলে মাথা কাটিয়া লইও। একবার নিশ্বাস ফেলিতে দাও! আজ নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু। ক্ষণকাল অপেক্ষা কর।”

অতি কর্কশস্বরে সীমার বলিল, “আমি তোর বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছি, মাথা না কাটিয়া উঠিব না। যদি
অন্য কোনো কথা থাকে, বল। বুকের উপর হইতে একটুও সরিয়া বসিব না।”

হোসেন বলিলেন, “সীমার! তাহা হইলে শীঘ্রই মাথা কার্টিয়া ফেল! অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়া তোমার কী লাভ ও হইতেছে? বন্ধুর কার্য কর।”

“আমি তো সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিতেছি। খঞ্জরে না কাটিলে আমি আর কী করিব।”

হোসেন বলিলেন, “সীমার? তোমার বক্ষের বসন খোল দেখি?”

“কেন?”

“কারণ আছে। তোমার বক্ষ দেখিলেই আমি জানিতে পারিব যে তুমি আমার কাতেল (হস্তা) কি না।”

“তাহার অর্থ কী?”

“অর্থ আছে। অর্থ না থাকিলে বৃথা তোমাকে এমন অনুরোধ করিব কী জন্য? মাতামহ বলিয়া গিয়াছেন, রক্তমাংসে গঠিত দেহ হইলেও যে বক্ষ লোমশূন্য তাহার হস্তেই তোমার নিশ্চয় মৃত্যু। মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয় । সীমার তোমার বস্ত্র খুলিয়া ফেল। আমি দেখি, যদি তাহা না হয় তবে তুমি বৃথা চেষ্টা করিবে কেন? 

সীমার গাত্রের বসন উন্মোচন করিয়া হোসেনকে দেখাইল। নিজেও দেখিল । হোসেন সীমারের বক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুই হস্তে দুই চক্ষু আবরণ করিলেন। বার বার খঞ্জর ঘর্ষণে হোসেন বড়ই কাতর হইলেন। পুনরায় সীমারকে বলিতে লাগিলেন, “আর একটি কথা আমার মনে হইয়াছে, বুঝি তাহাতেই খঞ্জরের ধার ফিরিয়া গিয়াছে, তোমার পরিশ্রম বৃথা হইতেছে, সীমার! মাতামহ জীবিতাবস্থায় অনেক সময় স্নেহ করিয়া আমার গলদেশ চুম্বন করিয়াছিলেন। সেই পবিত্র ওষ্ঠের চুম্বন মাহাত্মেই তীক্ষধার অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে।”

“না, তাহা কখনোই হইবে না। এরূপ কিছুতেই কার্যসিদ্ধ হইবে না। দেখ নিশ্বাস ফেলিতে আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে। শীঘ্র শীঘ্র তোমার কার্য শেষ করিলে তোমারও লাভ, আমারও কষ্ট নিবারণ। তুমি ঐ তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর বসাও, এখনই ফল দেখিতে পাইবে।”

“ তোমার কথা শুনিলে আমার কী লাভ হইবে?”

“অনেক লাভ হইবে! আমি ধৰ্মত প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরকালে তোমাকে অবশ্যই মুক্ত করাইব। পুনঃ পুনঃ ঈশ্বরের নাম করিয়া আমি ধৰ্মত প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমাকে স্বর্গে লইয়া যাইতে না পারিলে আমি কখনই স্বর্গের দ্বারে পদনিক্ষেপ করিব না। ইহা অপেক্ষা তুমি আর কী লাভ চাও ভাই?”

হোসেনের বক্ষ পরিবর্তন করিয়া সীমার তাহার পৃষ্ঠোপরি বসিল । ইমামের দুইখানি হস্ত দুইদিকে পড়িয়া গেল, 
-দেখাইতে লাগিল, “জগৎ দেখুক, আমি কী অবস্থায় চলিলাম! নূরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র, মদিনার রাজা, 
-মহাবীর আলীর পুত্র হইয়া শূন্যহস্তে সীমারের অস্ত্রাঘাতে কীভাবে আমি ইহ সংসার হইতে বিদায় লইলাম! জগৎ দেখুক!”

আকাশ, পাতাল, অন্তরীক্ষ, অরণ্য, সাগর, পর্বত, বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দিক হইতে রব হইতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!!”


শব্দার্থ ও টীকাঃ
পাপাত্মা - পাপে পূর্ণ আত্মা। এখানে পাপী।
দামেস্ক  - ইরাকের একটি স্থান।
রণস্থল  - রণ অর্থ যুদ্ধ, স্থল অর্থ স্থান। রণস্থল হলো যুদ্ধ করার স্থান।
জ্ঞাতিবধবেদনা - আত্মীয় হত্যার যন্ত্রণা ।
বিচ্ছেদবেদনা - বিচ্ছেদ বা দূরত্ব তৈরি হওয়ার জন্য বেদনা। মৃত্যুর ব্যথা অর্থেও বিচ্ছেদবেদনা ব্যবহৃত হয়। 
স্বীয় - নিজ।
বিয়োগবেদনা  - কারো মৃত্যুর কারণে তৈরি হওয়া ব্যথা।
পাপশোণিত  - পাপের রক্ত।
পিশাচ - সাধারণত ভূত প্রেত ইত্যাদি বোঝায় শব্দটি দ্বারা। কিন্তু এখানে পাপী, অমানুষ হিসেবে বোঝানো হয়েছে। 
অশ্বপৃষ্ঠ - ঘোড়ার পিঠ।
আরোহণ  - ওঠা।  যেমন : ঘোড়ায় আরোহণ।
অসি  - তরবারি।
দর্প  - অহংকার।
জ্ঞাতি - আত্মীয়স্বজন।
অগ্রে  - আগে।
ভীম  - ভীষণ, ভয়ঙ্কর। 
বহির্গত - বের হওয়া।
নিবারণ  - নিবৃত্ত করা। থামানো ।
ফোরাতকূল - ফোরাত নদীর তীর। ইরাক অঞ্চলের নদী।
নিপাতিত  - পতিত করা।
অশ্বপদাঘাত - ঘোড়ার পায়ের আঘাত।
সমরাঙ্গন  - সমর ও অঙ্গন মিলে সমরাঙ্গন, অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্র।
শত্রুশিবিরাভিমুখ  - শত্রু যেখানে অবস্থান করে সেই দিকে।
তদ্দর্শনে - তা দেখে।
বিজন  - জনমানব নেই এমন।
তিষ্ঠিবার  - অপেক্ষা করার, ধৈর্য ধরার, সহ্য করার ইত্যাদি বোঝায়।
কারবালা  - ইরাক অঞ্চলের বিখ্যাত ময়দান, এখানেই এজিদ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় ইমাম হোসেনের।
অবতরণপূর্বক - নেমে।
অঞ্জলিপূর্ণ - আঁজলা ভরা।
লালায়িত - লোভযুক্ত।
মৃতবৎ - মৃতের মতো।
শিরস্ত্রাণ - বর্ম।
ধনুর্বাণ - ধনুক ও তার তীর।
এতদ্দর্শনে - তা দর্শন করে, তা দেখে।
ধনুর্ধারী - ধনুক ধারণ করে আছে যে।
অরণ্যাভিমুখে - অরণ্যের অভিমুখে।
চতুষ্পর্শে - চার পাশে।
লৌহশর - লোহার তির।
শরসন্ধানে - নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ধনুকে তির স্থাপন।
খঞ্জর - চাকু, ছুরি।
গ্রীবাদেশ - ঘাড়, গলদেশ।
নেজা - বর্শা।
বল্লম - বর্শা।
পূর্ববৎ - আগের মতো।
ভূতল - মাটি।
সঞ্চালন - নড়ানো।
অন্তরীক্ষ - আকাশ।

পাঠ পরিচিতিঃ
“কারবালা-প্রান্তর” গদ্যাংশটি মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের একটি অংশ। এখানে দেখা যাচ্ছে, ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে এজিদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন হোসেন। তিনি নবি হযরত মোহাম্মদের (সা.) কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) ও জামাতা হযরত আলির (রা.) পুত্র। ক্ষমতালোভী এজিদ ষড়যন্ত্র করে হোসেনের ভাই হাসান, হাসানের পুত্র কাসেমসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কারবালা-প্রান্তরে দেখা যাচ্ছে হোসেন নিজেই যুদ্ধে নেমেছেন। যুদ্ধে এজিদ নিজে অনুপস্থিত দেখে হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কারণ এজিদ পাঠিয়েছে নিরীহ সৈনিকদের। তবু যুদ্ধের প্রয়োজনে প্রচণ্ড লড়াই করে তিনি পরাজিত করলেন এজিদ-পক্ষের সেনাদের। এক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে ফোরাত নদীর পানি পান করতে গেলেন। তার মনে পড়ল পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করা পরিবার-স্বজনদের কথা।

হোসেন আঁজলায় তুলে নেয়া পানি ফেলে দিলেন। মগ্ন হয়ে ভাবছিলেন হারানো স্বজনদের কথা। সে সময় লুকিয়ে থাকা শত্রুরা তাকে আঘাত করল। সীমারের ছুঁড়ে দেয়া বিষাক্ত তিরে বিদ্ধ হলেন তিনি। গভীর যন্ত্রণায় কাতর হলেন। হোসেনের হাতে তখন কোনো অস্ত্র নেই। সে সুযোগে সীমার তার গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কেননা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছোট হোসেনকে আদর করে গলায় চুমু খেতেন। হোসেন সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সীমারকে তাঁর পিঠের ওপর বসে ছুরি চালাতে বললেন। সীমারকে আশ্বাস দিলেন মৃত্যুর পর সীমারকে না নিয়ে স্বর্গে যাবেন না। সীমার তা-ই করল। মর্মান্তিকভাবে শহিদ হলেন হোসেন। গল্পের এ অংশে প্রকাশিত হয়েছে হোসেনের বীরত্ব, স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা, যুদ্ধনীতি ও আত্মত্যাগ।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। এজিদ পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে?
ক. সীমার 
গ. ওমর
খ. আব্দুলাহ জেয়াদ 
ঘ. আবদুর রহমান

২। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলেও ইমাম হোসেন পান করলেন না কেন?
ক. ফোরাতকূলের জল নোংরা ছিল 
খ. শত্রুপক্ষ বাধা দিয়েছিল
গ. স্বজনরা জলবিনা মারা গিয়েছিল 
ঘ. ফোরাতকূলে পৌঁছে তৃষ্ণা ছিল না 

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও। 
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সারা দেশ উত্তাল। মা'র সাথে দেখা করতে এসে মুক্তিযোদ্ধা শফিক দেখলো পুরো গ্রাম জনশূন্য, গ্রামের স্কুলঘরকে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্প বানিয়েছে। দেরি না করে একাই আক্রমণ করে মিলিটারি ক্যাম্প। দু'একজন পালিয়ে বাচঁলেও অধিকাংশই শফিকের গুলিতে প্রাণ হারায়। 

৩। উদ্দীপকের শফিক এর কাজ কারবালা-প্রান্তর’ রচনার কোন চরিত্রের কাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?
ক. এজিদ
খ. আবদুর রহমান 
গ. সীমার
ঘ. ইমাম হোসেন 

৪. উক্ত সাদৃশ্যের কারণ-
i. বীরত্ব 
ii. দেশপ্রেম
iii. স্বাজাত্যবোধ 

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i. ও ii
খ. ii ও iii 
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii 

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
১.নিচের উদ্দীপকটি পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দাও।
উদ্দীপক-১
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর অল্প বয়সেই মধ্য এশিয়ার সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভারতের ইব্রাহীম লােদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। আবার মেবারের রাজা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

উদ্দীপক-২
বাবরের ভারত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে পারেনি রাজপুতগণ। তাই তরুণ বীর রণবীর চৌহান বাবরকে হত্যার উদ্দেশ্যে দিল্লির পথে পথে ঘুরতে থাকে; ঘটনাক্রমে পেয়েও যায়। বাবরের এক মহত্ত্বের ঘটনায় চৌহান মুগ্ধ হয় এবং অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি প্রার্থনা করে। সমস্ত ঘটনা জেনে বাবর তাকে বুকে টেনে নেন এবং দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন।
ক. ইমাম হোসেনকে অস্ত্রহীন দেখে কে অনবরত অশ্রু বিসর্জন করেছিল?
খ. ‘ইহজীবনেও আর পানি পান করিব না’- ইমাম হোসেনের এই প্রতিজ্ঞার কারণ বুঝিয়ে লেখ।
গ. উদ্দীপক-২ অংশে ইমাম হোসেন চরিত্রের যে বিশেষ দিকটির প্রতিফলন লক্ষণীয় তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. ‘প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও সম্রাট বাবর ও ইমাম হোসেন যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম'- মন্তব্যের সপক্ষে যুক্তি দাও।
Share:

বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন -বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

[লেখক-পরিচিতিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষায় প্রথম শিল্পসম্মত উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব তাঁরই। তার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। ১৮৫৮ খিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রথম স্নাতকদের মধ্যে তিনি একজন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। এ চাকরিসূত্রে খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করে তিনি নীলকরদের অত্যাচার দমন করেছিলেন। দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান; যোগ্য বিচারক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। বাংলা সাহিত্যচর্চায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনার বাইরে “বঙ্গদর্শন" (১৮৭২) পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ তাঁর অন্যতম কীর্তি।

১৮৫২ শ্রিষ্টাব্দে “সম্বাদ প্রভাকর' পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তার সাহিত্যচর্চার শুরু। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। তার রচিত প্রথম উপন্যাস 'দুর্গেশনন্দিনী”। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো : “কপালকুন্ডলা', “মৃণালিনী', “বিষবৃক্ষ', “কৃষ্ণকান্তের উইল", “চন্দ্রশেখর', 'আনন্দমঠ', “দেবী চৌধুরাণী', 'রাজসিংহ', "সীতারাম" "Rajmohons Wife” নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও তিনি রচনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা ও সমাজবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। “লোকরহস্য", “বিজ্ঞানরহস্য', “কমলাকান্তের দপ্তর", “সাম্য', “কৃষ্ণ চরিত্র", “বিবিধ প্রবন্ধ' ইত্যাদি তাঁর গদ্যগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি “সাহিত্যসম্রাট' উপাধিতে ভূষিত হন। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন
১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।

২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে এবং টাকাও পায়; লেখাও ভালো হয়। কিন্ত আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।

৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তীহাদিঘকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

৪। যাহা অসত্য, ধর্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্থার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য। সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ১ম পত্র একাদশ - দ্বাদশ শ্রেণি
লেখকঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৫। যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।

৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্তব্য। এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।

বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন -বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় Banglar Nobbo Lekhok Bankim Chandra Chattopadhyay
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন ভিডিও লিংকঃ

৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর এবং রচনার পরিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান কোটেশন বড় বেশি দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধত করিবেন না।

৮। অলংকার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে- ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলংকার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মতো কদর্য আর কিছুই নাই।

৯। যে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্ত আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভালো না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভালো লাগিবে না-বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে।

১০। সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেন না লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝানো।

১১। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।

১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি সংযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।

১৩। বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা। এই নিয়মগুলি বাঙ্গালার লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।


শব্দার্থ ও টীকাঃ
যশ - সুখ্যাতি, সুনাম, কীর্তি।
লোকরঞ্জন - জনসাধারণের মনোরপ্ন বা সন্তোষবিধান।
ধর্মবিরুদ্ধ - নীতি-নৈতিকতার বিরোধী।
কোটেশন - উদ্ধৃতি। অন্যের লেখা থেকে বক্তব্য উদ্ধার করে অপর লেখায় ব্যবহার।
অলংকার - ভূষণ, প্রসাধন, শোভা। ভাষার মাধুর্য ও উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে এমন গুণ।
ব্যঙ্গ - পরিহাস, বিদ্রুপ |
কদাপি - কখনও, কোনোকালে।
বাঙ্গালা - বাংলা। উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের কালে “বাংলা'কে “বাঙ্গালা' বলে লেখা হতো। শব্দটির পরিবর্তন হয়েছে এভাবে: বাঙ্গালা-বাঙলা-বাংলা।

পাঠ-পরিচিতিঃ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকীয় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে পরিচিত। ''বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন” রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'প্রচার' পত্রিকায়, ১৮৮৫ সালে; পরে এটি তাঁর “বিবিধ প্রবন্ধ” নামক গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হয়। সাধু রীতিতে লেখা এই প্রবন্ধটি আকারে ছোট হলেও চিন্তার মৌলিকত্বে অসাধারণ। বক্তব্যের তাৎপর্য বিচার করলে প্রবন্ধটির রয়েছে সর্বকালীন বৈশ্বিক আবেদন। নতুন লেখকদের প্রতি তিনি যে পরামর্শ এখানে উপস্থাপন করেছেন তার প্রতিটি বক্তব্যই পালনযোগ্য। খ্যাতি বা অর্থের উদ্দেশ্যে লেখা নয়; লিখতে হবে মানুষের কল্যাণ সাধন কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, অসত্য, নীতি-নৈতিকতা বিরোধী কিংবা পরনিন্দার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা স্বার্থতাড়িত লেখা পরিহার করা বাঞ্চনীয়। তিনি বলতে চান, নতুন লেখকরা কিছু লিখে তাৎক্ষণিকভাবে না ছাপিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে পুনরায় পাঠ করলে লেখাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে যার যে বিষয়ে অধিকার নেই সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করা যেমন অনুচিত তেমনি লেখায় বিদ্যা জাহির করার প্রবণতাকেও তিনি নিন্দনীয় বলে মনে করেছেন। অনুকরণবৃত্তিকেও দৃষণীয় বলেছেন। অনাবশ্যকভাবে লেখার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি বা পরিহাস করার চেষ্টাও তাঁর কাছে কাম্য নয়। সারল্যকেই তিনি সকল অলংকারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অলংকার বলে মনে করেছেন। সর্বোপরি বস্তুনিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এভাবে এই ছোট লেখাটিতে তিনি লেখকের আদর্শ কী হওয়া উচিত তা অত্যাবশ্যকীয় শব্দ প্রয়োগে উপস্থাপন করেছেন। নবীন লেখকরা বঙ্কিমচন্দ্রের পরামর্শ মান্য করলে লেখক ও পাঠক সমাজ নিশ্চিতভাবে উপকৃত হবেন; আমাদের মননশীল ও সৃজনশীল জগৎ সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবে।

বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। লেখকের 'লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি' গ্রবল হয়ে ওঠে কী কারণে?
ক. পাঠকের রুচি বিবেচনায় আনলে 
খ. অর্থলাভের আশায় লিখলে
গ. সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলে 
ঘ. বিদ্যা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকলে

২। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় “লেখা” বিলম্বে ছাপাতে বলেছেন কেন?
ক. উপযুক্ত প্রমাণ সংযোজনের সুবিধার্থে 
খ. পাঠকের মনে চাহিদার উদ্রেক করতে
গ. লেখার ভুল-ত্রুটি সংশোধন করতে 
ঘ. মনুষ্যজাতির মঙ্গল সাধন করতে

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নশ্বর প্রশ্নের উত্তর দাও।
“আপনারে যে ভেঙ্গেচুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাকি, মেকি সে জন, নামটা তার কদিন বাঁচে।”

৩। কবিতাংশের ভাব “বাঙ্গালার নব্য লেখকদিথের প্রতি নিবেদন' প্রবন্ধের লেখকের যে নিবেদনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তা হলো-
i. পরানুকরণে নিরুৎসাহিত
ii. অন্য লেখকদের অনুকৃতি
iii. স্বকীয়তায় সচেষ্ট থাকা

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii

৪। উক্ত নিবেদন রক্ষিত হলে নিচের কোনটি ঘটতো বলে প্রবন্ধিক মনে করেন?
ক. লেখক স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সমুজ্দবীল হতেন 
খ. বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতো
গ. অলংকার প্রয়োগ যথার্থ হতো 
ঘ. রচনার পরিপা্য বজায় থাকতো

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, হতাশা ও হাহাকারে উপমহাদেশের জীবন ছিল নানা অভিঘাতে বিপর্যস্ত ও বূপাত্তরিত। এমনই এক পরিবেশে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় বিনির্মাণ করলেন শাশ্বত কল্যাণ ও সাম্যবাদের মহাকাব্যিক এক আশাবাদী জগৎ। তিনি কলম তুলে নিলেন শোধণ-বঞ্চনাহীন, শ্রেণিবৈষম্যহীন, ক্ষউধা-দারিদ্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক এক জগৎ সৃষ্টি করতে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাম্যের গান গাইলেন। এক সময় তিনি হয়ে উঠলেন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-গোত্র নির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের কলমসৈনিক৷ শোষণ, বঞ্চনা ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ আজও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে বারংবার।

ক. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী? ১
খ. অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ- বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন? ২
গ. উদ্দীপকের কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনা “বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন'' প্রবন্ধের কোন বৈশিষ্ট্যটির প্রতিফলন ঘটায় ব্যাখ্যা কর। ৩
ঘ. বাংলার নতুন লেখকদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিবেদন উদ্দীপকে যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়েছে কি? উদ্দীপক ও প্রবন্ধের আলোকে তোমার মতামত দাও। ৪

Share:

বাংলা গল্প 'আত্মচরিত' -ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

[লেখক-পরিচিতিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তীর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী। তার বংশ পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর তাঁর উপাধি। ঈশ্বরচন্দ্র নিজ গ্রামে পাঠশালার পাঠ শেষে আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। সেখানে শিবচরণ মল্লিকের বাড়ির পাঠশালায় এক বছর অধ্যয়ন সম্পন্ন করে তিনি ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে নিরবচ্ছিন্ন বারো বছর অধ্যয়ন করে তিনি ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

সকল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে লাভ করেন 'বিদ্যাসাগর" উপাধি। তিনি ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগে হেড পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে সরকার কর্তৃক বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক নিযুক্ত হলে তারই তত্ত্বাবধানে কুড়িটি মডেল স্কুল ও পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। নিজ অর্থ ব্যয়ে মেট্রোপলিটন কলেজ (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) স্থাপন তাঁর অনন্য কীর্তি।

গল্পঃ
আত্মচরিত
ঈশ্বরচন্দ্রই প্রথম গদ্যে যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করে বাংলা গদ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করেন তাকে বলা হয় বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী। শিক্ষকতা ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান তুলনারহিত। সমাজে বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার প্রচলনে এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে পঞ্চবিংশতি'। এছাড়া “সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা”, “বর্ণ পরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ)”, "শকুন্তলা", “সীতার বনবাস", "আখ্যানমঞ্জুরী", ভ্রান্তিবিলাস" তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।]

বীরসিংহ গ্রামে আমার জন্ম হয়। আমি জনক জননীর প্রথম সন্তান। বীরসিংহের আধ ক্রোশ অন্তরে, কোমরগঞ্জ নামে এক গ্রাম আছে; এ গ্রামে, মঙ্গলবারে ও শনিবারে, মধ্যাহৃসময়ে হাট বসিয়া থাকে। আমার জন্মসময়ে পিতৃদেব বাটীঁতে ছিলেন না; কোমরণঞ্জে হাট করিতে গিয়াছিলেন। পিতামহদেব তাঁহাকে আমার জন্মসংবাদ দিতে যাইতেছিলেন; পথিমধ্যে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে, বলিলেন, “একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে” এই সময়ে, আমাদের বাটীতে, একটি গাই গর্ভিণী ছিল; তাহারও আজ কাল, প্রসব হইবার সম্ভাবনা।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

এজন্য, পিতামহদেবের কথা শুনিয়া, পিতৃদেব মনে করিলেন, গাইটি প্রসব হইয়াছে। উভয়ে বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পিতৃদেব, এঁড়ে বাছুর দেখিবার জন্য, গোয়ালের দিকে চলিলেন। তখন পিতামহদেব হাস্যমুখে বলিলেন, “ও দিকে নয়, এ দিকে এস; আমি তোমায় এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া, সৃতিকাগৃহে লইয়া গিয়া, তিনি এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিলেন।
আত্মচরিত - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ১ম পত্র একাদশ - দ্বাদশ শ্রেণি
লেখকঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
এই অকিঞ্চিৎকর কথার উল্লেখের তাৎপর্য এই যে, আমি বাল্যকালে, মধ্যে মধ্যে, অতিশয় অবাধ্য হইতাম। প্রহার ও তিরস্কার দ্বারা, পিতৃদেব আমার অবাধ্যতা দূর করিতে পারিতেন না। ঐ সময়ে, তিনি, সন্নিহিত ব্যক্তিদের নিকট, পিতামহদেবের পূর্বোক্ত পরিহাসবাক্যের উল্লেখ করিয়া, বলিতেন, "ইনি সেই এঁড়ে বাচুর; বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন, বটে; কিন্তু, তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন; তাহার পরিহাসবাক্যও বিফল হইবার নহে; বাবাজি আমার, ক্রমে, এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন |”...

