[লেখক-পরিচিতি: মমতাজউদদীন আহমদ ১৮ই জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মালদহে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কলিমউদদীন আহমদ এবং মাতা সখিনা খাতুন। তিনি ১৯৫১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভােলাহাট রামেশ্বরী ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। কিছু সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি মূলত নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবে খ্যাতিমান। বাংলাদেশের নাট্যশিল্প আন্দোলনের তিনি পুরােধা পুরুষ। তাঁর রচিত উল্লেখযােগ্য নাটক: স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, পালা, বকুলপুরের স্বাধীনতা, সাত ঘাটের কানাকড়ি; গবেষণা ও প্রবন্ধ : বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।]
গল্পঃ
স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা
চরিত্র পরিচিতিনূর মােহাম্মদ দারােগা (বয়স ৪৫)
দলিলুর রহমান- পুলিশের সিপাহী (বয়স ২৫)
আব্দুল বারেক মণ্ডল- ঐ
লােক- (বয়স ৩৫)।
দৃশ্য পরিকল্পনা: বাংলাদেশের একটি ছােট গঞ্জের নদীর ফেরিঘাট। রাত নয়টা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে]
দলিল: একটা পােস্টারের কাগজ এইটার বুকে সাঁটব?
বারেক: ছােটবাবুকে বলি। স্যার একটা পােস্টার এই পিপেটাতে লাগিয়ে দিই।
দলিল: মাঝিমাল্লা আর ঘাটের রাহীদের নজরে পড়বে।
নূর: কিছু দেখছ, ভালাে করে দ্যাখ। বদমায়েশটার পায়ের দাগ। কাঁচা মাটিতে দগদগ করছে।
দলিল: ফেরিঘাট তাে স্যার। দিনেরাতে শয়ে শয়ে রাহী পারাপার করছে। আসামির পায়ের ছাপ নাও হতে পারে।
বারেক: নাও তাে ফিরতে পারে স্যার!
নূর: হ্যা, নাও তো ফিরতে পারে, আবার ফিরতেও পারে। আমাদের কাজ হলো সন্দেহ হলেই থমকে দাঁড়াও, কুকুরের নাক দিয়ে এঁকে দ্যাখ যদি কোনো সূত্র পাও। আমার সন্দেহ হয়, কুত্তার বাচ্চা এইখান দিয়েই নদীর ওপারে যাবে। যেতে হবে।
ঘাটে নামার মতো আর কিনার নাই। আসামির দিলের দোস্তরা সময় মতো এই কিনার ধরে ডিঙি বল আর নৌকাই বল নিয়ে ঘুর ঘুর করবে আর ইশারা পেলেই ঘাটে ডিঙি লাগাবে আর ফুস করে পার হয়ে যাবে। এ তোমার মতো আহম্মক লোক নয়। ভিন কিসিমের মাল। মগজের পোড়ে পোড়ে বুদ্ধি। এ জায়গাটা ছাড়া যাবে না হে।
দলিল: আমাদের একটা পোস্টার এই কেরাসিন তেলের পিপেটার বুকে লাগিয়ে দেব স্যার।
নূর: কোথায়? হা লাগাও। আচ্ছাসে লেই দিয়ে কাঁচা রক্তের মতো সেঁটে দাও। দেশের মানুষ দেখুক।
দলিল: দু’হাজার টাকা পুরস্কার, কম হয়েছে স্যার।
নূর: কেন?
দলিল: দশ বিশ হাজার টাকার লোভেও ঐ লোকটাকে কেউ ধরিয়ে দিবে না। দেশের এত বড় একটা বিপ্লবী।
নূর: ওসব ভাবনা এখন বাতিল করে কাজে মেজাজ দাও। এইখানে আমি থাকলাম ডিউটিতে। দেখি তোমাদের নয়নের চাঁদ বিপ্লবীর বাচ্চা কী করে আজ রাতে ডিঙিতে ওঠে।
বারেক: আপনি একাই থাকবেন?
নূর: আলবৎ। একাই থাকব। চব্বিশ বছর পুলিশের চাকরী করছি, আমাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। তোমার ঐ বিপ্লবী দুলাভাই একটা মাছ-মারা জালুয়ার ছদ্মবেশ ধরে আসবে। ঘাড়ে জাল, হাতে হুক্কা। শালা, আয়, তুই থাকিস গাছের ডালে আর আমি থাকি তোর মগডালে।
দলিল: লোকটা খুব ধড়িবাজ। আমরাও আপনার সঙ্গে থাকি।
নূর: না।
বারেক: আমাদের কিন্তু সবদিকেই বিপদ।
নূর: মণ্ডল, তোমার কথাতে বদ গন্ধ ঢুকেছে। বুকে সাহস রেখে ইমানের সঙ্গে কাজ কর।
আমরা হলাম হুকুমের টহলদার। আইন-আদালতের হেফাজতি পুলিশের ইমানের কাছে।
[বোরেক এবং দলিল পোস্টার ও আঠা নিয়ে চলে গেল] কে? কে যায়? এই শালা। [একজন লোক লম্বা চুল। মুখে দাড়ি। গ্রামে গঞ্জে এ জাতের লোক পুঁথি কিসার গান গায়, কেতাব বিক্রি করে]।
লোক: মালিক, ঘাটে যাব, নদীর ওপারে হামার বাড়ি।
নূর: আর এক পা ফেলবি না। গুলি দিয়ে ঠ্যাঙ নুলা করে দিব।
লোক: ইয়া আল্লা! হামি মরে যাব যে! হামার জন্য কাঁদনের কেউ নাই সংসারে।
নূর: এই কাঁদিস না। কে তুই?
লোক: ফকির গরীবুল্লাহ হামার নাম।
নূর: এই ফকিরের বাচ্চা, ঘাটে নামিস না। গঞ্জের দিকে ফিরে যা।
লোক: ঘাটে নামিনি মালিক। এই পাড়ে বসে একটা গান ধরব, রসের গান। রসের গান শুনে মাঝিরা যদি দুটা একটা কেতাব কিনে লেয়, ভাত খাওয়ার পয়সা হয়ে গেল। তখন ধরেন যে এক শোয়াতে রাত ভোর করে দিনু।
নূর: আমি গানটান ভালোবাসি না।
লোক: না শুনলে ভালোবাসবেন কেমন করে হুজুর। বগাবগির গান মানে যে কলজে পানি করা গান;
গান গাইছে: বগা ফান্দে পইড়া বগি কান্দেরে।
নূর: এই শালা বগার ভাতিজা। এই তোর গান? গানটার জান কবজ করে দিলি। যা ভাগ, ফিরে যা। এখানে আমার জরুরি কাজ আছে। তোর সঙ্গে বেহুদা কথা বলবার সময় নাই। আচ্ছা লোকটা দেখতে কেমন?
লোক: দেখিনি হুজুর। নূর: বলবি না?
লোক: ইয়া আল্লা, মরে যাব যে মালিক। বলছি, আমাদের গাঁয়ে দেখছি।
নূর: দেখতে জোয়ান? লোক: হ্যাঁ, তাগড়া জোয়ান, হানিফ পালোয়ানের মতোন সিনা। বাঘের মতোন লাল ঘোল্লা চোখের মণি। লাঠি, ছোরা, বন্দুক সব চালাতে জানে। আর হাতের কজি (পিপেতে ঘুষি মেরে) এই রকম লোহার মতো শক্ত। একবার যদি হাত তুলে।
নূর: তার হাত আমি গুলি মেরে ভেঙে দিব।
লোক: খবরদার মালিক, খবরদার। ও কাজ ভুল করেও করতে যাবেন নাহুজুর। একবার একটা জিদ্দি পুলিশ ডাকাতটাকে ধরতে গিয়েছিল, রাইফেল তুলে মারতে যাবে, ব্যস নাই। এক থাপ্পড়ে পুলিশের এই গালের হাড়ি ঝুর ঝুর ঝুর ঝুর করে পড়ে গেল।
নূর: তারপর? লোক: তারপর আর কী হয়। পুলিশের রাইফেল হাতেই থাকল, এন্তেকাল এসে গেল। নূর: দারোগা সাহেবও এন্তেকাল! লোক: না না মালিক। কতক্ষণ কোরবানির কাটা গরুর মতোন ছটফট ছটফট করল,পা দুটা টানসকরল তারপর মানে যে যন্ত্রপাতি বন্ধ। এখন মানে যে একে আপনি কী বলবেনসমালিক খতম, রোজকিয়ামত? নূর: চুপ কর। এই লোকটা বেঁচে থাকলে দেশের আমলা পুলিশের জান বাঁচবে কী করে? লোক: বাঁচবে না মালিক।