পিতৃদেব ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম যখন ১৪/১৫ বৎসর, তখন তিনি মাতৃদেবীর অনুমতি লইয়া, উপার্জনের চেষ্টায়, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন। ঠাকুরদাস, প্রথমত বনমালিপুরে, তৎপরে বীরসিংহে, সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ পড়িয়াছিলেন। কিন্তু, যে উদ্দেশে তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, সংস্কৃতপাঠে নিযুক্ত হইলে, তাহা সম্পন্ন হয় না।...

যাহা হউক, অনেক বিবেচনার পর, অবশেষে ইহাই অবধারিত হইল, যাহাতে তিনি শীঘ্র উপার্জনক্ষম হন, সেরূপ পড়াশুনা করাই কর্তব্য।

এই সময়ে, মোটামুটি ইংরেজি জানিলে, সওদাগর সাহেবদিগের হৌসে, অনায়াসে কর্ম হইত। এজন্য, সংস্কৃত না পড়িয়া, ইংরেজি পড়াই, তাঁহার পক্ষে, পরামর্শসিদ্ধ স্থির হইল। কিন্তু, সে সময়ে, ইংরেজি পড়া সহজ ব্যাপার ছিল না। তখন, এখনকার মত, প্রতি পল্লিতে ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল না। তাদৃশ বিদ্যালয় থাকিলেও, তাহার ন্যায় নিরুপায় দীন বালকের তথায় অধ্যয়নের সুবিধা ঘটিত না।

যাহা হউক, একই ব্যক্তির আশ্রয়ে আসিয়া, ঠাকুরদাসের, নির্বিগ্নে, দুই বেলা আহার ও ইংরেজি পড়া চলিতে লাগিল। কিছুদিন পরে, ঠাকুরদাসের দুর্ভাগ্যক্রমে, তদীয় আশ্রয়দাতার আয় বিলক্ষণ খর্ব হইয়া গেল; সুতরাং, তাহার নিজের ও তাহার আশ্রিত ঠাকুরদাসের, অতিশয় কৃষ্ট উপস্থিত হইল।...

এক দিন, মধ্যাহৃসময়ে, ক্ষুধায় অস্থির হইয়া, ঠাকুরদাস বাসা হইতে বহির্গত হইলেন, এবং অন্যমনস্ক হইয়া, ক্ষুধার যাতনা ভুলিবার অভিপ্রায়ে, পথে পথে ভ্রমণ করিতে লাখিলেন। কিঞ্চিৎ পরেই, তিনি এক দোকানের সম্মুখে উপস্থিত ও দণ্ডায়মান হইলেন; দেখিলেন, এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী এ দোকানে বসিয়া মুড়ি মুড়কি বেচিতেছেন।...

ঠাকুরদাস, তৃষ্ণার উল্লেখ করিয়া, পানার্থে জল প্রার্থনা করিলেন। তিনি, সাদর ও সস্নেহ বাক্যে, ঠাকুরদাসকে বসিতে বলিলেন, এবং ব্রাহ্মণের ছেলেকে শুধু জল দেওয়া অবিধেয়, এই বিবেচনা করিয়া, কিছু মুড়কি ও জল দিলেন; ঠাকুরদাস, যেরূপ ব্যগ্র হইয়া, মুড়কিগুলি খাইলেন, তাহা এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া, ঐ স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, বাপাঠাকুর, আজ বুঝি তোমার খাওয়া হয় নাই?

তিনি বলিলেন, না, মা আজ আমি এখন পর্যন্ত, কিছুই খাই নাই। তখন সেই স্ত্রীলোক ঠাকুরদাসকে বলিলেন, বাপাঠাকুর, জল খাইও না, একটু অপেক্ষা কর এই বলিয়া, নিকটবর্তী গোয়ালার দোকান হইতে, সত্বর দই কিনিয়া আনিলেন, এবং আরও মুড়কি দিয়া, ঠাকুরদাসকে পেট ভরিয়া ফলার করাইলেন; পরে, তাঁহার মুখে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, জিদ করিয়া বলিয়া দিলেন, যে দিন তোমার এরূপ ঘটিবেক, এখানে আসিয়া ফলার করিয়া যাইবে।

পিতৃদেবের মুখে এই হৃদয়বিদারণ উপাখ্যান শুনিয়া, আমার অন্তঃকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির উপর তেমনই প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল।

কিছু দিন পরে, ঠাকুরদাস, আশ্রয়দাতার সহায়তায়, মাসিক দুই টাকা বেতনে কোনও স্থানে নিযুক্ত হইলেন। এই কর্ম পাইয়া, তাঁহার আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। পূর্ব আশ্রয়দাতার আশ্রয়ে থাকিয়া, আহারের ক্লেশ সহ্য করিয়াও বেতনের দুইটি টাকা, যথানিয়মে, জননীর নিকট পাঠাইতে লাগিলেন।

দুই-তিন বৎসর পরেই, ঠাকুরদাস মাসিক পাচ টাকা বেতন পাইতে লাগিলেন। তখন তাঁহার জননীর ও ভাইভগিনীগুলির, অপেক্ষাকৃত অনেক অংশে, কষ্ট দূর হইল।

এই সময়ে, ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম তেইশ-চব্বিশ বৎসর হইয়াছিল। অতঃপর তাঁহার বিবাহ দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, তর্কভুষণ মহাশয় গোঘাটনিবাসী তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতীদেবীর সহিত, তাহার বিবাহ দিলেন। এই ভগবতীদেবীর গর্ভে আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি।

আমার যখন জ্ঞানোদয় হইয়াছে, মাতৃদেবী, পুত্রকন্যা লইয়া, মাতুলালয়ে যাইতেন, এবং এক যাত্রায়, ক্রমান্বয়ে, পাচ-ছয় মাস বাস করিতেন কিন্তু একদিনের জন্যেও, স্নেহ, যত্ন ও সমাদরের ত্রুটি হইত না। বস্তুত, ভাগিনেয়ী ও ভাগিনেয়ীর পুত্রকন্যাদের উপর এরুপ স্নেহপ্রদর্শন অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার। জ্যেষ্ঠা ভাগিনেয়ীর মৃত্যু হইলে, তদীয় একবর্ষীয় দ্বিতীয় সন্তান, বিংশতি বৎসর বয়স পর্যন্ত, আদ্যন্ত অবিচলিতস্নেহে, প্রতিপালিত হইয়াছিলেন।

আমি পঞ্চমবর্ষীয় হইলাম। বীরসিংহে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা ছিল।। গ্রামস্থ বালকগণ ঐ পাঠশালায় বিদ্যাভ্যাস করিত। আমি তাঁহার পাঠশালায় প্রেরিত হইলাম। চট্টোপাধ্যায় মহাশয় সাতিশয় পরিশ্রমী এবং শিক্ষাদানবিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ ও সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। ইহার পাঠশালার ছাত্রেরা, অল্প সময়ে উত্তমরূপ শিক্ষা করিতে পারিত, এজন্য, ইনি উপযুক্ত শিক্ষক বলিয়া, বিলক্ষণ প্রতিপত্তিলাভ করিয়াছিলেন।...

পাঠশালায় এক বৎসর শিক্ষার পর আমি ভয়ঙ্কর জ্বররোগে আক্রান্ত হইয়াছিলাম। আমি এ যাত্রা রক্ষা পাইব, প্রথমত এরূপ আশা ছিল না। কিছু দিনের পর, প্রাণনাশের আশঙ্কা নিরাকৃত হইল; একবারে বিজ্বর হইলাম না। অধিক দিন জ্বরভোগ করিতে করিতে, প্লীহার সঞ্চার হইল। জ্বর ও প্লীহা উভয় সমবেত হওয়াতে শীঘ্র আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা রহিল না। ছয় মাস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু, রোগের নিবৃত্তি না হইয়া, উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই হইতে লাগিল।

জননীদেবীর জ্যেষ্ঠ মাতুল, রাধামোহন বিদ্যাভূষণ আমার পীড়াবৃদ্ধির সংবাদ পাইয়া বীরসিংহে উপস্থিত হইলেন এবং দেখিয়া শুনিয়া সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া আমাকে আপন আলয়ে লইয়া গেলেন। মাতুলের সন্নিকটে কোটরীনামে যে গ্রাম আছে, তথায় বৈদ্যজাতীয় উত্তম উত্তম চিকিৎসক ছিলেন; তাহাদের অন্যতমের হস্তে আমার চিকিৎসার ভার অর্পিত হইল। তিন মাস চিকিৎসার পর, সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করিলাম। এই সময়ে, আমার উপর, বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের ও তদীয় পরিবারবর্গের স্নেহ ও যত্নের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হইয়াছিল।

কিছু দিন পরে বীরসিংহে প্রতিপ্রেরিত হইলাম এবং পুনরায় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় পাঠশালায় প্রবিষ্ট হইয়া, আট বৎসর বয়স পর্যন্ত তথায় শিক্ষা করিলাম। আমি গুরুমহাশয়ের প্রিয়শিষ্য ছিলাম। আমার বিলক্ষণ স্মরণ হইতেছে, পাঠশালার সকল ছাত্র অপেক্ষা, আমার উপর তাহার অধিকতর স্নেহ ছিল। আমি তাহাকে অতিশয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতাম।...

পিতামহদেব, রামজয় তর্কভূবণ, অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করিলেন। তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনও অংশে, কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে অথবা কোনও প্রকারে অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পারিতেন না। তিনি, সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন, অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন, তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের অস্পূর্ণ বিপরীত ছিল। উপকার-প্রত্যাশায়, অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি কখনও পরের উপাসনা বা আনুগত্য করিতে পারেন নাই। তাঁহার স্থির সিদ্ধান্ত ছিল, অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য করা অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা ভালো। তিনি নিতান্ত নিস্পৃহ ছিলেন, এজন্য, অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য, তাঁহার পক্ষে, কস্মিন কালেও আবশ্যক হয় নাই।

তর্কভূষণ মহাশয় নিরতিশয় অমায়িক ও নিরহঙ্কার ছিলেন। কি ছোট, কি বড়, সর্ববিধ লোকের সহিত, সমভাবে সদয় ও সাদর ব্যবহার করিতেন। তিনি যাঁহাদিগকে কপটবাচী মনে করিতেন, তাহাদের সহিত সাধ্যপক্ষে আলাপ করিতেন না। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন, কেহ রুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইবেন, ইহা ভাবিয়া, স্পষ্ট কথা বলিতে ভীত বা সঙ্কুচিত হইতেন না। তিনি যেমন স্পষ্টবাদী, তেমনই যথার্থবাদী ছিলেন। কাহারও ভয়ে, বা অনুরোধে, অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি, কখনও কোনও বিষয়ে অযথা নির্দেশ করেন নাই। তিনি যাঁহাদিগকে আচরণে ভদ্র তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিয়া গণ্য করিতেন; আর যাঁহাদিগকে আচরণে অভদ্র দেখিতেন, বিদ্বান, ধনবান ও ক্ষমতাপন্ন হইলেও, তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিয়া জ্ঞান করিতেন না।

তর্কভূষণ মহাশয় অতিশয় বলবান, নিরতিশয় সাহসী, এবং সর্বতোভাবে অকুতোভয় পুরুষ ছিলেন। এক লৌহদন্ড তাঁহার চিরসহচর ছিল; উহা হস্তে না করিয়া তিনি কখনও বাটীর বাহির হইতেন না। তৎকালে পথে অতিশয় দস্যুভয় ছিল। স্থানান্তরে যাইতে হইলে, অতিশয় সাবধান হইতে হইত। অনেক স্থলে, কি প্রত্যুষে, কি মধ্যাহ্নে, কি সায়াহ্নে, অল্পসংখ্যক লোকের প্রাণনাশ অবধারিত ছিল। এজন্য, অনেকে সমবেত না হইয়া, এ সকল স্থল দিয়া যাতায়াত করিতে পারিতেন না। কিন্তু তর্কভুষণ মহাশয়, অসাধারণ বল, সাহস ও চিরসহচর লৌহদণ্ডের সহায়তায় সকল সময়ে এ সকল স্থল দিয়া একাকী নির্ভয়ে যাতায়াত করিতেন। দস্যুরা দুই-চারি বার আক্রমণ করিয়াছিল। কিন্তু উপযুক্তরূপ আক্কেলসেলামি পাইয়া, আর তাহাদের তাহাকে আক্রমণ করিতে সাহস হইত না। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, বন্য হিংস্র জন্তুকেও তিনি ভয়ানক জ্ঞান করিতেন না।