এই লোক থাকলে জোদ্দার কি মালদারের বংশের আর গোরে মোমবাত্তি জ্বলবে না। হুজুর, আপনি তো ঘাটের এই ডাহিন দিকে নজর রেখেছেন লোকটাসএপথে আসবে বলেই - নূর: কেন? লোক: না, মানে যে, ডাহিন দিকে তাকালে যদি বদিক দিয়ে আসে। নূর: তখন বাঁদিকে ঘুরে তাকাব! লোক: ততক্ষণ কি সময় পাবেন মালিক। খোদা না খাস্তা, যদি আসেই, বাঘের মতোন লাফিয়ে আমার মালিকের ঘাড়ে।
নূর: তখন কী হবে গরীবুল্লাহ? লোক: কী আর হবে মালিক। আপনি মানে যে শুয়ে পড়লেন কতক্ষণ বেদিশা হয়ে পড়ে থাকলেন, বাপদাদার নাম মনে করলেন, দেখলেন যে আসমান জমিন। নূর: ভালো বলেছ গরীবুল্লাহ। লোক: মালিক। নূর: আল্লার রহমতে যদি ধরতে পারি, সরকারি বখশিশের ভাগ দাবি করবে? লোক: না মালিক। আমি একটা সামান্য জীব। দেশের হাজার হাজার মানুষ আমার গান শুনে খুশি মনে দু’চার আনা পয়সা দেয়, ওতেই হামার দিন চলে যায়। আমি সরকারের পুরস্কার লিয়ে কি করব।
নূর: তুমি একটা ভালো মানুষের পয়দা হে গরীবুল্লাহ। ঈমান ঠিক রেখে বেঁচে থাক। তোমাদের মত লোক দেখতে পাই না। চোর-ডাকাত দেখে দেখে পুলিশের রুহু পচে গেছে। লোক: মালিকের উপরি আয়টায় হয় না কিছু? নূর: হয়, কিন্তু নিই না। আমার বাপের কসম আছে। মাঝে মধ্যে মনটা খিচড়ে ওঠে, কী হবে মরা বাপের কথার মূল্য দিয়ে। কিন্তু বুকটা ধক ধক্ করে। এসব করি না বলেই তো চব্বিশ বছরে চাকরিতে প্রমোশন হলো না। লোক: লোকটাকে ধরতে পারলে দু’হাজার টাকা পুরস্কার পাবেন। বড় মেয়ের বিয়া দিতে পারবেন। নূর: ধরতে পারলে তো। তুমি যেসব কথা বলছ। লোকটা বুকভরা এত সাহস আর শক্তি কোথায় পায়। তুমি শালা বানিয়ে বানিয়ে আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ না তো? লোক: মালিক হামি গান বানাই ঠিকই, কিন্তু মানুষ বানাব কোন সাহসে। মানুষ তো বানায় দুনিয়ার সুরত।
[গান: একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা]
নূর: গরীবুল্লাহ, এ তুমি কোন গান ধরলে। বুকটা হু হু করে ওঠে। বাংলার বাদশা পালিয়ে যাচ্ছে, বাংলা পরাধীন, গাও ভাই গাও।
[গান চলছে। বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে তাকে আশা দিবে, কে তাকে ভরসা দিবে, কেমন সুন্দর কথা, যতবার শুনি মনে হয় বুকের মধ্যে ধরে রাখি। লোক: মালিক, হামাদের দেশ তো নদীর দেশ, সবুজ ধানের দেশ। তবুও আমরা এত দুঃখী কেন মালিক? নূর: সব তকদিরের খেলা রে ভাই। কপালে দুঃখ থাকলে সুখ তো পাবে না। লোক: হামি আর কী বলব। আপনার দুঃখ কেউ বুঝল না, হামার জ্বালা কেউ বুঝতে চায় না।
হামাদের মগজের মধ্যে দিনরাত কিসব আলতুফালতু ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের সাহসকে গোর দিচ্ছে। আর এই সুযোগে যত সব জালেম আল্লার নাম ভাঙিয়ে হামাদের শরীল থেকে শোঁ শোঁ করে রক্ত শুষে লিয়ে বিদেশে ও পাচার করছে মালিক। আপনারা এসব রুখতে পারেন না কেন?