পিতামহদেবের দেহাত্যয়ের পর পিতৃদেব আমায় কলিকাতায় আনা স্থির করিলেন। তদনুসারে, ১২৩৫ সালের কার্তিক মাসের শেষভাগে, আমি কলিকাতায় আনীত হইলাম ... বড়বাজারনিবাসী ভাগবতচরণ সিংহ পিতৃদেবকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তদবধি তিনি তদীয় আবাসেই অবস্থিতি করিতেছিলেন। যে সময়ে আমি কলিকাতায় আনীত হইলাম, তাহার অনেক পূর্বে সিংহ মহাশয়ের দেহাত্যয় ঘটিয়াছিল। এক্ষণে তদীয় একমাত্র পুত্র জগদ্দুর্লভ সিংহ সংসারের কর্তা। এই সময়ে জগদ্দুর্লভবাবুর বয়ঃক্রম পঁচিশ বৎসর | গৃহিণী, জ্যেষ্ঠা ভগিনী, তাহার স্বামী ও দুই পুত্র, এক বিধবা কনিষ্ঠা ভগিনী ও তাহার এক পুত্র, এইমাত্র তাহার পরিবার। জগদ্দুর্লভবাবুর  পিতৃদেবকে পিতৃব্যশব্দেসম্ভাষণ করিতেন; সুতরাং আমি তাহার ও তাহার ভগিনীদিগের ভ্রাতৃস্থানীয় হইলাম। তাঁহাকে দাদা মহাশয়, তাঁহার ভগিনীদিগকে, বড় দিদি ও ছোট দিদি বলিয়া সম্ভাষণ করিতাম।

এই পরিবারের মধ্যে অবস্থিত হইয়া পরের বাটীতে আছি বলিয়া, এক দিনের জন্যেও আমার মনে হইত না। সকলেই যথেষ্ট স্লেহ করিতেন। কিন্তু কনিষ্ঠা ভগিনী রাইমণির অদ্ভুত স্নেহ ও যত্ন, আমি, কস্মিন কালেও বিস্মৃত হইতে পারিব না। তাঁহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ব থাকা উচিত ও আবশ্যক, গোপালচন্দ্রের উপর রাইমণির শ্রেহ ও যত্ন তদপেক্ষা অধিকতর ছিল, তাহার সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমার ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নভাব ছিল না।

ফলকথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াময়ীর সৌম্যমূর্তি, আমার হৃদয়মন্দিরে, দেবীমূর্তির ন্যায়, প্রতিষ্ঠিত হইয়া, বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে, তাহার কথা উত্থাপিত হইলে, তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্তন করিতে করিতে, অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং এ সমস্ত সদগুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমন্ডলে নাই।

আমি পিতামহীদেবীর একান্ত প্রিয় ও নিতান্ত অনুগত ছিলাম। কলিকাতায় আসিয়া, প্রথমত কিছু দিন, তাহার জন্য, যার পর নাই, উৎকন্ঠিত হইয়াছিলাম। সময়ে সময়ে, তাহাকে মনে করিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম। কিন্তু দয়াময়ী রাইমণির স্নেহ ও যত্নে আমার সেই বিষম উৎকন্ঠা ও উৎকট অসুখের অনেক অংশে নিবারণ হইয়াছিল।

এই সময়ে, পিতৃদেব, মাসিক দশ টাকা বেতনে, জোড়াসাঁকোনিবাসী রামসুন্দর মল্লিকের নিকট নিযুক্ত ছিলেন। বড়বাজারের চকে মল্লিক মহাশয়ের এক দোকান ছিল। এ দোকানে লোহা ও পিতলের নানাবিধ বিলাতি জিনিস বিক্রি হইত। যে সকল খরিদ্দার ধারে জিনিস কিনিতেন, তাহাদের নিকট হইতে পিতৃদেবকে টাকা আদায় করিয়া আনিতে হইত। প্রতিদিন, প্রাতে এক প্রহরের সময় কর্মস্থানে যাইতেন; রাত্রি এক প্রহরের সময় বাসায় আসিতেন। এ অবস্থায় অন্যত্র বাসা হইলে, আমার মত পল্লিগ্রামের অষ্টমবর্ষীয় বালকের পক্ষে, কলিকাতায় থাকা কোনও মতে চলিতে পারিত না।

গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় যতদূর শিক্ষা দিবার প্রণালী ছিল, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ও স্বরূপচন্দ্র দাসের নিকট আমার সে পর্যন্ত শিক্ষা হইয়াছিল। অতঃপর কিরূপ শিক্ষা দেওয়া উচিত, এ বিষয়ে পিতৃদেবের আত্মীয়বর্গ, স্ব স্ব ইচ্ছার অনুযায়ী পরামর্শ দিতে লাগিলেন। শিক্ষাবিষয়ে আমার কিরূপ ক্ষমতা আছে, এ বিষয়ের আলোচনা হইতে লাগিল। সেই সময়ে, প্রসঙ্গক্রমে, পিতৃদেব মাইলস্টোনের উপাখ্যান বলিলেন। সে উপাখ্যান এই-

প্রথমবার কলিকাতায় আসিবার সময়, সিয়াখালায় সালিখার বাঁধা রাস্তায় উঠিয়া, বাটনাবাটা শিলের মতো একখানি প্রস্তর রাস্তার ধারে পোঁতা দেখিতে পাইলাম। কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া, পিতৃদেবকে জিজ্ঞাসিলাম, বাবা, রাস্তার ধারে শিল পোঁতা আছে কেন। তিনি, আমার জিজ্ঞাসা শুনিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন, ও শিল নয়, উহার নাম মাইলস্টোন। আমি বলিলাম, বাবা, মাইলস্টোন কী, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। তখন তিনি বলিলেন, এটি ইংরেজি কথা, মাইল শব্দের অর্থ আধ ক্রোশ; স্টোন শব্দের অর্থ পাথর; এই রাস্তার আধ আধ ক্রোশ অন্তরে, এক একটি পাথর পোঁতা আছে; উহাতে এক, দুই, তিন প্রভৃতি অঙ্ক খোদাই করা রহিয়াছে। এই পাথরের অঙ্ক উনিশ; ইহা দেখিলেই লোকে বুঝিতে পারে এখান হইতে কলিকাতা উনিশ মাইল অর্থাৎ, সাড়ে নয় ক্রোশ। এই বলিয়া, তিনি আমাকে ঐ পাথরের নিকট লইয়া গেলেন।

নামতায় 'একের পিঠে নয় উনিশ' ইহা শিথিয়াছিলাম | দেখিবামাত্র আমি প্রথমে এক অঙ্কের, তৎপরে নয় অঙ্কের উপর হাত দিয়া বলিলাম, তবে এটি ইংরেজির এক আর এইটি ইংরেজির নয়। অনন্তর বলিলাম, তবে বাবা, ইহার পর যে পাথরটি আছে, তাহাতে আঠার, তাহার পরটিতে সতর, এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক পর্যন্ত অঙ্ক দেখিতে পাইব। তিনি বলিলেন, আজ দুই পর্যন্ত অঙ্ক দেখিতে পাইবে, প্রথম মাইলস্টোন যেখানে পোঁতা আছে, আমরা সে দিক দিয়া যাইব না। যদি দেখিতে চাও, একদিন দেখাইয়া দিব। আমি বলিলাম, সেটি দেখিবার আর দরকার নাই; এক অঙ্ক এইটিতেই দেখিতে পাইয়াছি। বাবা, আজ পথে যাইতে যাইতেই আমি ইংরেজির অঙ্কগুলি চিনিয়া ফেলিব।

এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, প্রথম মাইলস্টোনের নিকটে গিয়া, আমি অস্কগুলি দেখিতে ও চিনিতে আরম্ভ করিলাম। মনবেড় চটিতে দশম মাইলস্টোন দেখিয়া পিতৃদেবকে সম্ভাষণ করিয়া বলিলাম, বাবা, আমার ইংরেজি অঙ্ক চিনা হইল পিতৃদেব বলিলেন, কেমন চিনিয়াছ, তাহার পরীক্ষা করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি নবম, অষ্টম, সপ্তম, এই তিনটি মাইলস্টোন ক্রমে ক্রমে দেখাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, আমি এটি নয়, এটি আট, এটি সাত, এইরূপে

বলিলাম। পিতৃদেব ভাবিলেন, আমি যথার্থই অঙ্কগুলি চিনিয়াছি, অথবা নয়ের পর আট, আটের পর সাত অবধারিত আছে, ইহা জানিয়া, চালাকি করিয়া নয়, আট, সাত বলেতেছি। যাহা হউক, ইহার পরীক্ষা করিবার নিমিস্ত, কৌশল করিয়া তিনি আমাকে ষষ্ঠ মাইলস্টোনটি দেখিতে দিলেন না; অনন্তর, পঞ্চম মাইলস্টোনটি দেখাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এটি কোন মাইলস্টোন, বল দেখি। আমি দেখিয়া বলিলাম, বাবা, এই মাইলস্টোনটি খুদিতে ভুল হইয়াছে; এটি ছয় হইবেক, না হইয়া পাঁচ খুদিয়াছে।

এই কথা শুনিয়া পিতৃদেব ও তাহার সমভিব্যাহারীরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন, ইহা তাহাদের মুখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। বীরসিংহের গুরুমহাশয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ও এ সমভিব্যাহারে ছিলেন৷ তিনি আমার চিবুকে ধরিয়া “বেস বাবা বেস" এই কথা বলিয়া, অনেক আশীর্বাদ করিলেন এবং পিতৃদেবকে সম্বোধিয়া বলিলেন, দাদা মহাশয়, আপনি ঈশ্বরের লেখাপড়া বিষয়ে যত্ন করিবেন। যদি বাঁচিয়া থাকে, মানুষ হইতে পারিবেক। যাহা হউক, আমার এই পরীক্ষা করিয়া, তাহারা সকলে যেমন আহ্লাদিত হইয়াছিলেন, তাহাদের আহ্লাদ দেখিয়া, আমিও তদনুরূপ আহ্লাদিত হইয়াছিলাম।

মাইল স্টোনের উপাখ্যান শুনিয়া, পিতৃদেবের পরামর্শদাতা আত্নীয়েরা একবাক্য হইয়া, "তবে ইহাকে রীতিমত ইংরেজি পড়ান উচিত" এই ব্যবস্থা স্থির করিয়া দিলেন। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে সিদ্ধেশ্বরীতলার ঠিক পূর্বদিকে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল। উহা হের সাহেবের স্কুল বলিয়া প্রসিদ্ধ ৷ পরামর্শদাতারা এ বিদ্যালয়ের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, উহাতে ছাত্রেরা বিনা বেতনে শিক্ষা পাইয়া থাকে এ স্থানে ইহাকে পড়িতে দাও; যদি ভালো শিখিতে পারে বিনা বেতনে হিন্দু কালেজে পড়িতে পাইবেক: হিন্দু কালেজে পড়িলে ইংরেজির চূড়ান্ত হইবেক। আর যদি তাহা না হইয়া উঠে, মোটামুটি শিখিতে পারিলেও, অনেক কাজ দেখিবেক, কারণ, মোটামুটি ইংরেজি জানিলে, হাতের লেখা ভালো হইলে ও যেমন তেমন জমাখরচ বোধ থাকিলে, সওদাগর সাহেবদিগের হৌসে ও সাহেবদের বড় বড় দোকানে অনায়াসে কর্ম করিতে পারিবেক।

আমরা পুরুষানুক্রমে সংস্কৃতব্যবসায়ী; পিতৃদেব অবস্থার বৈগুণ্যবশত ইচ্ছানুরূপ সংস্কৃত পড়িতে পারেন নাই; ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণে অতিশয় ক্ষোভ মন্মিয়াছিল। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমি রিতিমত সংস্কৃত শিখিয়া চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করিব। এজন্য পূর্বোক্ত পরামর্শ তাহার মনোনীত হইল না। তিনি বলিলেন, উপার্জনক্ষম হইয়া, আমার দুঃখ ঘুচাইবেক, আমি সে উদ্দেশ্যে ঈশ্বরকে কলিকাতায় আনি নাই। আমার একান্ত অভিলাষ, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতবিদ্য হইয়া দেশে চতুষ্পাঠী করিবেক, তাহা হইলেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইবেক। এই বলিয়া, তিনি আমার ইংরেজি স্কুলে প্রবেশ বিষয়ে, আন্তরিক অসম্মতি প্রদর্শন করিলেন। তাহারা অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন, তিনি কিছুতেই সম্মত হইলেন না।

মাতৃদেবীর মাতুল রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপুত্র মধুসূদন বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনি পিতৃদেবকে বলিলেন, আপনি ঈশ্বরকে সংস্কৃত কালেজে পড়িতে দেন, তাহা হইলে, আপনকার অভিপ্রেত সংস্কৃত শিক্ষা সম্পন্ন হইবেক; আর যদি চাকরি করা অভিপ্রেত হয়, তাহারও বিলক্ষণ সুবিধা আছে; সংস্কৃত কালেজে পড়িয়া, যাহারা ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাহারা আদালতে জজপন্ডিত্যের পদে নিযুক্ত হইয়া থাকে। অতএব, আমার বিবেচনায়, ঈশ্বরকে সংস্কৃত কালেজে পড়িতে দেওয়াই উচিত। চতুষ্পাঠী অপেক্ষা কালেজে রীতিমত সংস্কৃত শিক্ষা হইয়া থাকে। বাচস্পতি মহাশয় এই বিষয় বিলক্ষণ রূপে পিতৃদেবের হদয়লম করিয়া দিলেন। অনেক বিবেচনার পর, বাচস্পতি মহাশয়ের ব্যবস্থাই অবলম্বনীয় স্থির হইল।
[সংক্ষিপ্ত পাঠ]


শব্দার্থ ও টীকাঃ
ক্রোশ - দূরত্ব পরিমাপের একক। দুই মাইলের চেয়ে কিছু বেশি।
নিরাকৃত - নিরাকরণ। দূরীকরণ।
বিজ্বর - জ্বরমুক্ত।
অতিসার - উদরাময়। পেটের পীড়াবিশেষ।
অনুবর্তন - অনুসরণ। অনুগমন।
কপটবাচী - কপট বা মিথ্যা কথা বলে যে।
আক্কেলসেলামি - মূর্খতার জন্য প্রাপ্ত শাস্তি।
দেহাত্যয় - দেহত্যাগ। মৃত্যু |
সৌম্যমূর্তি - প্রসন্ন বা প্রশান্ত মূর্তি।
কৃতঘ্ন - উপকারীর অপকার করে যে।
পামর - পাপিষ্ঠ। নরাধম।
সমভিব্যাহারী - একত্রে অবস্থানকারী। সঙ্গী।
হৌস - সওদাগরি দপ্তর বা অফিস।

পাঠ-পরিচিতিঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীমূলক বর্ণনাধর্মী অসমাপ্ত রচনার নাম 'আত্মচরিত" সংকলিত অংশে তাঁর শৈশব জীবনের কথা বিধৃত হয়েছে। এ রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র তার পিতা, পিতামহ ও জননীর কথা বর্ণনা করেছেন। বিষয় অনুসারে গদ্যের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে তার সহজাত শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে বর্তমান রচনায়। কৌতুকবোধ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও মমতা এবং পাঠকের বোধগম্য করার অভিপ্রায়ে যথার্থ বিরামচিহ্ন ব্যবহার বর্তমান রচনার বিশিষ্ট প্রান্ত। ঈশ্বরচন্দ্র শৈশবকালে ছিলেন ডানপিটে। পাঁচ বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তাকে ভর্তি করা হয় এবং আট বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করেন। তার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের মৃত্যুর পর, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থোপার্জনের নিমিত্তে কলকাতায় পাড়ি জমান, তখন বালক ঈশ্বরচন্দ্রও পিতার হাত ধরে শহরে আসেন। কলকাতায় যাবার প্রাক্কালে, রাস্তার পাশে “বাটনাবাটা শিলের মতো" প্রস্তর বা মাইলস্টোন দেখে বালক ঈশ্বরচন্দ্র খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং তার পিতৃদেবের সহায়তায় পাথরের গায়ে খোদিত ইংরেজি অঙ্কগুলো অতি দ্রুত শিখে নেন। বালকের অভাবিত মেধাশক্তির পরিচয় পেয়ে তার পিতা ও অন্য সহগামীবৃন্দ বিস্ময়াভিভূত হন; তখন কেউ কেউ ঠাকুরদাসকে পরামর্শ দেন, ঈশ্বরচন্দ্রকে যেন ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়, কারণ ইংরেজি ভাষা ভালো জানা থাকলে “সাহেবদিগের হৌসে ও সাহেবদের বড় বড় দোকানে" কাজ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ঠাকুরদাস এসব পরামর্শ কানে নেননি।

বহুনির্বাচনি পশ্নঃ
১. “আত্মচরিত” রচনাটিতে কে স্পষ্টবাদী?
ক. কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় 
খ. রাধামোহন বিদ্যাভুষণ
গ. রামজয় তর্কভূষণ 
ঘ. ভাগবতচরণ সিংহ

২. কোন গুণের কারণে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে উপযুক্ত শিক্ষক বলা যায়?
ক. আগ্রহের জন্য 
খ. সদিচ্ছার জন্য
গ. যত্নশীলতার জন্য 
ঘ. প্রশিক্ষণের জন্য

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
মেঘনা গ্রামের অপু কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ী কাদের সাহেবের কাছে আশ্রয় নিলেন। গ্রামের স্কুলটি তেমন ভালো নয় বলে তিনি পুত্র উপলকে মালিকের বাসায় এনে রাখেন। মালিকের বোন রুমা অপত্য স্নেহ দিয়ে উপলকে দেখাশুনা করতে লাগলেন। উপল একাকিত্ব ও গ্রামের স্মৃতি ভুলে সেখানে দিনাতিপাত করতে লাগল। এই সান্নিধ্যের কারণে উপল নারীর প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।

৩. উদ্দীপকের রুমা "আত্মচরিত" রচনার কোন চরিত্রের সঙ্গে তুলনীয়?
ক. গৃহিণীর 
খ. জ্যেষ্ঠ ভগিনীর
গ. কনিষ্ঠা ভগিনীর 
ঘ. পিতামহীদেবীর

৪. উক্ত চরিত্রটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে-
i. জননীর স্নেহ
ii. দায়িত্ব বোধ
iii. মমত্ব

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii 
খ. ii ও iii
গ. iও iii 
ঘ. i, ii ও iii

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ:  বাংলা ১ম পত্র গাইড

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
বাকাল গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত দ্বিজেন্দ্রনাথ তার পুত্র দিনেশকে টোল অর্থাৎ সংস্কৃত পাঠশালায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রামবাসী তাকে বোঝালেন, এ শিক্ষা শেষে সব ধরনের চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করলে শিক্ষার দিগন্ত ও জ্ঞানার্জনের পথ বিস্তৃত হয় এবং চাকরির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত দিনেশকে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেন।
ক. বড় বাজারের চকে মল্লিক মহাশয়ের কিসের দোকান ছিল? ১
খ. ঈশ্বরচন্দ্রকে কেন ইংরেজি পড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তা ব্যাখ্যা কর। ২
গ. “দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার সাদৃশ্য আছে।"- ব্যাখ্যা কর। ৩
ঘ. “দিনেশ ও ঈশ্বরচন্দ্র একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন”-“আত্মচরিত" অবলম্বনে মূল্যায়ন কর। ৪

Share:

বাংলা গল্প 'আম আঁটির ভেঁপু' -বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

[লেখক-পরিচিতি: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালে ২৪ পরগনার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহানন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। স্থানীয় বনগ্রাম স্কুল থেকে ১৯১৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই.এ. এবং বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি তুগলী, কলকাতা ও ব্যারাকপুরের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শরন্দ্রের পরে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপনের অসাধারণ এক আলেখ্য নির্মাণ করে তিনি বাল্লা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনের অভিন্ন সম্পর্কের চিরায়ত তাৎপর্যে তাঁর কথাসাহিত্য মহিমামণ্ডিত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো: পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতি, দৃষ্টিপ্রদীপ। গল্পগ্রন্থ:মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল। ইছামতি উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।]

গল্পঃ
আম-আঁটির ভেঁপু
সকাল বেলা। আটটা কি নয়টা। হরিহরের পুত্র আপন মনে রোয়াকে বসিয়া খেলা করিতেছে, তাহার একটা ছোট টিনের বাক্স আছে, সেটার ডালা ভাঙা। বাক্সের সমুদয় সম্পত্তি সে উপুড় করিয়া মেঝেতে ঢালিয়াছে। একটা রং-ওঠা কাঠের ঘোড়া, চার পয়সা দামের একটা টো-খাওয়া টিনের ভেঁপু-বাঁশি, গোটাকতক কড়ি।

এগুলি সে মায়ের অজ্ঞাতসারে লক্ষ্মীপূজার কড়ির চুপড়ি হইতে খুলিয়া লইয়াছিল ও পাছে কেহ টের পায় এই ভয়ে সর্বদা লুকাইয়া রাখে- একটা দু'পয়সা দামের পিস্তল, কতকগুলো শুকনো নাটা ফল। দেখিতে ভালো বলিয়া তাহার দিদি কোথা হইতে অনেকগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল, কিছু তাহাকে দিয়াছে, কিছু নিজের পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে। খানকতক খাপরার কুচি।

গঙ্গা-যমুনা খেলিতে এই খাপরাগুলির লক্ষ্য অব্যর্থ বলিয়া বিশ্বাস হওয়ায় সে এগুলি সযত্নে বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে, এগুলি তাহার মহামূল্যবান সম্পত্তি এতগুলি জিনিসের মধ্যে সবে সে টিনের বাঁশিটা কয়েকবার বাজাইয়া সেটির সম্বন্ধে বিগত কৌতূহল হইয়া তাহাকে একপাশে রাখিয়া দিয়াছে। কাঠের ঘোড়া নাড়াচাড়া করা হইয়া গিয়াছে। সেটিও একপাশে পিজরাপোলের আসামির ন্যায় পড়িয়া আছে।

বর্তমানে সে গঙ্গা-যমুনা খেলিবার খাপরাগুলিকে হাতে লইয়া মনে মনে দাওয়ার উপর গঙ্গা-যমুনার ঘর আঁকা কল্পনা করিয়া চোখ বুজিয়া খাপরা ভূঁইয়া দেখিতেছে তাক ঠিক হইতেছে কি না! এমন সময়ে তাহার দিদি দুর্গা উঠানের কাঁঠালতলা হইতে ডাকিল-অপু- ও অপু। সে এতক্ষণ বাড়ি ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল। তাহার স্বর একটু সতর্কতা মিশ্রিত।

আম-আঁটির ভেঁপু - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ১ম নবম-দশম শ্রেণি
লেখকঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পুতুলের মতো লক্ষ্মীর চুপড়ির কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল। পরে বলিল- কি রে দিদি? দুর্গা হাত নাড়িয়া ডাকিল- আয় এদিকে- শোদুর্গার বয়স দশ-এগারো বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মতো অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা। হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ- বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন ও মন্দ নয়, অপুর মতো চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু রোয়াকহইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল,-কে রে?

দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা! সেটা সে নিচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা। সুর নিচু করিয়া বলিল- মা ঘাট থেকে আসে নি তো? অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল- উঁহুদুর্গা চুপিচুপি বলিল - একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুশি জারাবো - অপু আত্নদের সহিত বলিয়া উঠিল - কোথায় পেলি রে দিদি? দুর্গা বলিল-পটলিদের বাগানে সিঁদুরকৌটোর তলায় পড়ে ছিল – আন্ দিকি একটু নুন আর তেল। অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল - তেলের ভাড় ছুঁলে মা মারবে যে? আমার কাপড় যে বাসি? - তুই যা না শিগগিরি করে, মা’র আসতে এখন ঢের দেরি-ক্ষার কাচতে গিয়েচে শিগগির যাঅপু বলিল- নারকোলের মালাটা আমায় দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আসবো- তুই খিড়কি দোরে গিয়ে দ্যাখ মা আসছে কি না।

দুর্গা নিম্নস্বরে বলিল- তেলটেল যেন মেঝেতে ঢালিসনে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পাবেতুই তো একটা হাবা ছেলেঅপু বাড়ি মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা লইয়া আমগুলি বেশ করিয়া মাখিল,- বলিল, নে হাত পাত। - তুই অতগুলো খাবি দিদি? - অতগুলি বুঝি হলো? এই তো- ভারি বেশি- যা, আচ্ছা নে আর দু'খানা- বাঃ, দেখতে বেশ হয়েচে রে, একটা লঙ্কা আনতে পারিস? আর একখানা দেবো তা হলে- লঙ্কা কী করে পাড়বো দিদি? মা যে তক্তার ওপর রেখে দ্যায়, আমি যে নাগাল পাই নে? - তবে থাকগে যাক্ – আবার ওবেলা আনবো এখন-পটলিদের ডোবার ধারের আমগাছটায় গুটি যা ধরেচে – দুপুরের রোদে তলায় ঝরে পড়েদুর্গাদের বাড়ির চারিদিকেই জঙ্গল। হরিহর রায়ের জ্ঞাতি-ভ্রাতা নীলমণি রায় সম্প্রতি গত বৎসর মারা গিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রকন্যা লইয়া নিজ পিত্রালয়ে বাস করিতেছেন। কাজেই পাশের এ ভিটাও জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়িয়া আছে। নিকটে আর কোনো লোকের বাড়ি নাই। পাঁচ মিনিটের পথ গেলে তবে ভুবন মুখুয্যের বাড়ি।