নূর: তুমি শালা একটা উজবুক। বিড়াল হয়ে বাঘের মুখে থাপ্পড় দিতে চাও। লোক: হামার বাপজান বলত, গরীবুল্লাহ, বেটা অনাহক যারা তাল ঠুকে, তারা খুব বড় কিসিমের গায়েন নয়। কথাটা ঠিক না বেঠিক একবার পরখ করবেন মালিক। হামাদের এই ভাঙা ফুটা শরীল নিয়ে তামাম মানুষ যদি এক জায়গাতে হাজির হতে পারতাম, একবার যদি জালেমের লোভের কজিতে দাঁত বসাতে পারতাম রক্তের নেশাতে গজরাতে পারতাম, তখন বুঝা যেত কারা বিলাই আর কারা বাঘ।
যুদ্ধই তো হয় না মালিক, মরণ
বাঁচার লড়াই। হামরা এই নদীর দেশের মানুষ একটা যুদ্ধ চাই মালিক, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। নূর: গরীবুল্লাহ তোমার কপালে ঢের দুঃখ আছে, এসব কথা বলো না। লোক: সেই দুঃখই তো হামি চাহি মালিক। দুঃখের নদীতে আর কতকাল এমন করে ভাসব, তার চেয়ে উঠুক না কেন আসমান জুড়ে কালো ম্যাঘ, উথাল পাথাল ঢেউ, আর প্রলয় বাতাস।
[গান: খরবায়ু বয় বেগে চারিদিক ছায় মেঘে ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো]
নুর: এই গরীবুল্লাহ, তুমি এ গান পেলে কোথায়? এ তো তোমার স্কুল-কলেজের গান। কিছু পড়ালেখা শিখেছ নাকি? লোক: হামার গাঁয়ের একটা ছাত্র শহরে পড়ে, তার মুখে শুনেছি মালিক। সেই ছাত্র এখন জেলখানাতে বন্দি। নুর: কিসের আসামি? লোক: ঐ আপনার লাটসাহেবের মিটিং যে হলো, তার যে গণ্ডগোল, তারই মধ্যে ছিল। নূর: বেকুবের মতোন এসব হুজ্জতের মধ্যে যায় কেন? লোক: ও ছেলে মানে যে আগুন দিয়ে তৈরি, অন্যায় কথা সহ্য করতে পারে না। বললে বলে, গারদ ফাটক একদিন সব খান খান করে ভেঙে ফেলব। মালিক, আপনি তো ব্রিটিশ আমলের ছাত্র।
দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনার মনটাতে হাহাকার করতো না। নূর: করতো না কি গরীবুল্লাহ, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য কত কী করতাম। লাঠি চালাতাম, রক্তের মধ্যে আগুন ধরে যায় এমন সব গান শিখতাম। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগত্বাসী, তুমি জান নাকি গানটা? লোক: (গান) কলের বোমা তৈরি করে, দাঁড়িয়ে ছিলাম লাইনের ধারে, লাট সাহেবকে মারব বলে, মারলাম স্বদেশবাসী। নূর: সাবাস গরীবুল্লাহ, আবার গাও। লোক: আমি হাসি হাসি পর ফাঁসি, দেখবে জগদ্বাসী। নূর: ঐখানে গাও, চিনতে যদি না পারিস মা, দেখবি গলায় ফাঁসি।
[দু’জনে এক সঙ্গে গান গাইছে। এসব বহুত পুরাতন কথা গরীবুল্লাহ, এখন যুগ জামানার ভিন্ন স্বাদ। দেশের মধ্যে নানান রকম কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কখন যে কী হয়। এই চাকরি করলে কী হবে, বুঝি গরীবুল্লাহ, কিছু কিছু বুঝি। কিন্তু আমাদের হাত-পা যে বন্দি রে ভাই।
লোক: মালিক, একটা কথা ভাবছি আর মনে মনে হাসছি। যে লোকটাকে ধরবার জন্য আপনি এই আলো-আঁধারির রাতে ঘাট পাহারা দিচ্ছেন, ধরেন যে সেই লোকটা সত্যি সত্যি আপনার কাছে হাজির হলো। আপনি তাকে দেখছেন, সেও আপনাকে দেখছে। দেখতে দেখতে আপনার মনের মধ্যে প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই লোক? একে তো আমি চিনি, আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত, আমার বন্ধু। সে লোকটা আপনাকে বলছে- কী রে নূর মোহাম্মদ, কেমন আছিস? আমি মোয়াজ্জেম হোসেন,আমাকে ধরবার জন্য গাছে গাছে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়েছিস। আমাকে ধরলেই কি আগুন নিভে যাবে? স্বাধীনতার আগুন কখনো নেভে।
মালিক, আপনি যখন ছাত্র ছিলেন তখন কি দেশের জন্য আপনাদের মন কাঁদত? নূর: এখনো কাঁদে। যদ্দিন বাঁচব দেশের জন্য কাঁদব। দেশকে ভালোবাসা তো পাপ নয়। যারা স্বাধীনতা, তোমার আমার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে তাদেরকে আমিও ভালোবাসি গরীবুল্লাহ। লোক: তাহলে আপনি আপনার বন্ধুকে ছেড়ে দিবেন না কেন মালিক? নূর: তুমি আবার ঐ একই কথা বললে হে। বলছি তো আমার হাত-পা সব বন্দি। আমি পাহারাদার, আমি একটা বহুত দিনের পুরাতন যন্ত্র । লোক: মালিক, হামরা যদি সেই যন্ত্রটাকে ভাঙতে বলি। নূর: পারবে না, অসম্ভব। লোক: কেন অসম্ভব? নূর: চুপ কর। একটা ডিঙি আসছে। আমি জানতাম আসতেই হবে। আজ আমার ভাগ্যপরীক্ষা।
জীবনের সঙ্গে লড়াই। বিপ্লবীকে ধরতে পারলে দু’হাজার টাকা পুরস্কার। আমার বড় মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিব। লোক: (গান) আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ... নূর: এই গরীবুল্লাহ, তোমার গান বন্ধ কর। লোক: (গান) ছেলে-হারা শত মায়ের অশ্রু ... নূর: শালা ফকিরের বাচ্চা, গান বন্ধ কর। তোমার গলা টিপে গানের চৌদ্দ পুরুষকে জবাই করব গরীবুল্লাহ।
[নদীর বুক থেকে এই গানের সুরে শিস আসছে, নূর মোহাম্মদ গরীবুল্লাহর গলা ছেড়ে দিয়েছে ]
নূর: কে শিস দিল?
গেরীবুল্লাহ নদীর ঘাটে নামছে| এই শালা ঘাটে নামিস না। ঘুরে দাঁড়া, গুলি করব।
গিরীবুল্লাহ ঘুরে দাঁড়াল] কে তুমি? ঠিকমতো পরিচয় দাও। কে তুমি? লোক: ফকির গরীবুল্লাহ মালিক। শাদুল্লা গায়েনের ব্যাটা। নূর: ঝুট। মিথ্যা কথা বলো না। তুমি অন্য লোক। | লোক: অন্য কোন লোেক? কে হতে পারি বলুন তো। নূর: তুমি! আপনি কি সেই লোকটা, আসামি বিপ্লবী।
[লোকটি পরচুলা, দাড়ি আর টুপি খুলল]
লোক: মিলছে। চাপা মুখ, কালো চোখ, মাথার চুল ছোট, লম্বা সাড়ে পাঁচ ফুট। দু হাজার
টাকার পুরস্কার। ডিঙিতে আমার বন্ধুরা শিস দিয়েছে ঠিক সময়ে। ঐ যে কৃষ্ণপক্ষের চাদ উঠছে। এখন আমি যাব দারোগা সাহেব, যেতেই হবে, আমাদের জরুরি বৈঠক আছে। নূর: আপনি যাবেন? লোেক: হ্যা। নূর: আমার তকদির। আপনার তো যাওয়া হবে না। লোক: আপনি আমার বন্ধু। যেতে দিন। নূর: না, নূর মোহাম্মদ দারোগা তোমাকে ছাড়বে না।
[লোকটি পিস্তল বের করেছে। নূর মোহাম্মদের হাতেও পিস্তল। মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে লোক: স্বাধীনতার আগুন কখনো নেভে না। নূর: কাছে এসো না গরীবুল্লাহ। লোক: যদ্দিন বাঁচব দেশের জন্য কাঁদব। যারা স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে
তাদেরকে আমিও ভালোবাসি। নূর: গরীবুল্লাহ, না। আর এগিয়ে এসো না। লোক: [এগিয়ে আসছে। নূর মোহাম্মদ পিছোচ্ছে: গান ধরেছে]
নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা নূর: তোমাকে আমি ছাড়ব না গরীবুল্লাহ, ডিউটি ইজ ডিউটি।
[পুলিশ দু’জন আসছে, তাদের কথা শোনা যাচ্ছে লোক: আমি ঐটার পিছনে বসে থাকব।
নূর: কেন? লোক: পালাব না।
নূর: আহ!