হরিহরের বাড়িটাও অনেকদিন হইয়া গেল মেরামত হয় নাই, সামনের দিকের রোয়াক ভাঙা, ফাটলে বন- বিছুটির ও কালমেঘ গাছের বন গজাইয়াছে- ঘরের দোর জানালার কপাট সব ভাঙা, নারিকেলের দড়ি দিয়া গরাদের সঙ্গে বাঁধা আছে। খিড়কি দোর ঝনাৎ করিয়া খুলিবার শব্দ হইল এবং একটু পরেই সর্বজয়ার গলা শুনা গেল-দুগ্‌গা, ও দুগগা* দুর্গা বলিল-মা ডাকছে, যা দেখে আয়-ওখানা খেয়ে যা-মুখে যেনুনের গুঁড়ো লেগে আছে, মুছে ফ্যাল-

মায়ের ডাক আর একবার কানে গেলেও দুর্গার এখন উত্তর দিবার সুযোগ নাই, মুখ ভর্তি। সে তাড়াতাড়ি জারানো আমের চাকলাগুলি খাইতে লাগিল। পরে এখনো অনেক অবশিষ্ট আছে দেখিয়া কাঁঠালগাছটার কাছে সরিয়া গিয়া গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সেগুলি গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল। অপু তাহার পাশে দাঁড়াইয়া নিজের অংশ প্রাণপণে গিলিতেছিল, কারণ চিবাইয়া খাওয়ার আর সময় নাই। খাইতে খাইতে দিদির দিকে চাহিয়া সে দোষ সম্বন্ধে সচেতনতাসূচক হাসি হাসিল। দুর্গা খালি মালাটা এক টা মারিয়া ভেরেণ্ডাকচার বেড়া পার করিয়া নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়িয়া দিল। ভাইয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- মুখটা মুছে ফ্যাল্ না বাঁদর, নুন লেগে রয়েছে যে ... পরে দুর্গা নিরীহমুখে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া বলিল- কী মা? -কোথায় বেরুনো হয়েছিল শুনি? একলা নিজে কতদিকে যাবো? সকাল থেকে ক্ষার কেচে গাগতর ব্যথা হয়ে গেল, একটুখানি কুটোগাছটা ভেঙে দু খানা করা নেই, কেবল পাড়ায় পাড়ায় টোটো টোকলা সেধে বেড়াচ্ছেন- সে বাঁদর কোথায়?

অপু আসিয়া বলিল, মা, খিদে পেয়েছে। -রোসো রোসো, একটুখানি দাঁড়াও বাপু ... একটুখানি হাঁপ জিরোতে দ্যাও। তোমাদের রাতদিন খিদে আর রাতদিন ফাইফরমাজ! ও দুগগা, দ্যাখ তো বাছুরটা হাঁক পাড়ছে কেন? খানিকটা পরে সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় বঁটি পাতিয়া শসা কাটিতে বসিল। অপু কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল -আর এটু আটা বের করো না মা, মুকে বড় লাগে! দুর্গা নিজের ভাগ হাত পাতিয়া লইয়া সঙ্কুচিত সুরে বলিল- চালভাজা আর নেই মা? অপু খাইতে খাইতে বলিল- উঃ, চিবনো যায় না। আম খেয়ে দাঁত টকেদুর্গার ভুকুটিমিশ্রিত চোখটেপায় বাধা পাইয়া তাহার কথা অর্ধপথেই বন্ধ হইয়া গেল। তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল,- আম কোথায় পেলি? সত্য কথা প্রকাশ করিতে সাহসী না হইয়া অপু দিদির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে চাহিল।

সর্বজয়া মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল- তুই ফের এখন বেরিয়েছিলি বুঝি? দুর্গা বিপন্নমুখে বলিল- ওকে জিজ্ঞেস করো না? আমি- এই তো এখন কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়েতুমি যখন ডালে তখন তোস্বর্ণ গোয়ালিনী গাই দুহিতে আসায় কথাটা চাপা পড়িয়া গেল। তাহার মা বলিল- যা, বাছুরটা ধরগে যা- ডেকে সারা হোলো- কমলে বাছুর, ও সন্ন, এত বেলা করে এলে কি বাঁচে? একটু সকাল করে না এলে এই তেতল্পর পজ্জন্ত বাছুর বাঁধাদিদির পিছনে পিছনে অপুও দুধ দোয়া দেখিতে গেল। সে বাহির উঠানে পা দিতেই দুর্গা হাতার পিঠে দুম্ করিয়া নির্ঘাত এক কিল বসাইয়া দিয়া কহিল- লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর!

পরে মুখ ভ্যাঙাইয়া কহিলআম খেয়ে দাঁত টকে গিয়েছে। আবার কোনোদিন আম দেবো খেও- ছাই দেবো-এই ওবেলাই পটলিদের কাঁকুড়তলির আম কুড়িয়ে এনে জারাবো, এত বড় বড় গুটি হয়েছে, মিষ্টি যেন গুড়- দেবো তোমায়? খেও এখন? হাবা একটা কোথাকার- যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে!

দুপুরের কিছু পরে হরিহর কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিল। সে আজকাল গ্রামের অন্নদা রায়ের বাটীতে গোমস্তার কাজ করে। জিজ্ঞাসা করিল- অপুকে দেখচি নে? সর্বজয়া বলিল- অপু তো ঘরে ঘুমুচ্ছে। -দুগগা বুঝি -সে সেই খেয়ে বেরিয়েছে- সে বাড়ি থাকে কখন? দুটো খাওয়ার সঙ্গে যা সম্পর্ক! আবার সেই খিদে পেলে তবে আসবে- কোথায় কার বাগানে কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে- এই চত্তির মাসের রোদুরে, ফের দ্যাখো না এই জ্বরে পড়লো বলে- অত বড় মেয়ে, বলে বোঝাবো কত? কথা শোনে, কানে নেয়? একটু পরে হরিহর খাইতে বসিয়া বলিল- আজ দশঘরায় তাগাদার জন্যে গেছলাম, বুঝলে? একজন লোক,খুব মাতবর, পাঁচটা-ছয়টা গোলা বাড়িতে, বেশ পয়সাওয়ালা লোক- আমায় দেখে দণ্ডবৎ করে বল্লেদাদাঠাকুর, আমায় চিনতে পাচ্ছেন?

আমি বল্লাম- না বাপু, আমি তো কৈ?- বল্লে- আপনার কর্তা থাকতে তখন তখন পূজা-আচ্চায় সবসময়ই তিনি আসতেন, পায়ের ধুলো দিতেন। আপনারা আমাদের গুরুতুল্য লোক, এবার আমরা বাড়িসুদ্ধ মন্তর নেবো ভাবচি- তা আপনি যদি আজ্ঞে করেন, তবে ভরসা করে বলি- আপনিই কেন মন্তরটা দেন না? তা আমি তাদের বলেচি আজ আর কোনো কথা বলবো না, ঘুরে এসে দু-একদিনে- বুঝলে? সর্বজয়া ডালের বাটি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল, বাটি মেজেতে নামাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল। বলিলহ্যাগো, তা মন্দ কী? দাও না ওদের মন্তর? কী জাত? হরিহর সুর নামাইয়া বলিল- বলো না কাউকে!- সদৃগোপ। তোমার তো আবার গল্প করে বেড়ানো স্বভাব-আমি আবার কাকে বলতে যাবো, তা হোক গে সদৃগোপ, দাও গিয়ে দিয়ে, এই কষ্ট যাচ্ছে ঐ রায়বাড়ির আটটা টাকা ভরসা, তাও দু'তিন মাস অন্তর তবে দ্যায়- আর এদিকে রাজ্যের দেনা।

কাল ঘাটের পথে সেজ ঠারুন বল্লে- বৌমা, আমি বন্দক ছাড়া টাকা ধার দিই নে- তবে তুমি অনেক করে বল্লে বলে দিলাম- আজ পাঁচ পাঁচ মাস হয়ে গেল, টাকা আর রাখতে পারবো না। এদিকে রাধা বোষ্টমের বৌ তো ছিড়ে খাচ্ছে, দু'বেলা তাগাদা আরম্ভ করেচে। ছেলেটার কাপড় নেইদু'তিন জায়গায় সেলাই, বাছা আমার তাই পরে হাসিমুখে নেচে নেচে বেড়ায় আমার এমন হয়েছে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই
-আর একটা কথা ওরা বলছিল, বুঝলে? বলছিল গায়ে তো বামুন নেই, আপনি যদি এই গাঁয়ে উঠে আসেন, তবে জায়গা জমি দিয়ে বাস করাই- গাঁয়ে একঘর বামুন বাস করানো আমাদের বড় ইচ্ছে। তা কিছু ধানের জমিটমি দিতেও রাজি- পয়সার তো অভাব নেই! আজকাল চাষাদের ঘরে লক্ষ্মী বাধা- ভদ্দর লোকেরই হয়ে পড়েচে হা ভাত যো ভাত-

আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইল- এখুনি। তা তুমি রাজি হলে না কেন? বল্লেই হতো যে আচ্ছা আমরা আসবো! ও রকম একটা বড় মানুষের আশ্রয়- এ গাঁয়ে তোমার আছে কী? শুধু ভিটে কামড়ে পড়ে থাকাহরিহর হাসিয়া বলিল- পাগল! তখুনি কি রাজি হতে আছে? ছছাটলোক, ভাববে ঠাকুরের হাঁড়ি দেখছি শিকেয় উঠেচে- উঁহু, ওতে খেলো হয়ে যেতে হয় তা নয়, দেখি একবার চুপি চুপি মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে- আর এখন ওঠ বল্লেই কী ওঠা চলে? সব ব্যাটা এসে বলবে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেব না- দেখি পরামর্শ করে কি রকম দাঁড়ায়এই সময়ে মেয়ে দুর্গা কোথা হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া বাহিরের দুয়ারের আড়াল হইতে সতর্কতার সহিত একবার উঁকি মারিল এবং অপর পক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ দেখিয়া ওধারে পাঁচিলের পাশ বাহিয়া বাহির বাটীর রোয়াকে উঠিল।

দালানের দুয়ার আস্তে আস্তে ঠেলিয়া দেখিল উহা বন্ধ আছে। এদিকে রোয়াকে দাঁড়ানো অসম্ভব, রৌদ্রের তাপে পা পুড়িয়া যায়, কাজেই সে স্থান হইতে নামিয়া গিয়া উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইল। রৌদ্রে বেড়াইয়া তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, আঁচলের খুঁটে কী কতকগুলো যত্ন করিয়া বাঁধা। সে আসিয়াছিল এইজন্য যে, যদি বাহিরের দুয়ার খোলা পায় এবং মা ঘুমাইয়া থাকে, তবে ঘরের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকিয়া একটু শুইয়া লইবে। কিন্তু বাবার, বিশেষত মার সামনে সম্মুখ দুয়ার দিয়া বাড়ি ঢুকিতে তাহার সাহস হইল না।

উঠানে নামিয়া সে কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া কী করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহভাবে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। পরে সেখানেই বসিয়া পড়িয়া আঁচলের খুঁট খুলিয়া কতকগুলি শুকনো রড়া ফলের বিচি বাহির করিল। খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে আপন মনে সেগুলি গুনিতে আরম্ভ করিল, এক-দুইতিন-চার ... ছাব্বিশটা হইল। পরে সে দুই তিনটা করিয়া বিচি হাতের উল্টা পিঠে বসাইয়া উঁচু করিয়া হুঁড়িয়া দিয়া পরে হাতের সোজা পিঠ পাতিয়া ধরিতে লাগিল।

মনে মনে বলিতে লাগিল - অপুকে এইগুলো দেবো – আর এইগুলো পুতুলের বাক্সে রেখে দেবো কেমন বিচিগুলি তেল চুকচুক কচ্ছে- আজই গাছ থেকে পড়েচে, ভাগ্যিস আগে গেলাম, নৈলে সব গোরুতে খেয়ে ফেলে দিতো, ওদের রাঙি গাইটা একেবারে রাক্কস, সব জায়গায় যাবে, সেবার কতকগুলো এনেছিলাম আর এইগুলো নিয়ে অনেকগুলো হলো।
সে খেলা বন্ধ করিয়া সমস্ত বিচি আবার সযত্নে আঁচলের খুঁটে বাঁধিল। পরে হঠাৎ কী ভাবিয়া রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে উড়াইতে উড়াইতে মহা খুশির সহিত পুনরায় সোজা বাটীর বাহির হইয়া গেল।