[লোকটি পিপেটার পিছনে লুকাল। পুলিশ দু’জন এসেছে দলিলুর রহমান, আব্দুল বারেক মণ্ডল। সব কাজ শেষ করেছ? বারেক: ভালো করে সেঁটে দিয়েছি স্যার। নূর: সাবাস। বিপ্লবী আর পালাতে পারবে না। দলিল, হারিকেনটা নিভিয়ে দাও।
দলিল: জ্বলুক স্যার। ঐ পিঁপেতে রেখে দিই। নূর: আহ। দরকার হবে না। আকাশে চাঁদ উঠছে। দলিল: এ চাদে আলো নাই স্যার। নূর: এখন নাই, মাঝরাতে হবে। থানায় ফিরে যাও তোমরা। বারেক: ফিরে যাব? কিন্তু আসামি? নূর: আমি একলাই মোকাবিলা করব। বারেক: স্যার, আসামি খুব আঁাহাবাজ। নূর: হোক। এ্যাটেনশন, এ্যাবাউট টার্ন।
[পুলিশ দু’জন যান্ত্রিক নিয়মে চলে গেল, হারিকেনটা জ্বলছে। লোকটি উঠে এল]
লোক: দারোগা সাহেব। নূর: হারিকেনটা তুলে নিয়েছে| অমন করে কী দেখছেন? লোক: আমার পরচুলা আর টুপিটা। অনেক দূর যেতে হবে। নূর: ঠিকমতো পরে নিন।
[লোকটি পরচুলা আর দাড়ি লাগাচ্ছে। খুব সাবধান। আপনার চারদিকে দুশমন। পদে পদে বিপদ। লোক: ঘরে ঘরে আমাদের বন্ধু। নূর: আবার কখন দেখা হবে। লোক: একদিন সকালে, যখন আকাশ জুড়ে প্রকাণ্ড লাল সূর্য উঠবে, অথবা এক রাত্রিতে, যখন আকাশ ভরে পূর্ণ চাদ হাসবে।
[দু’জনে আন্তরিক উষ্ণতায় করমর্দন করল] নূর: আসুন। লোক: হামার নাম ফকির গরীবুল্লাহ। নূর: তুমি বিপ্লবী মোয়াজ্জেম হোসেন, স্বাধীনতার সৈনিক। [লোকটি নদীর ঘাটে নামছে। [ নদীর বুক থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে গান উচ্চারিত হচ্ছে।
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
নূর মোহাম্মদ, আব্দুল বারেক, দলিলুর রহমান নীরবে দাঁড়িয়ে আছে]
শব্দার্থ ও টীকা: গঞ্জ- ব্যবসা বাণিজ্যের স্থান, হাট। কৃষ্ণপক্ষ- চান্দ্রমাসের যে পক্ষে চন্দ্রের ক্ষয় হয়। রাহী- পথচারী, পথিক নজরে- দৃষ্টিতে; বেকুব বেয়াকুব, বোকা। ভিন কিসিমের মাল- ভিন্ন বা অন্য রকমের মানুষ। তেলের পিপে- তেলের ড্রাম। জালুয়া- জেলে, ধীবর। হুক্কা- কাঁসা পিতল দস্তা বা মাটি অথবা নারকেল খোলে তৈরি একপ্রকার নলযুক্ত যন্ত্র যা তামাক খেতে বা ধূমপান করতে ব্যবহৃত হয়। ধড়িবাজ- ফন্দিবাজ, প্রতারক। টহলদার- যে টহল দেয়, প্রহরী। নুলা- বিবশ, বিকল। বেহুদা- অনর্থক, বাজে। রোজকিয়ামত- মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের দিন,শেষ বিচারের দিন। খাস্তা- নষ্ট, পীড়িত, বিকৃত। বেদিশা দিকভ্রষ্ট, দিশেহারা। রুহু- আত্মা, অন্তর। তকদির- ভাগ্য, অদৃষ্ট, কপাল। নাহক- অযথা, খামখা, অনর্থক। তামাম- সমগ্র, সমস্ত, সমুদয়। জালেম- জুলুমকারী, অত্যাচারী। গজরাতে- আক্রোশে বা ভয়ে চাপা গর্জন করা। হুজ্জত- গোলমাল, হাঙ্গামা। জামানা- সময়, কাল, যুগ। আঁহাবাজ- দুর্দান্ত, দজ্জাল। এ্যাটেনশন- সাবধান হও। এ্যাবাউট টার্ন- ঘুরে দাঁড়াও।
পাঠ-পরিচিতি: বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শতবর্ষের নাটক’ নামক গ্রন্থ থেকে স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ নাটিকাটি সংকলিত ও সম্পাদিত হয়েছে। নাট্যকার এখানে আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যদের মানবতাবোধ এবং দেশাত্মবোধ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন। দারোগা নূর ৯ মোহাম্মদ পুরস্কার ঘোষিত স্বদেশী আন্দোলনের আসামিকে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও তাকে ও ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থপুরস্কারের লোভ জয় করে তিনি দেশের স্বাধীনতার ও বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। একজন দারোগা, দুইজন পুলিশ সদস্য এবং একজন বিপ্লবীকে নিয়ে রচিত এ নাটকের প্রতিটি চরিত্রই আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