ভিডিওঃ
শব্দার্থ ও টীকা:
রোয়াক - ঘরের সামনের খোলা জায়গা বা বারান্দা।
চুপড়ি - ছোট ঝুড়ি, ক্ষুদ্র ধামা।
নাটাফল - করঞ্জা ফল খাপরার কুচি - কলসি-হাঁড়ি প্রভৃতির ভাঙা অংশ বা টুকরা।
পিজরাপোলের আসামি - খাঁচায় পড়ে থাকা অবহেলিত আসামির মতো অর্থে।
দাওয়া – বারান্দা।
আমের কুসি - কচি আম। জারা জীর্ণ করা, কুচি কুচি করা অর্থে।
বন-বিছুটি - বুনো গাছ।
কালমেঘ - যকৃতের রোগে উপকারী একপ্রকার তিক্ত স্বাদের গাছ।
গরাদ - জানালার সিক। ভেরেণ্ডাকচার বেড়া-এরন্ড বা রেড়ি গাছের বেড়া।
কুটোগাছ - তৃণ।
রোনো রোসো - থাম থাম।

পাঠ-পরিচিতি: ‘আম আঁটির ভেঁপু’ শীর্ষক গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস থেকে সগ্রহ করা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ দুই ভাই-বোনের আনন্দিত জীবনের আখ্যান নিয়ে গল্পটি রচিত হয়েছে। অপু ও দুর্গা হতদরিদ্র পরিবারের শিশু। কিন্তু তাদের শৈশবে দারিদ্র্যের সেই কষ্ট প্রধান হয়ে ওঠেনি। অধিকন্তু গ্রামীণ ফলফলাদি খাওয়ার আনন্দ এবং বিচিত্র বিষয় নিয়ে তাদের বিস্ময় ও কৌতূহল গল্পটিকে মানুষের চিরায়ত শৈশবকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গল্পের সর্বজয়া পল্লি-মায়ের শাশ্বত চরিত্র হয়ে উঠেছে।

অনুশীলনী
কর্ম-অনুশীলন

১. আম আঁটির ভেঁপু’গল্পে যে সকল গ্রামীণ উপাদান ও শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি কর।
২. তোমার পঠিত আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের অনুরূপ গ্রামীণ জীবনের বর্ণনা সংবলিত অন্য একটি
গল্পের আলোচনা লিখে শ্রেণিশিক্ষকের নিকট জমা দাও।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। উঠানের কোন জায়গা থেকে দুর্গা অপুকে ডাকছিল?
ক. আমতলা
খ. বটতলা
গ. কাঁঠালতলা।
ঘ. জামতলা

২. তেলের ভাঁড় ছুঁলে দুর্গাকে মারবে কেন?
i কুসংস্কারের কারণে
ii অপচয়ের কারণে
iii না জানানোর কারণে

নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. iii
ঘ. ii ও iii

উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও :
রিপন ও রুমা দুই ভাই-বোন। তাদের বয়সের পার্থক্য চার বছর। একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হলেও বিভিন্ন জিনিস একে অন্যকে তারা দেখাতে চায় না। রুমার খেলার সামগ্রী রিপন লুকিয়ে রাখে। রুমার বিভিন্ন আদেশ, আবদার রিপন মানতে চায় না। এই নিয়ে ওদের মাকে নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।

৩. উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের কোন দিককে প্রতিফলিত করেছে?
ক. ভাই-বোনের সম্পর্ক
খ. ভাই-বোনের বিরোধ
গ. ভাই-বোনের আবদার
ঘ. মায়ের চিন্তা

৪। উদ্দীপকের ভাবনা আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের কোন উদ্ধৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ?
ক. তাহার স্বর একটু সতর্কতা মিশ্রিত 
খ. একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুশি জারাববা 
গ. দুর্গার হাতে একটি নারিকেলের মালা 
ঘ. নারকেলের মালাটা আমায় দে
 
এসএসসি (SSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: বাংলা ১ম পত্র গাইড

সৃজনশীল প্রশ্ন 
একই পরিবারের মকবুল, আবুল, সুরত সবাই বেশ পরিশ্রমী। নিজেদের জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গাচাষ করে, লাকড়ি কাটে, মাঝিগিরি করে, কখনো কখনো অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের স্ত্রীরাও বসে নেই। ভাগ্যের উন্নতির জন্য পাতা দিয়ে পাটি বোনে, বাড়ির আঙিনায় মরিচ, লাউ, কুমড়া ফলায়, বিল থেকে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে। কোনো রকমে জীবন চলে যাচ্ছে তাদের।
ক. দুর্গার বয়স কত?
খ. বামুন হিসেবে বাস করার প্রস্তাবে হরিহর রাজি হলো না কেন?
গ. উদ্দীপকে ‘আম-আঁটির ভেঁপু' গল্পের ফুটে ওঠা দিকটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকটি ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ গল্পের মূলভাবকে কতটুকু ধারণ করে? যুক্তিসহ বুঝিয়ে লেখ।
Share:

বাংলা গল্প 'রক্তে ভেজা একুশ' -সেলিনা হোসেন

[লেখক-পরিচিতি: সেলিনা হোসেন ১৪ই জুন ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এ. কে. মোশাররফ হোসেন, মাতা মরিয়মেন্নেসা বকুল। ১৯৬২ সালে তিনি রাজশাহীর পি.এন.গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেলিনা হোসেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক।

অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারীমুক্তি তাঁর কথাসাহিত্যের মূলগত আখ্যান। তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: হাঙর নদী গ্রেনেড, মগ্ন চৈতন্যে শিস, যাপিত জীবন, চাঁদবেনে, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, গায়ত্রী সন্ধ্যা, দীপান্বিতা ইত্যাদি; গল্পগ্রন্থ: উৎস থেকে নিরন্তর, খোলকরতাল, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ইত্যাদি; শিশু-কিশোর উপযোগ্য রচনা: সাগর, বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা, বর্ণমালার গল্প, জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি, চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ ইত্যাদি। সাহিত্যক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।]

গল্পঃ
রক্তে ভেজা একুশ
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। বিশাল সভা হবে। মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিন জনশূন্য। মালিকের কাছে বলে অহি ও মন্টুও এসেছে বক্তৃতা শুনতে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিল করে প্রদীপ্ত এসেছে। ও দারুণ উত্তেজিত। শহরের এতসব ঘটনা ওকে প্রতিদিন অন্যরকম করছে। বাড়িতে বাবা ওকে নানা কিছু বুঝিয়ে দেয়। আলী আহমদ নিজেও ছাত্রদের নিয়ে সভা করেন। ওদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। প্রদীপ্ত সেসব কথাও শোনে।

দূর থেকে অহিকে দেখে ও চিঙ্কার করে ডাকে। অহি ওকে হাত ইশারায় কাছে আসতে বলে। তারপর তিন জনে জায়গা নিয়ে বসে যায়। স্কুলের ছেলেদের চেয়ে অহির সঙ্গ বেশি প্রিয় মনে হয় প্রদীপ্তর। মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীতের রোদ ওদের বেশ আরাম লাগে। পিঠ রোদে দিয়ে বসেছে। ক্যান্টিনে বসে যারা চা খায় তাদের অনেকে বক্তৃতা করছে। কী আবেগ, কী গমগমে কণ্ঠ। অহির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অথচ কয়েক দিন আগে পল্টনে খাজা নাজিমুদ্দীনের শোনা বক্তৃতাটা ওর শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। বিরক্ত লাগছিল ওর। আজ ওর আনন্দ হচ্ছে। শুনলে কেমন মন ভরে যায়, না প্রদীপ্ত?

রক্তে ভেজা একুশ - সেলিনা হোসেন বাংলা ১ম নবম-দশম শ্রেণি
লেখকঃ সেলিনা হোসেন

হ্যাঁ। প্রদীপ্ত প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। মন্টু আস্তে করে বলে, আমরা তো রাস্তার ছেলে, আমাদেরকে কী এসব মানায়? একশো বার মানায়। প্রদীপ্ত জোরের সঙ্গে বলে। সভা শেষে এক বিশাল মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে ওরা
হাত ধরে রাখে, পাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক ফাঁকে অহি বলে, জানিস যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা  চাই’ বলি তখন দম একটুও ফুরায় না। মনে হয় একনাগাড়ে হাজার বার বলতে পারি।

প্রদীপ্ত বলে, ঠিক বলেছেন অহি ভাই। হাঁটতে হাঁটতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেল । চল কেটে পড়ি। ধুৎ, আয় তো। অহি মন্টুর হাত ধরে টান দেয়। তিনজনে জনস্রোতে মিশে যায়। প্রদীপ্তর মনে হয় ওরা আর বালক নেই। ওর বাবা তো জানেন না যে প্রদীপ্ত স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে চলে এসেছে। আজ বাবাকে গিয়ে ও বলবে, মিছিলে এসে ও বড় হয়ে গেছে। খুব বেশি বড় না হলেও অহির সমান তো হয়েছেই, ঐটুকু হতে পেরেই ওর আনন্দ হচ্ছে। ওরা বড়দের সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে পারছে। প্রদীপ্তর মনে হয় ওর চারদিকে খোলা। যেদিকে খুশি সেদিকেই এগুতে পারে।

এখন ওর শুধু ঠিক করা যে ও কোনদিকে যাবে। বিকেলে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করে এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সভাতেই ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়। আর কতদিন পরে অহি? আজ তো চার তারিখ। আরো ষোল দিন পরে। এখনো অনেক দেরি। দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে যাবে। দেখছিস শহরের মানুষ কেমন মেতে উঠেছে। ডাঙুলি খেলার দিনগুলো বুঝি অনেক বেশি ভালো ছিল। ওর অন্য বন্ধুরা ওর খোঁজে এসেছিল, কিন্তু অহি ওকে যেতে দেয়নি। অহি এখন ওকে বেশি ভালোবাসে। সারা দিন ওরা তেমন সময় পায় না। 

অহির আগ্রহ বেশি, তাই মন্টু নিজে বেশি কাজ করে ওকে যাবার সুযোগ করে দেয়। অহি যেন ওর মায়ের পেটের ভাই। কেমন প্রাণের টান অনুভব করে। একুশ তারিখের ধর্মঘট সফল করার জন্য ছাত্রদের যেমন, সাধারণ মানুষেরও তেমনি উৎসাহের অন্ত নেই। পূর্ণ উদ্যমে চলছে প্রস্তুতি। এগারই ও তেরই ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি সংবলিত ব্যাজ বিক্রি করে একুশতারিখে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। দেয়ালের লিখনে, পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহর। মানুষের আলোচনার বিষয় একুশে। 

জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। এদিকে ঐ একই তারিখে গণপরিষদে বসবে পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন। বিশে ফেব্রুয়ারি রাত থেকে সরকার ক্রমাগত একমাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করল। তীব্র প্রতিক্রিয়ী। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। ক্ষোভে, আক্রোশে পরিপূর্ণ বুকের কন্দর নিয়ে জেগে রইল মানুষ। অহি ভাবল, আমার মতো রাস্তার ছেলের মৃত্যুর বদলে কি বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে? আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় সারা রাত।

বিশ্ব একাকার খুব ভোরবেলা জনশূন্য রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকে অহি। মন্টুকে ডেকেছিল। কিন্তু এত ভোরে ও ঘুম থেকে উঠতে রাজি হলো না। ভোরের বাতাসে ও বড় করে হাই তোলে। শীত লাগছে না। ও ফাঁকা রাস্তায় খানিকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে। শরীর গরম হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলে যে আজ আর ক্যান্টিনে ফিরবে না।ও হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির চত্বরে আসে। বেলা বেশ হয়েছে। ছেলেরা ইতস্তত জটলা করছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা আসছে।

স্কুলের ছেলেদের দেখলেই অহি প্রদীপ্তকে খুঁজতে থাকে। যত বেলা বাড়ছে, প্রতিবাদে বিক্ষোভে, স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। একটু পর সভা শুরু হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। অহির অস্থির লাগছে। ওর বুলু দাসের কথা খুব মনে হয়। আজ তো বুলু দাসের কাজ নেই। এখনো কি ঘুমুচ্ছে? সোহাগির সঙ্গে বিয়েটা কি হয়েই গেল?