অনুশীলনী
কর্ম-অনুশীলন
১। শ্রেণিশিক্ষকের উপস্থিতিতে সবার অংশগ্রহণে পালাক্রমে নাটিকাটি অভিনয় করে দেখাও।
বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। নূর মােহাম্মদ কাকে বেকুব বলেছিলেন?
ক. বারেককে
খ. দলিলকে
গ. গরীবুল্লাহকে
ঘ. মােয়াজ্জেম হােসেনকে
২। যারা স্বাধীনতা, তােমার আমার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে তাদেরকে আমিও ভালােবাসি গরীবুলাহ।' পুলিশ কর্মকর্তার এ বক্তব্যে কী প্রকাশ পায়?
ক. সরকারের প্রতি আনুগত্য
খ. গভীর দেশপ্রেম
গ. শাসকের কঠোরতা
ঘ. দায়িত্বশীল আচরণ
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও:
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে স্কুল মাস্টার গনি মিয়া গ্রামের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাধারণ জনতাকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ছদ্মবেশে থেকে নিজে সমগ্র বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন।
৩। উদ্দীপকের গনি মিয়া স্বাধীনতা,আমার স্বাধীনতা’ নাটিকার যে চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে তা হলাে-
i নূর
ii বারেক
iii লােকটির
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
গ. iii
খ. ii
ঘ. i, ii ও iii
৪। উদ্দীপকের গনি মিয়ার সাথে স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' নাটকের নূর মােহাম্মদ সাহেবের কোনটিতে সাদৃশ্য রয়েছে?
ক. সততা
খ. দেশপ্রেম
গ. সাহস
ঘ. নেতৃত্ব
এসএসসি (SSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: বাংলা ১ম পত্র গাইড
মাস্টার দা সূর্য সেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এ দেশের গণমানুষকে জাগিয়ে তুলতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। তাঁরই নির্দেশে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরােপিয়ান ক্লাবে সফল হামলার পর ব্রিটিশ শাসকদের টনক নড়ে। তঁাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘােষণা করা হয়। অর্থের লােভে জনৈক ব্যক্তি তার অবস্থান জানিয়ে দিলে তিনি ধরা পড়েন। অতঃপর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ক. রাহী’ কথার অর্থ কী?
খ. ‘আমাদের সবদিকেই বিপদ’-বারেক কেন এ কথা বলেছিল?
গ. উদ্দীপকের সূর্য সেনের মাঝে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ নাটিকার সাদৃশ্যপূর্ণ চরিত্রটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “পরিণতি এক না হলেও সূর্য সেন ও স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা' নাটিকার বিপ্লবী ব্যক্তি যেন একসূত্রে গাঁথা”- যুক্তিসহ প্রমাণ কর।
0 Comments:
Post a Comment