পরক্ষণে তুমুল শ্লোগানে ভেঙে পড়ে এলাকা। দশজন দশজন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। শুরু হয় গ্রেফতার বরণের পালা। দশজন করে বের হয় আর রাস্তায় অপেক্ষমাণ পুলিশ সবাইকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তোলে। অহি একপাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে। তখন প্রদীপ্ত দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে, অহি ভাই? আমি তো তোকেই খুঁজছি প্রদীপ্ত। আমি তো অনেকক্ষণ আগে এসেছি। তোমাকেই খুঁজছিলাম। আমরা এখন কী করব অহি ভাই। এদের সঙ্গে থাকব। অন্য কোথাও যাব না। দেখছিস না কেমন গ্রেফতার বরণ চলছে। 

অহির বুক কাঁপে থরথর করে। দেখতে দেখতে অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে ট্রাক চলে যায় লালবাগ থানায়। এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ওদের চোখ জ্বালা করে। ওরা দৌড়ে পুকুরের পাশে চলে আসে। আঁজলা ভরে পানি তুলে চোখে ঝাপটা দেয়। অনেকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কেউ কেউ ঝাঁপ দেয় পুকুরে। অহি আর প্রদীপ্ত কারো কারো জন্য রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে আসে ।চোখ মুছিয়ে দেয়। নিজেদের যন্ত্রণা তেমন নয়। ভুলে যায় সেটুকু। এই যন্ত্রণা এবং উত্তেজনায় ছাত্ররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

বেলা বাড়ে। সূর্য মাথার ওপর খাড়া। শীতের দুপুর বলে ঝাঁঝালো রোদ নয়। দুটো পর্যন্ত চলে গ্রেফতার বরণের পালা। এর মাঝে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে । ওরা নিজেরা বুঝতে পারে না কীভাবে এখানে এলো। ওরা এখন মেডিকেলের হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে। মন্টু ওদের দেখতে পেয়ে ছুটে আসে।
অহি? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? মা গো তোর কী যে সাহস! আমি তো ভয়েই বাঁচি না।
অহি ওর কাঁধে হাত রাখে। ভয় কী মন্টু? আয়।

আমি যাব না। আমি এদিকেই থাকি। মন্টু ভেতরের দিকে চলে যায়। অহি দেখল এখন আর ছাত্ররা একা নয়। স্রোতের মতো মানুষ এসে মিলিত হয়েছে। শত শত মানুষ। দলবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরোলেই তাড়া করে পুলিশ। বেলা সোয়া তিনটার দিকে এম. এল.এ. ও মন্ত্রীরা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। পরিষদ ভবনের কোণে চৌরাস্তায় মেশিনগান পাতা হয়েছে। তৈরি হয়েছে কাঁটাতারের ব্যারিকেড। উত্তাল হয়ে ওঠে জনতার স্লোগান। কেউই আর কোনো বাধা মানতে চায় না।

মিছিল এগিয়ে আসতে চাইলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাড়া করতে করতে ঢুকে পড়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। মানুষ ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জে দমাতে না পেরে পুলিশ গুলি চালায়। পড়ে যায় রফিকউদ্দীন। বুলেটে উড়ে যাওয়া খুলি থেকে ধোঁয়া বেরোয়; গলিত মগজ বেরিয়ে পড়ে। আহত হয় বরকত। ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায় ছেলেরা। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ছেলেরা কাঁদে। মেডিকেল কলেজের ছেলেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের তুলে নিয়ে যায়।

তখন ফুলার রোডে নিহত অহিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদে প্রদীপ্ত আর মন্টু। রক্ত লেগে যায় মন্টুর শরীরেও। অহির বুক ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। এই প্রথম মন্টু একজনের জন্য বুক উজাড় করে কাঁদছে। বাবা যখন মারা গেছেন ও তা বোঝেনি। মায়ের অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেজন্যও কাঁদেনি। রাস্তায় যতদিন ঘুরেছে তখন কারো জন্য কাঁদার মতো অবস্থাই হয়নি। আজ অহি ওর বুক উজাড় করে দিয়েছে। প্রদীপ্ত বিমূঢ় হয়ে গেছে। ও কখনো মৃত্যু দেখেনি। বিস্ফারিত চোখে শুধু অহিকেই দেখে। নিথর হয়ে গেছে অহি।

ওর শরীরটা তখনো গরম। ও বুঝতে পারে কান্না কী? ছছাটবেলা থেকে কখনো ওকে এমন করে কাঁদতে হয়নি। ওদের কাদার রেশ কমে আসার আগেই বুটের লাথিতে ছিটকে পড়ে ওরা। দেখে দুজন পুলিশ অহির লাশটা ট্রাকে উঠিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রদীপ্ত দেখতে পায় না মফিজুলকে। গুলি মফিজুলের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ও। বুটের লাথি খেয়ে উল্টে পড়ে যাওয়া প্রদীপ্তকে হাত ধরে টেনে ওঠায় মন্টু। প্রদীপ্তর মাথা ঘুরছে। আশেপাশে কোনোকিছু দেখার মতো অবস্থা ওর নেই। ততক্ষণে আর একটি পুলিশ ভ্যান এসে উঠিয়ে নিয়ে যায় মফিজুলের লাশ। ও রেখে যায় রাস্তার ওপর জমাট রক্ত।

পুলিশের গাড়ি দেখে মন্টু ভয় পেয়ে প্রদীপ্তকে টেনে গাছের আড়ালে চলে যায়। ও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, মন্টু পানি? মন্টু চারদিকে তাকায়, কোথায় পানি? অবসন্ন কণ্ঠে বলে, যুদ্ধ থামুক। তারপর পানি দেবো। পরদিন নয়, তেইশ তারিখের ‘আজাদ পত্রিকায় বেরুলো একটি সংবাদ। বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব যে চার জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহাদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয়। একটি কিশোর বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শুনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পরে জানা যায় যে, বালকটি মেডিকেল কলেজ ও পরিষদের মধ্যে। ফুলার রোডে গুলিতে নিহত হয় এবং তাহার লাশ তৎক্ষণাৎ অপসারিত হয়।

খবরের কাগজে খবরটা পড়ে গুম হয়ে থাকে আলী আহমদ। এমনিতেই দুদিন ধরে তার জ্বর। একুশ তারিখের ঘটনায় টিয়ার গ্যাস এবং লাঠিচার্জে আহত হয়েছে। পায়ে এবং পিঠে আঘাত পেয়েছে । হাঁটতে কষ্ট হয়। মফিজুল তার কাছাকাছি ছিল, পরে ভিড়ে কোথায় ছিটকে চলে যায় টের করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত মফিজুলের কোনো খবর নেই। আলী আহমদ নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না। কাগজে খবরটা পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে প্রদীপ্ত, বাবা এ যে আমাদের অহি, অহিউল্লাহ। চুপ, আস্তে। শুনতে পারে। রান্নাঘরে বসে অহির মা গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। বারবার বলছে, আমার অহির একটা খবর এনে দেন ভাইসাব। আলী আহমদ কথা বলে না। ও দীপু তুমি না বললে অহি তোমার সঙ্গে ছিল? প্রদীপ্ত চুপ করে থাকে। ওরে আমার অহি রে।

কান্নার সুর ওঠে অহির মায়ের কণ্ঠে। বাড়িতে শোকের ছায়া। অহি নেই এই কথাটা এখন পর্যন্ত অহির মাকে বলছে না কেউ। বলে কী হবে? লাশ কোথায়? লাশের খবর তো ওরা জানে না। মর্গে অহির বিকৃত চেহারাটা প্রথমে চিনতেই পারেনি বুলু দাস। চেনা লাগছে? কে এ? বুলু দাসের শরীর কাঁপে থরথর করে। হ্যা অহি-ই তো? একদম অহি। কোনো ভুল নেই। বুলু ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ওর পায়ের পাতায় হাত রাখে। চেপে বসে যায় তাতে । গন্ধ আসছে তীব্র। কোনোকিছুই বোধে নেই ওর। বুলু স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে হেড জমাদার চিৎকার করে কী যেন বলছে, বুলুর কানে তা ঢোকে না। ও উবু হয়ে অহির মুখের ওপর ঝুঁকে থাকে। ইচ্ছে হয় বুকে জড়িয়ে ধরতে।

প্রচণ্ড ব্যাকুলতায় বুলু দাসের কান্না থেমে যায়। হঠাৎ ওর মনে হয় অহির নিঃশ্বাস বইছে, বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে। বুলুদা হাঁটুতে মুখ গোঁজে। ওর সামনে মর্গের ছোট ঘরটা দিগন্ত-সমান হয়ে যায়। বুলুদা, আমি অহি? বুলুর ঠোট কাঁপে। অহিকে বুকে তুলে নেয়। তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বুলুদা? মায়ের কাছে। ঘরে। একটি ঘর নয়। একজন মা নয়। অনেক মা । আমার মা কেমন আছে বুলুদা? তোর আর এখন কোনো মা নেই। তুই এখন সব মায়ের ছেলে। বুলু দাসের চোখে জল নেই। ও বুক ভরে শ্বাস টানতেই অনুভব করে অহির শরীর থেকে তীব্র উঁই ফুলের গন্ধ আসছে।

সেই গন্ধে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। মুহূর্তে অহির শরীর লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে হাতে কোথায় চলে যায় বুলু দাস হদিস করতে পারে না। ও বিমূঢ় হয়ে থাকে। এত লোক অহিকে ভালোবাসে? এত ভালোবাসা অহির জন্য? গর্বে-অহংকারে বুলুর বুক ভরে যায়। ও ওর কেবলই মনে হয় অহি মানুষের হৃদয়ে পৌছে গেছে। অহি মরেনি।

শব্দার্থ:
কর্মপরিষদ- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গঠিত ছাত্রজোট। ব্যাজনির্দেশক চিহ্ন।
জল্পনা-কল্পনা- আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা।
আক্রোশ- ক্রোধ, রোষ, হাসপাতালের ইমার্জেন্সি হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র। গুজব রটনা, জনরব ছড়ানো।

পাঠ-পরিচিতি:
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (১৯৯৪) উপন্যাসের অংশবিশেষ রক্তে ভেজা একুশ। আমাদের মহান ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এ কাহিনী রচিত। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মিছিলে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও পথশিশুর অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে এ গল্পে। আন্দোলনে শামিল হয়ে পথশিশু অহি শহিদ হয়েছে এবং সকল মায়ের সন্তান হিসেবে নন্দিত হয়েছে।

অনুশীলনী।
কর্ম-অনুশীলন

১। স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেয়ালিকা তৈরি কর।
২। স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত র্যালিতে বহনের জন্য কয়েকটি পোস্টার, ফেস্টুন তৈরি কর।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। কর্মপরিষদের উদ্যোগে কোন সময় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়?
ক. সকালে
খ. বিকেলে
গ. সন্ধ্যায়
ঘ. রাতে

২। অহির বুক কাঁপে থরথর করে কেন?
ক. মিছিল দেখে
খ. গুলিবর্ষণ দেখে
গ. তুমুল স্লোগানে
ঘ. গ্রেফতার বরণ চলার জন্য

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও:
তোমার ছেলে আসল ফিরে হাজার ছেলে হয়ে, আর কেঁদো না মা; কেননা মা তো কাঁদে না; মার চোখে নেই অশ্রু।

৩। উদ্দীপকের তোমার ছেলে রক্তে ভেজা একুশ’ গল্পের কোন চরিত্রকে ইঙ্গিত করে-
ক. অহি
খ. প্রদীপ্ত
গ. মন্টু
ঘ. বরকত
 
এসএসসি (SSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: বাংলা ১ম পত্র গাইড

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ। বিগত কয়দিন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ঘুম হয়নি। তবুও উঠে বসলাম। বের হয়ে পড়লাম যুদ্ধে। প্রচণ্ড গোলাগুলি। মিহিরের বুকে গুলি লেগেছে। আমি তার দিকে দেখে অঝোরে কাঁদি। মতি আহত হয়েছে। আমার কাছে সে পানি খেতে চায়। তার ব্যবস্থা করার জন্য আমি ছুটছি।
ক. উত্তাল হয়ে ওঠে কী?
খ. প্রদীপ্তর মাথা ঘুরছে- কেন, তা বুঝিয়ে বল।
গ.উদ্দীপকের মিহির চরিত্রের সাথে রক্তে ভেজা একুশ’ গল্পের যে চরিত্র সাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা
ঘ. উদ্দীপকে প্রকাশিত অভিব্যক্তি রক্তে ভেজা একুশ’ গল্পের মূল অভিব্যক্তির অনুরূপ মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।
Share: